ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

হাসিনা-খালেদার মুক্তিতে যে ভূমিকা ছিল প্রণবের

নঈম নিজাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২০
হাসিনা-খালেদার মুক্তিতে যে ভূমিকা ছিল প্রণবের নঈম নিজাম

দিল্লি। ২৪ জুলাই, ২০১৭।

ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন ছেড়ে ১০ রাজাজি রোডের নতুন বাড়িতে উঠেছেন প্রণব মুখার্জি। মাত্র তিনি সাবেক হয়েছেন। সবকিছু গোছগাছ করছেন। কর্মব্যস্ততা সবার নতুন বাড়িতে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে প্রণবের ঠিকানা ছিল গ্রেটার কৈলাস ছাড়ার পর রাজাজি রোড। এই সময় আগস্টের শুরুতে দিল্লি যাই ব্যক্তিগত কাজে। যোগাযোগ করতেই সময় দিলেন এক সন্ধ্যায়। মাত্র ১০ দিন আগে বিদায় নেওয়া রাষ্ট্রপতিকে দেখতে গেলাম। একসময় এ বাড়িতে থাকতেন এ পি জে আবদুল কালাম। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কালাম ছিলেন ১০ রাজাজি রোডের বাসিন্দা। প্রণবেরও নতুন ঠিকানা হলো এ বাড়ি। প্রণব মুখার্জির সাক্ষাতে রাষ্ট্রপতি ভবনে অনেকবার গিয়েছি। গ্রেটার কৈলাসের বাড়িতেও গিয়েছি। কলকাতার বাড়িতে যাওয়া হয়নি কখনো আমার। তিনি মন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ সফরকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে দেখা হয়েছে। ভারতীয় হাইকমিশনে কথা হয়েছে। সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি প্রণবকে পেলাম আগের চেয়ে প্রাণবন্ত। খোলামেলা আড্ডা জমানো মানুষ। আমি বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনেক পুরনো সংখ্যা নিয়ে যাই। ছিল ঈদসংখ্যাও। তিনি বললেন, ‘অনেক বই পড়ছি এখন। তোমার ঈদসংখ্যাও পড়া যাবে। ’ তিনি বই পড়তে পছন্দ করতেন। সব ধরনের বই পড়েন। পান্ডিত্য ছিল। ষাট দশকের শেষ দিকে পান্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা শুনেই ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে রাজনীতিতে টেনে আনেন। সব সময় দেখেছি গল্পে গল্পে বলেছেন, কি বই পড়ছেন। একবার পেয়েছিলাম জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ পড়ছেন। আবার গিয়ে দেখলাম সৈয়দ আবুল মকসুদের কাগমারী সম্মেলন নিয়ে লেখা বই পড়ছেন। আমার সঙ্গে গল্প করলেন কাগমারী সম্মেলন ও ভাসানী- মুজিবের রাজনীতি নিয়ে। আবুল মকসুদের বই পড়ছেন শুনে বললাম মকসুদ ভাই এসেছিলেন নাকি? জবাবে বললেন, ‘না, অন্য কেউ দিয়ে গেছে বইটি। ’

