ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

নতুন বিশ্ব মেরুকরণের আভাস!

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০১১
নতুন বিশ্ব মেরুকরণের আভাস!

চীন সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আমেরিকা কিংবা ইসরাইল কোনভাবে ইরানে হামলা চালালে  তারা চুপচাপ বসে থাকবে না। ইরানের পাশে দাঁড়াবে।

এরজন্য যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধেও যায় তবুও পিছু হবে না।

সোভিয়েত ইউনিয়নের রাশিয়ার পতনের পরে এক শক্তির বিশ্বে চরম নৈরাজ্য তৈরি রেখেছে আমেরিকা এবং তার মিত্ররা। কয়েক দশক পরে সম্ভবতঃ এই প্রথম আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লো (আসলেই কি?)। এদিকে তালেবান দমনের নামে বেশ কিছুদিন পর পর আমেরিকা পাকিস্তানি সৈন্য মারছে।

সম্প্রতি বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্যের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আমেরিকার সাথে তাদের মনোমালিন্য চলছে। বিশ্বের একমাত্র ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের দেশ আমেরিকা এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনাতো দূরের কথা, পাকিস্তানের চাপে শেষমেষ নামকা ওয়াস্তে দুঃখ প্রকাশ করেছে। তাও প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত দুঃখ প্রকাশ। ইরানতো অনেক আগে থেকেই আমেরিকা এবং ইসরায়েলি রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে হুমকির বিরুদ্ধে পাল্টা হুমকি দিয়েই চলেছে।
 
সেদিন ইরান দাবি করে বসলো তারা আমেরিকার একটি ড্রোন বিমান ভূপাতিত করেছে। আমেরিকার ‘হারিয়ে যাওয়া বিমান’ তত্ত্বের আড়ালে চর লুকানোর ভঙ্গিমায় ইরানের দাবিকে যথার্থ বলেই মনে হয়। তেহরানে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের দূতাবাস ভাংচুরের ঘটনা, পাকিস্তানি সৈন্যহত্যার দৃঢ় প্রতিবাদ এবং  ইরানের পাশে চীনের প্রকাশ্যে দাঁড়ানোর শপথ বিশ্বে বহুদিন পরে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নতুন শক্তির উত্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সারাবিশ্বকে আমেরিকা ভয় দেখিয়ে এমনভাবে হিপনোটাইজ করে রেখেছে যে, তাদের আবেগকেই বাকী বিশ্বকে বরণ করে নিতে হয়। তারা কাঁদলে আমাদের কাঁদতে হয়, তারা হাসলে আমাদের হাসতে হয় । আমাদের কান্না পেলে স্বাভাবিক কান্নাটাও কাঁদতে পারি না আগ্রাসনের ভয়ে। সে কারণেই ইসরায়েলি হামলায় শত শত ফিলিস্তিনী মারা পড়লেও বলতে হয়, ওরা সন্ত্রাসী। আর আসল সন্ত্রাসীকে বাঁচাতে বলতে বাধ্য হই, ওরাতো আত্মরক্ষার জন্য এমনটি করেছে। আফগানিস্তান, ইরাকে শত শত শিশুর বিকৃত লাশ দেখেও কান্না লুকাতে হয়। খুনিদের লোক দেখানো দু`একটা দুঃখ প্রকাশে সব কিছু ভুলে যেতে বাধ্য হই। ৯/১১ এ টুইন টাওয়ার হত্যাকাণ্ড অবশ্যই একটা ঘৃণ্য কাজ, কোনও সন্দেহ নেই। প্রতি বছর এই দিনটি পালন করা হয় সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু এই আমেরিকার নেতৃত্বে আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন এবং বাকী বিশ্বে প্রতি বছর যে নৃশংসভাবে টুইন টাওয়ারের চেয়েও বেশী হত্যাকাণ্ড, বেশি নৃশংসতা ঘটে চলেছে সেটা নিয়ে কোনো কথা নেই। শক্তিহীন, দুর্বলের মৃত্যু নিয়ে প্রতি বছর কোন শোক পালনের প্রস্তুতি থাকে না। আমেরিকা এভাবেই সারা বিশ্বকে ভয় দিয়ে স্তব্ধ করে রেখেছে, ট্রমাটাইজড করে ফেলেছে। এই ভয় কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে বাকী বিশ্বকে। বিশ্ব মানেই আমেরিকা কিংবা তার মিত্ররা নয়। বিশ্ব মানে আমি, তুমি, সে এবং সবাই।

প্রবাদ আছে, কাউকে পানিতে নামাতে হলে নিজের কোমরও ভেজাতে হয়। আমেরিকা বিশ্বে যেভাবে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে তাতে সে নিজের জালে নিজেই আটকে গিয়েছে। সারা দেশে দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। সেই মন্দার চাপ কাটিয়ে উঠতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। চীন বেশ ভাল করেই বুঝে গিয়েছে এই দুর্বলতার সুযোগে আমেরিকাকে রুখে দিতে হবে। আমেরিকার অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে হয়তো তারা আরো দুচারটা ছোটখাট যুদ্ধ চালিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু চীনের মতো সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী দেশের নেতৃত্বে বড় ধরনের যুদ্ধের ঝুঁকি নেবার মতো সাহস এবং সামর্থ্য কি আমেরিকার আছে?
 
