ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

বকেয়া পরিশোধ ছাড়াই বন্ধ ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্র

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ও শরীফ বিশ্বাস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৪
বকেয়া পরিশোধ ছাড়াই বন্ধ ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্র

কুষ্টিয়া থেকে: কর্মচারীদের বকেয়া পরিশোধ না করেই ১১০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে অটবি। শনিবার মৌখিক নির্দেশনায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অটবির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘কোয়ান্টামের পাওয়ার’র বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও।

বিকেলে বিষণ্ন মনে বাড়ি যেতে দেখা গেছে হতাশাগ্রস্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের।
 

অটবির ওই কারখানাটির মাস্টার রোল কর্মচারী মিলন বাংলানিউজকে জানান, কারখানা বন্ধের নোটিশ দেওয়া হয়নি। শনিবার মৌখিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কবে চালু হবে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। সাতদিন পর খোঁজ নিতে বলা হয়েছে।
 

লিখিতভাবে নোটিশ না দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ায় চিন্তিত শ্রমিক-কর্মচারীরা। শহিদুল ইসলাম নামের একজন টেকনিশিয়ান জানান, বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন করায়ই আমাদের ‘কাল’ হয়েছে। মালিকপক্ষ ক্ষেপে গিয়েই এ ব্যবস্থা নিয়েছে।
 

ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক্সিকিউটিভ (এইচআর অ্যান্ড অ্যাডমিন) রবিউল হাসান ভূঁইয়া বাংলানিউজকে জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কেউ নেই। সবাই চলে গেছেন।
 

বন্ধ করে দেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, হেড অফিস (ঢাকা) থেকে মেইল এসেছে। তাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাতদিনের জন্য ছুটি দিতে বলা হয়েছে। আমরা সে মোতাবেক বন্ধ করে দিয়েছি। ডিসেম্বর মাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

বকেয়া বেতন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, জানুয়ারি আর চলতি মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে।
 

তার নিজের বেতনও বকেয়া রয়েছে বলে জানান রবিউল হাসান ভূঁইয়া।  

 

কবে নাগাদ চালু হবে সে বিষয়ে জানতে চাইলে রবিউল হাসান জানান, আমি বিষয়টি বলতে পারব না। সব হেড অফিস জানে।

 

টেকনিশিয়ান শহিদুল ইসলামও বাড়িতে যাচ্ছিলেন। তিনি বাংলানিউজকে জানান, বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই বাড়ি চলে যাচ্ছি।  

 

বকেয়া বেতন না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটা কোনো কথা হলো। সারামাস কাজ করে যদি বেতন না পাই তাহলে আমরা চলবো কীভাবে। আমাদের তো আর জমিদারি নেই। বন্ধ দেওয়ার আগে বকেয়া পরিশোধ করার দাবি করেছিলাম আমরা। কিন্তু সে দাবিও মানেনি অটবি।

 

শ্রমিকরা জানান, কোনো রকম ঝামেলা না করার জন্য লোকাল মাস্তানদের দিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুব উল-আলম হানিফের ভাই রফিকুল আলম চুনুর লোকজন তাদের হুমকি দিয়েছেন। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছেন চুনু। নির্মাণকালে ছিলেন সবকিছুর সরবরাহকারী।  

 

চুনুর ক্যাডাররা হুমকি ধামকি অব্যাহত রেখেছে। যে কারণে শ্রমিক-কর্মচারীরা কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় অবস্থিত ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে ২১০ জন শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছে। চারমাস যাবত বেতন আটকে রাখে অটবি। গত ঈদের আগেও বেতন না দিয়ে শুধু বোনাস দিয়েছিল। তখন বলা হয়েছিলো ঈদের পরেই সব বকেয়া শোধ করা হবে। কিন্তু অনেক আবেদন করেও বেতন না পেয়ে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করে শ্রমিক-কর্মচারীরা।

 

বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভেতরে ওই কর্মসূচি চলে টানা চারদিন। ৪ ফেব্রুয়ারি মজিবুর রহমান, গৌতম কুমার শেঠ, লালন আহম্মেদ, হাসান আলী, আশরাফুল হক ও জহুরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়লে ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি হয়েছেন। টনক নড়ে অটবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিমেষ কুন্ডের।  

 

 

বকেয়া পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিলে অনশন ভাঙেন তারা। অটবির পক্ষ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সিইও গোলাম মোস্তফা ঘোষণা দিয়েছিলেন, পুরো বকেয়া পরিশোধ করা হবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার অর্ধেক বকেয়া পরিশোধ করা হয়।  

 

ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সিইও গোলাম মোস্তফা বাংলানিউজকে জানান, এখন কাজ নেই। সে কারণে ছুটি দেওয়া হয়েছে।

 

তিনি জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সরকারের সঙ্গে তিন বছরের ভাড়ার চুক্তি হয়। সে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। নতুন করে আরও ৫ বছরের জন্য চুক্তির প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে রয়েছে। চুক্তি হয়ে গেলে মেশিনগুলো ওভারহোলিং করে চালু করা হবে।

কবে নাগাদ আবার চালু করা হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন নি গোলাম মোস্তফা।

 

গোলাম মোস্তফা আরও বলেন, অটবি কিছুটা সমস্যায় রয়েছে, যে কারণে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বকেয়া পড়েছিলো। তার মধ্যে তিন মাসের পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। আরও কিছু বকেয়া রয়েছে। শিগগিরই পরিশোধ কর‍া হবে।

২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে উৎপাদনে আসার কথা ছিলো ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির। কিন্তু যথাসময়ে নির্মাণ করতে ব্যর্থ হয় অটবি। অনেক পরে উৎপাদন শুরু করে।

অটবি সূত্র জানায়, অতি মুনাফালোভী মানসিকতা থেকে পুরাতন মেশিন এনে ফেঁসে গেছে কোম্পানিটি। যে কারণে কোনোদিনই পুরোমাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি। ভেড়ামারার সঙ্গে যশোরের নোয়াপাড়ায় আলাদা একটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পায় অটবি।  

 

নির্মাণ বিলম্ব ও পূর্ণমাত্রায় বিদ্যুৎ দিতে না পারায় অটবির প্রায় ২শ’ কোটি টাকা জরিমানা করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। আর জরিমানা পরিশোধ করতে গিয়ে দেউলিয়া হতে বসেছে কোম্পানিটি। পুরোমাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ব্যর্থ হলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ভাড়ার মেয়াদ আরও ৫ বছর বাড়ানো হচ্ছে।

 

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আইপিপি সেল-১ এর পরিচালক গোলাম কিবরিয়া বাংলানিউজকে জানান, অটবির চুক্তির মেয়াদ আরও ৫ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। শিগগিরই আবার চুক্তি করা হবে।

 

বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একাধিক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানান, ১৯৮৯ সালের পুরাতন মেশিন আনা হয়েছে। যে কারণে যান্ত্রিক ত্রুটি লেগেই আছে। তেল বেশি পুড়লেও ঠিকমতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। ১৪টি ইউনিটের মধ্যে একটি ভেঙে গেছে নির্মাণকালেই। আরেকটির শেফ ভেঙে বিকল হয়ে রয়েছে দেড় বছর ধরে।

 

কোনোদিনই সঠিকভাবে চলতে পারেনি সে রকম একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন আরও ৫ বছরের জন্য ভাড়া করা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে আইপিপি সেলের পরিচালক জানান, এটা যারা অনুমোদন দিয়েছেন তারা ভালো বলতে পারবে। আমি মন্তব্য করতে চাই না।

 

বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।