প্রণব মুখার্জির সঙ্গে শেষ দেখা গেল বছর ২০১৯ সালে। কথা বলেছেন উপমহাদেশের রাজনীতি নিয়েও। রেকর্ডারে চাপ দিতেই তিনি তাকালেন। বললেন, ‘রেকর্ড করছ?’ বললাম জি দাদা। মনে রাখা যায় না সব কথা। আমন্ত্রণ জানালাম বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আসার জন্য। বললেন, ‘আপত্তি তো নেই। কিন্তু প্রটোকলে অনেক সমস্যা। তোমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা আমাদের হাইকমিশনের মাধ্যমে আমন্ত্রণ পাঠাতে হবে। ’ বললাম, ঠিক আছে। আপনাদের হাইকমিশনের মাধ্যমে পাঠাব। তাঁর সঙ্গে যখনই কথা হতো, মনে হতো আপন কারও সঙ্গে গল্প করছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ গুণটি রয়েছে। মনে আছে, একবার দিল্লি গিয়েছিলাম একটি সেমিনারে অংশ নিতে। প্রণব মুখার্জি তখন রাষ্ট্রপতি। ফোন করলাম প্রদ্যুৎদাকে। রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক সচিব, এপিএস। তিনি অল ইন্ডিয়া যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন একসময়। প্রদ্যুৎদার সঙ্গে ফোনে কুশল বিনিময় হলো। ভালোমন্দের এক পর্যায়ে তিনি বললেন, তুমি আবার বলে বোসো না দাদার সঙ্গে দেখা করতে চাও। আমি হাসলাম। কী করে বলি এত দ্রুত সময়ে দেখা করতে চাই? বললাম, এত অল্প সময়ে তো আর সম্ভব না বুঝি। আমি মাত্র আর দুই দিন আছি। তিনি বললেন, দেখা করতে এলে ঢাকা থেকে যোগাযোগ করে আসবে। আমি বললাম, আচ্ছা দাদা, তাই করব। তবে দেইখেন যদি সম্ভব হয় এবার...। কথা বাড়ালাম না। সন্ধ্যায় ফোন পেলাম। ফোনকারী বললেন, রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বলছি। আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতির এডিসি। আগামীকাল আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট বেলা আড়াইটা...। গাড়ির নম্বর দিন। এই ছিলেন প্রণব মুখার্জি। একটি দেশের রাষ্ট্রপতি। একবার তাঁর এ গুণেরই প্রশংসা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি বলেছিলেন, ‘তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনকে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দিয়েছেন। ভারতের সাধারণ মানুষ তাঁর কাছে যেতে পারে। ’ আসলেই তাই ছিলেন। যতবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি, দেখেছি সাধারণ মানুষের ভিড়। জঙ্গিপুর, পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের অন্য কোনো প্রদেশের। আমাদের সাক্ষাতের সময় গল্প জমে গেলে পরে এডিসি বলতেন, আপনি আমাদের শিডিউল ল-ভ- করে দিলেন। হাসতাম। বলতাম, আমি শ্বশুরের দেশের লোক। এ নিয়ে প্রণবদাও বলতেন। স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির মৃত্যুর পর আবেগ নিয়ে বললেন, ‘ওঁ তো নড়াইলের মেয়ে। বাংলাদেশের প্রতি দরদ ছিল। বাংলাদেশ থেকে কেউ এলে আলাদা করে আপ্যায়ন করতেন। মনে করতেন বাপের দেশের কেউ এসেছে। ’ আমি বললাম, দাদা সেটা আপনিও করেন। বাংলাদেশের প্রতি আপনার দরদ সব সময় দেখেছি। সুখে-দুঃখে আপনি থাকেন।

রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে দেখেছি। কোনো পরিবর্তন দেখিনি। তিনি যেদিন শপথ নিলেন সেদিন দিল্লি ছিলাম। সন্ধ্যায় তাঁর গ্রেটার কৈলাসের বাড়িতে গিয়েছিলাম সাবেক সচিব মুসা সাদিক, বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান ও আমি। প্রণবপুত্র অভিজিৎ মুখার্জি আমাদের আপ্যায়ন করলেন। অভিজিৎ বললেন, রাষ্ট্রপতি ভবনে চলে যান আপনারা। বের হয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বললেন, আজ শপথ নিয়েছেন। আমাদের এখন যাওয়া ঠিক হবে না। মুসা সাদিক জোরাজুরি করলেন। তিনি গেলেন। প্রণব মুখার্জি ঠিকই সাক্ষাৎ দিয়েছেন তাঁকে। এর কিছু দিন পর আমরা সাক্ষাৎ করেছিলাম। বাংলাদেশের প্রতি তাঁর আলাদা একটা দরদ ছিল। গত বছর শেষবার দেখা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ওপর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সাক্ষাৎকারের দুটি অংশ একটি ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে প্রকাশের জন্য। আরেকটি করে রাখি মুজিববর্ষের জন্য। আমি বললাম, দাদা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী সামনের বছর। আগাম আপনার একটি সাক্ষাৎকার নেব বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। আপনি যখন জন্মশত বছরের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন তখন প্রকাশ করব। তিনি হাসলেন। প্রণববাবু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করলেন। বললেন অনেক কথা। জানালেন কীভাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকার সময় অমানুষিক নির্যাতন কীভাবে করত পাকিস্তানি সেনারা। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রথম পরিচয়েই প্রাণবন্ত গল্প। বঙ্গবন্ধু বললেন মুখার্জির বাড়ি কোথায়? আমি হাসতে হাসতে বললাম, ঘটি স্যার ঘটি। পরে নিজের বাড়ি শান্তিনিকেতন বলতেই উনি পরিষ্কার ভরাট কণ্ঠে আমাকে রবীন্দ্রনাথের দুটি কবিতা শুনিয়ে দিলেন। আমি মুগ্ধ হলাম তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ শুনে। অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। ’ প্রণববাবুর কাছে জানতে চাই বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর কীভাবে শুনলেন। বললেন, ‘সেদিন কলকাতায় ছিলাম। অফিশিয়ালভাবে খবরটি পাই। এ নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডন্ডের খবর শুনে হতচকিত ও শোকাহত হই। মনে হলো স্বজন হারিয়েছি। সেদিন আমার কাছে এটা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সংকট ছিল না। ব্যক্তিগত শোকের বিষয় ছিল। ’ মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছেন সেসব বলেছেন।