বিশ্বে একমাত্র পরাশক্তি হবার বদৌলতে তথাকথিত শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে আমেরিকা এবং তার দোসরেরা সারা বিশ্বে একের পর এক যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে চলেছে। কেউ নেই তাদের থামানোর। এই পরিস্থিতিতে চীনের নেতৃত্বে যদি বিকল্প বিশ্বশক্তির উদ্ভব ঘটে তবে বিশ্ববাসী আমেরিকার থাবা থেকে হয়তো মুক্তির একটা আশা গুনবে।

এখনো আশ্বান্বিত হবার মতো তেমন ঘটনা ঘটেনি। কারণ আজ পর্যন্ত চীনের বন্ধুত্ব পরীক্ষিত নয়। আমেরিকা যেমন তার মিত্রদের বিপদে ন্যায় অন্যায় উভয় প্রক্রিয়ায় গোঁয়াড়ের মতো এগিয়ে যায়, চীন সে রকম কোন দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেনি। কাজেই বিপদের সময়ে চীন আসলেই কতোটুকু এগিয়ে আসবে প্রমাণের আগে সন্দেহ থেকেই যায়। আর যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়েই যায়, চীন একা ইরান, পাকিস্তান এবং বড়জোড় উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে আমেরিকার মিত্রদের আগ্রাসন কতোটুকু মোকাবিলা করতে পারবে? যেখানে ঘরের কাছে ভারতের সাথে পেরে উঠতেও হিমশিম খেতে হয় তাদের। আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা খবরে এসেও ডালপালা না মেলে মিলিয়ে গেছে। রাশিয়া নাকি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে যাওয়া রাজ্যগুলোর সংগে একটা জোট করতে যাচ্ছে। এটার উদ্দেশ্য কি শুধুই অর্থনৈতিক নাকি সামরিক উদ্দেশ্যও আছে? চীনের হঠাৎ করে আমেরিকার সাথে যুদ্ধের সুরে কথা বলা আর ভেঙ্গে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজ্যগুলোর মধ্যে জোট গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে কি কোনও সম্পর্ক আছে তবে? রাশিয়া কি চীনকে সাথে নিয়ে নিজেদের কমন শত্রু আমেরিকাকে রুখতে পুরানো বিবাদ ভুলে গিয়ে বন্ধুত্বের দিকে যাত্রা শুরু করতে চাইছে? কোনও কিছুই এখনো স্পষ্ট নয়।

অন্যদিকে, পাকিস্তান এখনো গোপনে গোপনে চরমপন্থী দলগুলোকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের পক্ষে বিশ্বমত কতোটুকু যাবে সেটা ভাবার বিষয়। উপরন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বাজেটের সিংহভাগ আমেরিকার সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। তাদের অর্থনীতি এখনো অতটুকু বলবান নয় যতোটুকু দিয়ে দেশ চালানো যায়। বিকল্প অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা না করে পাকিস্তান কি পারবে আমেরিকাকে গুড বাই জানাতে! তাছাড়া পাকিস্তানের এই পিঠটান কতোটুকু আত্মমর্যাদার কারণে আর কতোটুকু মুখ বাঁচানো, পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা কে বলতে পারে।   পাকিস্তানি সৈন্যদের একটার পর একটা হত্যাকান্ডের ঘটনায় জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য এই আপাত মার্কিন বিরোধিতা কিনা কে জানে! তাছাড়া হতে পারে এটা একটা কৌশল। সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করে আমেরিকার কাছ থেকে আবারো মোটা দাগের টাকা কামানোর।

এখন যেহেতু আমেরিকার টার্গেট শুধুই ইরান, সেক্ষেত্রে তাদের কোনও সুযোগ নেই। আমেরিকা যদি আক্রমণ করেই বসে তবে কেউ পাশে থাকুক আর নাই থাকুক তাদেরকে একা লড়ে যেতেই হবে।

তবে ইরানের হুমকি ধমকিতে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন কিংবা অধুনা পশ্চিমা মদদপুষ্টদের সহায়তায় নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার লিবিয়ার গাদ্দাফির কথা মনে পড়ে যায়। লড়াই বাঁধার আগে কিংবা প্রথম দিকে তাদেরও একই সুর ছিল, আমেরিকাকে উড়িয়ে দেবার। আখেরে নিজেরা উড়ে গিয়ে প্রমাণ করেছিল যে, যতো গর্জে ততো বর্ষে না। ইরানের বেলায় সেটা সত্য না হোক সেটাই চাই। কারণ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমেরিকা এবং তার বন্ধুদের আগ্রাসী অগ্রযাত্রা বন্ধ না করে কোনও উপায় নেই।

বাংলাদেশ সময় ১৪৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।