ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

মহেশখালী কতোদূর!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৪
মহেশখালী কতোদূর!

মাতারবাড়ি, মহেশখালী, কক্সবাজার থেকে ফিরে: বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে মহেশখালীর মাতারবাড়ি যেতে হবে। এ কারণে ৩ জন সাংবাদিক প্রতিমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হতে রাজি হননি।



তাদের যুক্তি হচ্ছে হঠাৎ সাগর উত্তাল হতে পারে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে হলে অন্যকথা। কিন্তু মার্চের শেষে সাগরে যাওয়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, এমন সতর্কতাও দিয়েছেন তারা।

আর কক্সবাজার গেলেও মাতারবাড়ি যাওয়ার স্পিডবোটে উঠতেই ইতস্তবোধ করছিলেন কয়েকজন সাংবাদিক। একজন বলে উঠলেন তোমরা কি ‘পুরষ’ না অন্যকিছু!

আর যাই হোক, ‘পুরুষত্ব’ নিয়ে খোটা তো আর মেনে নেওয়া যায় না। তাই ভয় নিয়েই স্পিডবোটে উঠলেন তারা।

কক্সবাজার নুনিয়াছড়া ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে সকাল সোয়া ৯টায় স্পিডবোটে রওয়ানা হলাম। আমাদের বোটে জ্বালানি বিটের ৯ সাংবাদিক ও দুইজন স্থানীয় ব্যক্তি ওঠেন। লক্ষ্য ২৭ কিলোমিটার দূরে মাতারবাড়ি ঘুরে ৩৭ কিলোমিটার দূরত্ব ভাঙ্গার খাল।

কথা ছিলো প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরা একসঙ্গে রওয়ানা হবেন। কিন্তু গাজী টিভির ক্যামেরাপারসনের কারণে বিপত্তি দেখা দেয়। সবাই ঘাটে যাওয়ার জন্য গাড়িতে বসে অপেক্ষা, কিন্তু তিনি বের হচ্ছিলেন না।

কেউ বলছিলেন একজনের জন্য অপেক্ষা করার মানেই হয় না। কেউ কেউ তার কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বলেন, ট্যুরে এসে জমিদারি চলে না।

প্রায় ২০ মিনিট বিলম্বে হাজির হন ওই ক্যামেরাপারসন। একজন বলে উঠলেন, এভাবে চলে না। অন্যরাও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরাপারসন বলেন, ‘সরি, আমি ক্যামেরার কার্ড খুজে পাচ্ছিলাম না। তাই দেরি হয়েছে। ’

অন্যদিকে আমাদের বিলম্বের কারণে প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের রেখেই রওয়ানা দেন। আমাদের  বহনকারী স্পিডবোটটি ২-৩ কিলোমিটার যাওয়ার পর মাঝনদীতে গতি কমিয়ে দেন চালক। বলেন, যাত্রী বেশি হয়ে গেছে। ১০ জনের বেশি তোলা ঠিক নয়।

চালক বলে ওঠেন, মহেশখালী পিকনিক স্পট হলে কথা ছিল না। কিন্তু মাতারবাড়ি অনেক দূরত্বের পথ। তাছাড়া, সাগর পাড়ি দিয়ে যেতে হবে।

আগে থেকেই ঘামছিলেন স্পিডবোটে থাকা জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মোফাখখারুল ইকবাল। ঘামার কারণ রোদ নাকি ভয় খুব- সেটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল না।

এরই মধ্যে পানির দেড় লিটার বোতল প্রায় সাবাড় করেছেন। অন্যদের পানি খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। নিজের ভয় গোপন করতে।

স্পিডবোট চালকের এই বক্তব্য তিনিই প্রথম কথা ধরেন, ‘আগে না বলে মাঝনদীতে এসে বলছেন কেন। ’

অন্যরাও গালমন্দ করতে শুরু করেন। বিষয়টা তর্কের দিকে যাচ্ছিল। তখন ভোরের কাগজের টিটু সাহা ভয় দেখানোর জন্য বেশ নিচুস্বরে বললেন, চালকের সঙ্গে রাগারাগি করবেন না। কারণ ক্ষিপ্ত হয়ে স্পিডবোট ডুবিয়ে দিতে পারে। এ রকম অনেক রেকর্ড রয়েছে।