প্রণব মুখার্জি ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের বন্ধু। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এ পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বারবার। বললেন, ‘ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব এখন সারা বিশ্বে। হাসিনা সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতা দিয়েছেন। হাসিনার বিষয়ে আমি ভীষণ আশাবাদী। ’ আরেকবার বললেন, ‘মন্ত্রী থাকাকালে ঢাকা সফরে গিয়েছিলাম। হাসিনাকে আমার একটা জরুরি মেসেজ দেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু কিছুতেই সময় করতে পারছিলাম না। কারণ আমাদের আলাপচারিতার মাঝে একজন মন্ত্রী বসা ছিলেন। ভদ্রতা, শিষ্টাচারের কারণে সেই মন্ত্রীকে বলতে পারছিলাম না আপনি একটু সরুন। আমরা কথা বলব। ’ আমি বললাম, সেই মন্ত্রীটা কে দাদা? তিনি হাসলেন। বললেন, ‘তুমি আমার কাছে কেবল খবর বের কর!’ তারপর তিনি একজন পূর্ণ মন্ত্রীর নাম বললেন। এমন অনেক খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে অনেক। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে তিনি আদর করতেন। আমাকে বলতেন, ‘বাঘা তোমার কথা প্রথম বলেছে। কেমন আছে সে? তোমার কাগজে নিয়মিত লিখছে তো?’ আরেকবার আক্ষেপ করে বললেন, ‘বাঘার জন্য খারাপ লাগে। আমি বলেছিলাম বাঘাকে আওয়ামী লীগের নেওয়া উচিত। কেন নিচ্ছে না বুঝি না। ’৭৫ সালের পর বাঘাকে পেয়েছিলাম। বাঘা সে সময় প্রতিবাদ করে সাহস জুগিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের। ’৭১ সালের বাঘার কোনো তুলনা হয় না। ’ আমার সঙ্গে অনেক বিষয়ে কথা হতো। বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্নভাবে অনেক কিছু বলেছেন। শেখ হাসিনা ও রেহানার প্রশংসা করতেন অনেক আবেগ নিয়ে। একবার শেখ রেহানার অনেক প্রশংসা করেন। বললেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের পর রেহানাকে বলেছি, হাসিনা জেলে। তুমি আপাতত দলের দায়িত্ব নাও। রেহানা বলল দাদা, রাজনীতি বড় আপার। আপনি বুবুকে মুক্ত করুন। আপনি ১৫ আগস্টের পর আমাদের পরিবারের পাশে ছিলেন। এখনো আছেন। ’ তিনি বললেন, রেহানা ভীষণ ভালোবাসে বোনকে। আমার ভালো লাগে দুই বোনের এ মায়ার বন্ধন। বোনেরা এমনই হয়। আবদুল জলিলের মুক্তি নিয়ে কথা বললেন। বললেন, ‘জলিলকে কারাগারে নিল মইনের সরকার। জলিলের স্ত্রী এসে ভীষণ কান্নাকাটি করল। কলকাতা থেকে এলো আমার আরেক ঘনিষ্ঠজনকে নিয়ে। মইন আমার কাছে দেখা করতে এলে তাকে বলেছি ঢাকা গিয়ে জলিলকে ছেড়ে দিতে। ’ ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে তিনি অনেক কথা খোলামেলাভাবে নিজের বইতেও লিখেছেন। আত্মজীবনী ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২’ বইতে বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক অজানা অধ্যায় রয়েছে। সেসব অধ্যায় নিয়েও তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল ক্ষমতা ছাড়ার পর। তিনি বললেন, ‘আত্মজীবনীতে অনেক কিছু লিখেছি। আবার অনেক কিছু বাদও পড়েছে। সবকিছু মনে রাখা, পুরনো নোট খুঁজে বের করা কঠিন। ’ প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘আমি খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়ের মুক্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সাক্ষাৎ চাই। ভারতের তৎকালীন জাতীয় উপদেষ্টা এম কে নারায়ণনের মাধ্যমে আমার হস্তক্ষেপে সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি ও দেশটির স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছিলাম। ’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা আমার ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করে ভারত তার দাবি পূরণে সহায়তা করার চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনা কারাগারে থাকাকালে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা তাঁকে ত্যাগ করলে আমি তাঁদের ভর্ৎসনা করি। বলি, কেউ যখন এমন বিপদে থাকে, তখন তাঁকে ত্যাগ করা অনৈতিক। ’ ২০০৮ সালে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হয়। শেখ হাসিনা বিপুল বিজয় পান। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ ছয় দিনের ভারত সফরে যান। মইন সাক্ষাৎ করেন প্রণব মুখার্জি, ভারতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, গোয়েন্দা সংস্থা র-এর প্রধানসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। সেই সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘তাকে বন্দীদের মুক্তির গুরুত্ব বোঝাই। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন শেখ হাসিনা বেরিয়ে এলে তাকে চাকরিচ্যুত করতে পারেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব নিই। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তাকে বহাল রাখার বিষয়ে আশ্বস্ত করি। ’

