ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

পারমাণবিক প্রযুক্তিতে খুললো আয়ের পথ

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪৩ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৪
পারমাণবিক প্রযুক্তিতে খুললো আয়ের পথ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টফোর.কম

ঢাকা: গুড়ো মসলা বিশুদ্ধকরণ আর সংরক্ষণে ব্যবহার করা হচ্ছে পারমাণবিক প্রযুক্তি! পিলে চমকানোর মতো বিস্ময়কর! তবে অবাক হলেও সত্য।

বাণিজ্যিকভাবে পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহারে মাধ্যমে আয়ের পথ খুলে গেছে  সরকারের।

মূলত পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমেই এ কাজে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করার পথ দেখিয়েছেন দেশের পরমাণু বিজ্ঞানীরা।

ফার্মাসিউটিকেলস সামগ্রী, বিদেশে রপ্তানিমুখী বিভিন্ন মসলা কিংবা শুটকির মতো খাদ্য সামগ্রীকে  জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে পরমাণু শক্তি ব্যবহার করে। একইসাথে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কিংবা সংরক্ষণও করা হচ্ছে এ প্রযুক্তিতে।
paromanobik
সাভারের আশুলিয়া থানার গণকবাড়িতে পরিচালিত হচ্ছে বিশাল এই কর্মযজ্ঞ। পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রেডিয়েশন পলিমার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে  থরে থরে সাজানো রয়েছে গুড়ো মসলার কার্টুন। কোনটিতে হলুদ। কোনটি বা মরিচের। কোনটি আবার জিরা কিংবা ধনিয়ার। সবার গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য, অষ্ট্রেলিয়া, নিউইর্য়ক, লন্ডন কিংবা ইউরোপের কোনো দেশ। আকাশ পথ কিংবা সাগর পথে পাড়ি দেবার জন্যে একবার অন্তত এসব মসলাকে ঘুরে যেতে হয় সাভারে। ভিনদেশে যাবার আগে এসব মসলাকে দিতে হয় পরীক্ষা। তাও যে সে পরীক্ষা না। রীতিমতো পারমাণবিক পরীক্ষা! আর এ পরীক্ষার অংশ নিতেই সাভারে আশুলিয়ার গণকবাড়িতে বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রেডিয়েশন পলিমার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে এভাবেই দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষায় থেকে প্রস্তুতি নিতে দেখা গেলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা ভোগ্যপণ্যসহ জীবনরক্ষাকারী বিভিন্ন ফার্মাসিউটিকেলস উপকরণের।

পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে গুড়ো মসলার মতো খাদ্যপণ্যসহ ফার্মাসিউটিকেল সামগ্রী জীবাণুমুক্তকরণ ও সংরক্ষণে নানাবিধ গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কাজটি করছে রেডিয়েশন পলিমার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট ।

রেডিয়েশন পলিমার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মুবারক আহমেদ খান বাংলানিউজকে জানান,পরমাণু শক্তির ব্যবহার করে দেশে কিভাবে খাদ্যশস্য, মাছ, মসলা, শুঁটকি মাছ ইত্যাদির কীট দমন করা যায় সে ব্যাপারে আমরা প্রথমে গবেষণা শুরু করি। তারপর সফলতা আসে। এখন বিদেশে পণ্য রপ্তানির আগে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্ভর করে আমাদের ওপর।

তিনি জানান, পরমাণু প্রযুক্তির মাধ্যমে রেডিয়েশন দিয়ে আমরা খাদ্যপণ্যকে ব্যাকটেরিয়া কিংবা ছত্রাকমুক্ত করি।
paromanobik_
একই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা খাদ্য সংরক্ষণ ও বিভিন্ন ফার্মাসিউটিকেলস সামগ্রীকে করছি জীবাণুমুক্তকরণ। রপ্তানি করা এসব পণ্য সংশ্লিষ্ট দেশে প্রবেশের আগে আমাদের সনদ দেখে  দেশগুলোর মান নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ। তার পরই বাংলাদেশের খাদ্যপণ্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে প্রবেশের অনুমতি দেয় তারা।

এইভাবে রপ্তানিপণ্যকে রেডিয়েশন দিয়ে আমরা সরকারের কোষাগারে তুলে দিচ্ছি মোটা অংকের রাজস্ব, যোগ করেন ড. মুবারক আহমেদ খান।