অনেকেই ভয় পেয়ে যান। আস্তে আস্তে শান্ত হয়। আবার দ্রুত গতিতে স্পিডবোর্ড চলা শুরু হয়। সবার মধ্যেই গুমোটভাব।

প্রসঙ্গ বদলাতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেই, ‘বলুনতো, পৃথিবীতে সবচেয়ে ধৈর্য্যশীল কোন পেশার লোক’।

একজন বলে উঠলেন, সাংবাদিক। তার ব্যাখ্যাও দিলেন। তার যুক্তি হচ্ছে অষ্টম ওয়েজবোর্ড ঘোষণা হয়েছে। অনেক পত্রিকায় বাস্তবায়ন করেনি। কিন্তু সাংবাদিকরা কোনো কথা বলছে না। এটাই ধৈর্য্যের বড় প্রমাণ।

আবার কেউ বললেন শিক্ষক, কেউ রিক্সা চালকের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। শুরু হয় অনির্ধারিত বিতর্ক। এবার আমি বলে উঠলাম। কোনটাই সঠিক হয়নি। সঠিক উত্তর হচ্ছে ‘ড্রাইভার’।

প্রায় সবাই এর বিপক্ষে অবস্থান নিলেন। তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন দৈনিক আমাদের সময়ের লুৎফর রহমান কাকন। এবার আমি আমার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বললাম, ‘গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে নানাভাবে উত্যক্ত করেন অনেক যাত্রী। যেমন, এই এভাবে চালাচ্ছো কেন? যেখানে-সেখানো দাঁড়াচ্ছো কেন? আস্তে গেলে, এতোধীরে কেন? জোরে গেলে, জোরে কেন? গাড়ি দেখে চালাও! কতদিন ধরে গাড়ি চালাও? এই গাড়িতে উঠাই ভুল হয়েছে! ইত্যাদি।

কিন্তু কোনোদিন কি কোনো চালক রাগ করে বাস খাদে ফেলে দিতে দেখেছেন। তখন সবাই যুক্তিটি গ্রহণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে স্পিডবোট চালকের প্রতি সংশয় কেটে যায়।

যাওয়ার পথে গোরকঘাটা, আদিনাত মন্দির, মুদিরচড়া, উজান টিয়া, নয়নাভিরাম সৌন্দর্য সকলকে মুগ্ধ করে তোলে। কোথাও তীর ঘেষে পাহাড় আর তার কোল ঘেষে সারি সারি পানের বরজ, কোথাও প্রকৃতিগতভাবেই বেড়ে ওঠা নানা রকম গাছপালা। কোথাও বিশাল ফাঁকা মাঠে মহিষের পাল, আবার কোথাও নানা রকম পাখির ঝাঁক। প্রসঙ্গ চলে আসে মহেশখালীর সৌন্দর্য নিয়ে।

তথ্য কর্মকর্তা মোফাখখারুল ইকবাল বলে ওঠেন, আমেরিকা যাওয়ার দরকার নেই। দেশটাই তো দেখা হয়নি। কখনও মহেশখালীতে আসিনি। এবার না এলে মিস করতাম।

প্রায় ঘণ্টাপর কোহেলিয়া নদীর একটি ক্যানেলে প্রবেশ করে আমাদের স্পিডবোটটি। ক্যানেলটি অনেকটাই ক্ষীণ এবং ধনুকের মতো। বড়জোর ২৫ ফুট প্রস্থ হবে। বেশিদূর সামনে দেখা যাচ্ছিল না।

১ কিলোমিটার যেতেই একটি বাঁকে দেখা মেলে প্রতিমন্ত্রীকে বহনকারী বড়সাইজের স্পিডবোটটির। ভাটার কারণে পানি কম থাকায় আটকে গেছে। আমাদের বহনকারী স্পিডবোটটি ছোট আকৃতির হওয়ায় ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়।

কয়েক মিনিটের ব্যবধানে জোয়ার চলে আসায় গতি ফিরে পায় স্পিডবোট। কয়েক মিনিট ব্যবধানে রাজারঘাটে জীবনে প্রথম ‘পানিসভা’র সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়।