এ বই এবং বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছিলাম প্রণব মুখার্জির সঙ্গে। বাদ পড়েনি তাঁর সঙ্গে সময় নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের সাক্ষাৎ না করার শিষ্টাচারবহির্ভূত কান্ড নিয়েও। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে আমি ঢাকা সফর করেছি দুবার। কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান যোগাযোগ রাখতেন। ঢাকা সফরকালে রাষ্ট্রপতি জিয়া দুবারই আমার সম্মানে ডিনার দেন। সে সময় খালেদা জিয়া তাঁর পাশে ছিলেন। ’ তিনি খালেদ মোশাররফের প্রশংসা করেন। বলেছেন, ‘৭ নভেম্বর হত্যাকান্ড আমাকে ব্যথিত করেছে। খালেদের সঙ্গে ভারতকে জড়িয়ে মিথ্যাচারের কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না। মাঝে মাঝে এমন প্রচারণা নিষ্ঠুর অধ্যায়ের রচনা করে। সম্পর্কে বৈরিতা তৈরি করে একে অপরের। ’ প্রণব মুখার্জি পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফের প্রশংসা করেন আমার কাছে। বললেন, ‘পাকিস্তানের রাজনীতির ইতিহাস বড় করুণ। দেশটির নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রীই তাঁদের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। ’ তিনি স্মৃতিচারণা করেন বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার রাজনীতির অন্দরমহল নিয়ে। বললেন, নওয়াজ ও বেনজির সব সময় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। একবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে থাকার সময় ফোন করেন নওয়াজ। শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে ডাক্তার কোনোভাবেই ফোন দিতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘আমি বললাম, না না, ফোন দাও। ওঁ খোঁজ নিচ্ছে। ’ ফোন করেই শরীরের খবর নিলেন নওয়াজ। তারপর বললেন, ‘আমি আপনার জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করছি। ’ তিনি বলেন, ‘নওয়াজ শরিফকে যেভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা দুঃখজনক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত না হতে পারলে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে। ’ তিনি বেনজিরের মৃত্যুর খবরে কষ্ট পান। বললেন, ‘নিষ্ঠুরভাবে বেনজিরকে হত্যা করা হয়। শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নিতে চেয়েছিলাম। পারভেজ মোশাররফ অ্যালাউ করেননি। আমি আবার তাগাদা দিলে বলা হলো, কোনো বিদেশিকে অ্যালাউ করা হবে না। ’ আমি বললাম, দাদা, বেনজির ভুট্টোর আত্মজীবনী পড়েছেন কি? বললেন, ‘অবশ্যই পড়েছি। ’ এবার বললাম ফাতিমা ভুট্টোর লেখা? হাসলেন, ‘পড়েছি। ’ তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘পাকিস্তানের একসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার আসিফ আহমেদ আলীর একটি কথা শোনাই। আসিফ আমাকে বলেছেন পাকিস্তানে এখনো সামন্তবাদী প্রথা চালু আছে। সেখানে এখনো কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তি গেলে সাধারণ মানুষকে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়। এটা কোনো সভ্য সমাজের রীতিনীতি হতে পারে না। ’ তিনি শ্রীলঙ্কা, নেপাল নিয়েও কথা বললেন। শেষ সাক্ষাৎকারে আমি বললাম, রাষ্ট্রপতি ভবনের চেয়ে আপনি এ বাড়িতে অনেক বেশি প্রাণবন্ত। জবাবে হাসলেন। ‘তুমি জানো তো আমি আসার আগে এ বাড়িতে এ পি জে আবদুল কালাম থাকতেন। এখানে হাঁটাচলা করা যাবে। ’  শেষবার বিদায়ের আগে আমি বললাম, বাংলাদেশের মানুষ আপনাকে ভালোবাসে। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে আমিও ভালোবাসি। ’

লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলাদেশ সময়: ০৯২১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।