ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা: কয়েকটি প্রাসঙ্গিক দিক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৭
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা: কয়েকটি প্রাসঙ্গিক দিক মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় উল্লাস।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিঃসন্দেহে বাঙালি জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ও প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা। এ যুদ্ধের যেমন একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে, তেমনি রয়েছে যুদ্ধ-পরবর্তী প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ান।

কিন্তু স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও জনগণের মধ্যে এ বিষয়ে রয়ে গেছে অনেক বিভ্রান্তি। এসব বিভ্রান্তির জন্ম হয়েছে প্রধানত দুই সামরিক শাসকের আমলে।

আর এ কারণে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশের নাগরিকরা মুক্তিযুদ্ধকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়ন করতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। এই শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিষয়টি বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণও বটে। সে হিসেবে কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।

ক. ইতিহাসের কাল বিভাজন
আমাদের প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকে বাংলাদেশের ইতিহাসের কাল বিভাগ করা হিন্দু আমল, মুসলিম আমল, ইংরেজ আমল, পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ আমল হিসেবে। কিন্তু আমরা সবাই জানি, হিন্দু আমলের পর ভারতবর্ষ- বাংলাদেশে পাল শাসনামল ছিল এবং পালরা ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। অন্যদিকে ইংরেজরা ছিল খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী। সে বিবেচনায় ইংরেজ আমলকে ‘খ্রিস্টীয় আমল’ আখ্যা দিতে হয়। বস্তুত ইতিহাসের এই প্রচলিত কাল বিভাজনের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এ ধরনের কাল বিভাজন প্রচলিত নয়। আফ্রিকার ক্ষেত্রে Irving Leonard Markovitz তার  Power and Class in Africa - An Introduction to Change and Conflict in African Politics (1977) গ্রন্থে কাল বিভাজন করেছেন ঔপনিবেশ-পূর্ব যুগ, ঔপনিবেশিক যুগ ও উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগ হিসেবে। বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিকতাকে কোনো সময়ই কেন্দ্রীয় থিম হিসেবে গণ্য করা হয়নি।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এ ধরনের কাল বিভাজন করলে সঠিক ডিসকোর্সটি খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইংরেজ ও পাকিস্তান আমল মিলে আখ্যায়িত হবে ঔপনিবেশিক আমল হিসেবে। এই দুই ঔপনিবেশিক আমলে কীভাবে বাংলার জনগণ শোষিত হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে এবং এসবের বিরুদ্ধে তারা সংগ্রাম করেছে; স্বাধীনতার দাবিতে লড়াই করেছে এবং সর্বপরি বাঙালিরা একটি জাতি-রাষ্ট্র গঠন করেছে - এসব তখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসবে।

খ. কথ্য ইতিহাস রীতির অনুশীলন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বলা হয় ‘জনযুদ্ধ’। এখানে প্রচলিত যুদ্ধের (Conventional War) পাশাপাশি গেরিলা পদ্ধতির প্রয়োগ ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে যেমন যুদ্ধ হয়েছে, তেমনি হয়েছে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন নামের বাহিনীর প্রতিরোধ প্রচেষ্টা। দেশের অল্পসংখ্যক মানুষ ছাড়া সবাই সে সময় কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। অথচ দুঃখের বিষয় এই যে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অধিকাংশ বইপত্রে সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক ও নারীসমাজ ভীষণভাবে উপেক্ষিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মনজুর প্রমুখ ইতিহাস অনুসন্ধানের একটি নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু করেছেন। এটি হলো Oral History বা কথ্য ইতিহাস।

কথ্য ইতিহাস হলো- একটি সুনির্দিষ্ট সময়কালে, নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক পরিমণ্ডলে ঘটে যাওয়া সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং প্রত্যক্ষদর্শী মানুষ প্রদত্ত বিবরণের ভিত্তিতে ইতিহাস রচনার প্রক্রিয়া। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘এ কথা অনস্বীকার্য যে, পত্রপত্রিকায় সমকালীন ঘটনাবলীর প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে। এজন্য এটি  ইতিহাসের অন্যতম উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ হিসেবে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিষয়াবলীর বিশুদ্ধতা প্রশ্নসাপেক্ষ। এর পর্যাপ্ত কারণ বিদ্যমান, যা সমাজ সচেতন মানুষের কাছে সহজেই অনুমেয়। ইতিহাসের বিভিন্ন উৎসের বিশ্লেষণে এভাবে আমাদের কাছে সমকালীন ইতিহাসের দুষ্প্রাপ্যতা ও এর অব্যাহত সংকটের চিত্রটিই প্রকট হয়ে ওঠে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসের উপাদান সংরক্ষণের জন্য মৌখিক তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা তর্কাতীতভাবে প্রতিপন্ন হয়। ’

এই কথ্য রীতি অনুসরণ করে আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় এবং আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় মনোনিবেশ করতে পারি। কৃষক, শ্রমিক, নারী ছাড়াও আমরা আরো যেসব বিষয়ে এই রীতির প্রয়োগ করতে পারি সেগুলো হলো - স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, রাজাকার-আলবদর ও শান্তি কমিটির সদস্যদের তালিকা প্রণয়ন, বধ্যভূমির স্থান চিহ্নিতকরণ, গণকবরের স্থান চিহ্নিতকরণ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ওপর যুদ্ধের আর্থ-সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি।

গ. প্রাত্যহিক জীবনে ইতিহাসবোধ
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- প্রাত্যহিক জীবনে ইতিহাসবোধ তৈরির বিষয়টি। ‘মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা - এটি শুধু মুখের কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এটিকে জীবনযাপনের অংশ হিসেবে গ্রহণ না করা পর্যন্ত আমাদের জাতীয় সংকটগুলো দূর হবে না। ’

এই উপলব্ধিকে সম্প্রসারিত করে বলা যায়, বাংলাদেশে রাষ্ট্র নির্মাণ ও জাতি নির্মাণ উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্রীয় অবস্থানে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন জনগণের সক্রিয়তা। যারাই মুক্তিযুদ্ধকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে চান তাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এই ব্যাপক প্র্যাকটিসের মধ্যে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তি সমাজে এখনো ক্রিয়াশীল - তারা যেমন তাদের কৃত অপকর্মের (গণহত্যা, নারী নির্যাতন ইত্যাদি) জন্য এখনো ক্ষমা চায়নি তেমনি তারা এখনো প্রকাশ্যে রাজনীতি করে যাচ্ছে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবারের ন্যায়সঙ্গত বিচারের দাবিসমূহ, অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরের অবাধ তৎপরতা - এই বৈপরিত্যের মধ্যে আজ বাংলাদেশ অবস্থান করছে। এই অসহনীয় পরিস্থিতির অবসান হতে পারে কেবল নতুন নতুন প্রজন্মের মধ্যে ক্রমাগত ও প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবোধের বীজ বপন করার মাধ্যমে - যা পরিণামে তাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে উঠবে।

এ কে এম রিয়াজুল হাসানলেখক: প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান, অধ্যক্ষ, শেরপুর সরকারি কলেজ, শেরপুর।

 

 

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।