যেমন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাইরের দেশের কোনো খাদ্যপণ্য প্রবেশের আগে তার মান নিয়ন্ত্রণ করে খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ)। তাদের মানদন্ড অনুযায়ী খাদ্যপণ্যকে সম্পূর্ণভাবে জীবাণুমুক্ত করার কাজটি কিন্তু আমরাই করছি পরমাণু প্রযুক্তির সাহায্যে, জানান ড. মুবারক।
রেডিয়েশন পলিমার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের সাড়ে ৩শ’ কিলোক্যুরি ক্ষমতা সম্পন্ন গামা সোর্সের সাহায্যে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ, কৃষিজাতপণ্য জীবাণুমুক্তকরণ, বালাই দমন  ও চিকিৎসা সামগ্রী জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের রেডিয়েশন পলিমার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন গামা বিকিরণ প্লান্ট।
গামা বিকিরণের মাধ্যমে খাদ্য সামগ্রী, মেডিকেল সামগ্রী, ফার্মাসিউটিক্যাল কাঁচামাল ইত্যাদি সম্পূর্ণ কিংবা প্রয়োজন অনুপাতে ‘রেডিয়েশন’ দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হয়।  

কোন পণ্যে কী মাত্রায় রেডিয়েশন (গামা বিকিরণ) দিতে হবে তা প্রথমে গবেষণার মাধ্যমে নির্ণয় করেন এখানকার বিজ্ঞানীরা। যার প্রধান ড. মুবারক আহমেদ খান।

দেশি একটি খাদ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, খাদ্য সামগ্রীতে বেশি মাত্রায় ব্যাকটেরিয়া বা ক্ষতিকর জীবাণু রয়েছে এমন পণ্য প্রবেশ করতে দেয় না ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ।

কঠোর মান নিয়ন্ত্রণের পরও পণ্যে বজায় থাকে বিভিন্ন মাত্রার অণুজীব বা ছত্রাক। যা নির্মূল করতে আমাদের নির্ভর করতে হয় পরমাণু প্রযুক্তির ওপর।
প্রতিবছর যে পরিমাণ মশলা বিদেশে রপ্তানি হয় তার অধিকাংশই এ প্লান্টে বিকিরণ পদ্ধতিতে জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই প্রায় ৬০ টন মসলা এ প্লান্টে ক্ষতিকর জীবাণু থেকে মুক্ত করা হয়। সেখানে দেখা গেলো বাংলাদেশের স্কয়ার কনজুমার প্রোডাক্ট লিঃ, প্রাণ এগ্রো লিঃ এর রপ্তানির অপেক্ষায় থাকা বিভিন্ন পণ্য। এছাড়া স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল লিঃ, এরিস্টোফার্মা লিঃ, ইনসেপ্টা ফারমাসিউটিক্যাল লিঃ, এসি আই লিঃ, এপেক্স ফার্মা লিঃ, একমি ল্যাবরেটরিজ লিঃ, মনোমেডি বাংলাদেশ লিঃ প্রভৃতি ঔষধ  প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তাদের কাঁচামাল, প্লাস্টিক কন্টেইনার, কটন প্যাড, সিরিঞ্জ, কপার টি ইত্যাদি রেডিয়েশন পদ্ধতিতে সম্পূর্ণরূপে জীবাণুমুক্ত করে থাকে এই প্ল্যান্ট থেকে। ইথিলিন অক্সাইড গ্যাস প্রয়োগে মেডিক্যাল সামগ্রী জীবাণুমুক্তকরণে টক্সিক রেসিডিউ থাকার সম্ভাবনা থাকায় সারা বিশ্বে বর্তমানে রেডিয়েশন প্রযুক্তি বেশ জনপ্রিয়। এ পদ্ধতিতে কোন টক্সিক রেসিডিউ থাকে না, যোগ করেন রেডিয়েশন পলিমার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মুবারক আহমেদ খান।
paromanobik_bg
বাংলানিউজকে তিনি জানান, এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদের সেবা নেবার ব্যাপারে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে।

যার মধ্যে মালেশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান সেখান থেকে নন স্টেরিলাইজড গ্লাভস এনে এখানে রেডিয়েশন প্রযুক্তির মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করার জন্য আলোচনা শুরু করেছে।

এই আলোচনা সফল হলে আমরা পরমাণু প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহারের মাধ্যমে সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবো- জানান ড.মুবারক আহমেদ খান।

তিনি আরো জানান,দেশের সস্তা শ্রম বাজারকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গরুর চামড়া থেকে তৈরি পশু খাদ্য রপ্তানির জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। সেখানে জীবাণু নিয়ন্ত্রণের বাধ্যবাধকতা থাকায় তারা ইতোমধ্যে আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে।

রেডিয়েশন পলিমার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের সাড়ে ৩শ’ কিলোক্যুরি ক্ষমতাসম্পন্ন গামা সোর্সটি বর্তমানে এক শিফটে চলছে। বাড়তি ব্যয় ছাড়াই সোর্সটি তিন শিফটে চললে সরকারের রাজস্ব আয় বহুগুনে বেড়ে যাবে বলে জানান ড.মুবারক আহমেদ খান।

বাংলাদেশ সময়: ০৪৪১ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।