কয়েক মিনিট যাত্রা বিরতির পর আবার চলা শুরু হয়। প্রস্তাবিত মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্ধারিত স্থানের উদ্দেশে। চারিদিকে কোনো জনবসতি নেই। শুধু লবণ চাষ ও চিংড়ি ঘের।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী। এরপর প্রস্তাবিত এলএনজি টার্মিনালের নির্ধারিত স্থানের দিকে রওয়ানা হন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তবে এবার গভীর সমুদ্র আমবশ্যাখালী চ্যানেল হয়ে।

সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ স্পিডবোটে প্রচণ্ড বেগে আঘাত করছিলো। মনে হচ্ছিল যেনো পানির তোড়ে ফেটে যাবে স্পিডবোট। ভয়ে জড়োসড়ো কেউ কেউ। এমন সময় হঠাৎ স্ট্যার্ট বন্ধ হয়ে যায়। ভয়ে আঁতকে ওঠেন সবাই। চালক বলে ওঠেন, তেল শেষ হয়ে গেছে।

রিজার্ভ তেল ছিলো সবাই দ্রুত তুলতে বললেন। কিন্তু চালক বললেন ‘হুন্দারা’ নাই। আটকে থাকা স্পিডবোটটি ঢেউয়ে টলছিলো। কিন্তু আমরা কেউ চালকের এই সমস্যার কথা বুঝতে পারছিলাম না। কয়েক মিনিট আটকে থাকার সময় অন্য স্পিডবোটগুলো একে একে পাশ কেটে যাচ্ছিল।

চালক চিৎকার দিয়ে সহায়তা চাইছিলেন কেউ সাড়া দিচ্ছিলেন না। একটি স্পিডবোট এগিয়ে গিয়ে ফেরত আসেন। সেখান থেকে ‘হুন্দারা’ নেন আমাদের বোটের চালক।

তখন সবাই অবাক। আর ‘হুন্দারা’ রহস্যের কিনারা হয়। সেটি আসলে অন্য কিছু নয়, বোতল বা ড্রামে তেল ভরার যন্ত্র চোঙা। হাসির রোল পড়ে যায় ‘হুন্দারা’ নিয়ে। আবার চলতে শুরু করে স্পিডবোট।

এবার একটি ট্যানেলের ভেতর দিয়ে চলা শুরু করে স্পিডবোটটি। গা ছম ছম করে ওঠে। দু’পাশে ঘন কেওড়া বন। শুনশান নীরবতা। দেখতে মনে হচ্ছিল, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।

এরপর প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর, সিঙ্গেল মুরিং পয়েন্ট (সাগরে জ্বালানি তেল আমদানির ডিপো) পরিদর্শন করেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। ঝকঝকে পানি আর নির্মল বাতাস উপভোগ করেন সকলেই।

বিকেলে ৩টায় কক্সবাজারে স্পিডবোট পৌঁছলে শঙ্কা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কেটে যায়। ঘাম ঝরাও বন্ধ হয়ে যায় সবার।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, আজকে চিংড়ি ঘের ও লবণ চাষ দেখলেও একদিন আসবে যখন এখানে ফাইভ স্টার হোটেল হবে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা হেলিকপ্টার নিয়ে ঘুরতে আসবে।

সরকারের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হাব তৈরি হবে। ভবিষ্যতে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, হাসাপাতাল, যোগাযোগের জন্য রেললাইন নির্মিত হবে। সব মিলিয়ে একটি আত্যাধুনিক মনোরম শহরে পরিণত হবে মহেশখালী।


পুরো ভ্রমণটাই ছিল ব্যস্ত সূচির। কিন্তু কথার টক্কর আর খুনসুটিতে ভরপুর ছিল। সবচেয়ে মজার বিষয়ছিলো একে অপরের খোঁজ নেওয়া। বাসে যাওয়া আসার পথে কারও ঘুমাবার জো ছিল না।

কেউ চোখ বন্ধ করলেই অন্যরা তাকে ডেকে তুলে ‘খোঁজ নিয়েছেন’, ‘ভাই কি ঘুমুচ্ছেন!’ ‘কোনো সমস্যা আছে কি-না!’ বা ‘ঘুমে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি-না। ’

এমন সুন্দর আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ: ০৭০৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।