ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

নব্য-নাৎসিবাদের পদধ্বনি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৭
নব্য-নাৎসিবাদের পদধ্বনি ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটিতে বর্ণবাদীদের মশাল মিছিল।

‘জাতীয় সমাজতন্ত্র’ বা ‘নাৎসিবাদ’ একটি রাজনৈতিক মতবাদ, যা বিংশশতকের প্রথমার্ধে জার্মানিতে উদ্ভূত নাৎসি পাটি সম্পর্কিত। এই মতবাদকে সাধারণত এক ধরনের ফ্যাসিবাদ বলে চিহ্নিত করা হয়, যার মধ্যে বৈজ্ঞানিক-কৌলিন্যবাদ (সায়েন্টিফিক রেসিজম), এন্টিসেমিটিজম) অন্তর্ভুক্ত।

এডলফ হিটলারকে নাৎসিবাদের প্রবক্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পূর্ব পর্যন্ত এটা জার্মানির রাষ্ট্রীয় মতবাদ ছিল।

জার্মানির ইতিহাসে এ সময়টাকে নাৎসি জার্মানি হিসেবে অভিহিত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসিবাদ পরাজিত হলেও কোথাও কোথাও নব্য-নাৎসিদের উত্থান দেখা গেছে। সম্প্রতি দেখে গেল আমেরিকায়।

মুখে নাৎসি স্লোগান আর হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে তীব্র উত্তেজনাকর মিছিল গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সঙ্গে খুবই বেমানান। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্বেতাঙ্গ ছাত্রদের মিছিল ঘিরে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল।   প্রতিবাদী অন্য এক দল ছাত্রের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ বিক্ষোভকারীদের মুখোমুখি সংঘর্ষেরও ঘটনা ঘটল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। চলে ইটপাথর ও লঙ্কার গুঁড়ো ছোড়াছুড়ি। শ্বেতাঙ্গ ছাত্র বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল, আমেরিকার অভিবাসন নীতি আমূল বদলাতে হবে। অভিবাসীদের অবিলম্বে আমেরিকা ছেড়ে চলে যেতে বলতে হবে। বিক্ষোভকারীদের মুখে ছিল ‘ব্লাড অ্যান্ড সয়েল’ স্লোগান। দেশপ্রেমের গভীরতা বোঝাতে নাৎসিরা যে স্লোগান দিত।

নাৎসিবাদের নতুন উত্থানের সময় পুরনো ইতিহাসটুকু এক বার দেখে নেওয়া যেতে পারে। নাৎসিবাদ হচ্ছে হিটলার ও তার দল নাৎসি পার্টি কর্তৃক শাসনব্যবস্থা। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন প্রার্থী হয়ে হিনডেনবার্গের কাছে হিটলার পরাজিত হন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে হিনডেনবার্গ হিটলারকে তাঁর প্রধানমন্ত্রী (চ্যান্সেলার) নিযুক্ত করেন। কিছুদিনের মধ্যেই হিটলার সকল ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে দেশে নাৎসি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

ক্রমে জার্মানিতে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে হিটলার ও তার নাৎসিদল জার্মানির শাসক দলের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। ধীরে ধীরে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের গ্রেফতার, অপহরণ, নির্বাসন ও গোপন হত্যার মাধ্যমে জার্মানির কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের নির্মম ভাবে দমন করে হিটলার তাঁর নাৎসি দলের সাহায্যে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা দখল করে নেন। অতঃপর নাৎসি পার্টি জার্মানিতে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং হিটলার এই সংকটময় পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদি স্বৈরাতান্ত্রিক নাৎসি শাসনব্যবস্থা চালু করেন। এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থান ঘটে।

ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটিতে র্ণবাদীদের মশাল মিছিল।  নাৎসি জার্মানি এবং তৃতীয় রাইখ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সময়ে জার্মানির প্রচলিত নাম। এই সময়কালে জার্মান সরকার একটিমাত্র রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি বা নাৎসি পার্টির অধীনে ছিল, যার কেন্দ্রে ফিউরার হিসেবে ছিলেন আডলফ হিটলার। হিটলারের অধীনে জার্মানি একটি আধিপত্যবাদী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় তৃতীয় রাইখের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এ সকল প্রতিষ্ঠান তাদের মানবতাবিরোধী ভূমিকার জন্য দেশে ও বিদেশে অত্যন্ত বিতর্কিত হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের মে মাসে ইউরোপ মহাদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয় এবং একই সাথে জার্মানিতে নাৎসি শাসনের অবসান ঘটে।

ভাইমার প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি পল ভন হিনডেনবার্গ ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি হিটলারকে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেন। এর পরপরই নাৎসি পার্টি তার সকল বিরোধীপক্ষকে একে একে নির্মূল করা শুরু করে এবং ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ পায়। ১৯৩৪ সালের ২ আগস্ট হিনডেনবার্গ মৃত্যুবরণ করলে রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের ক্ষমতা একত্রিত করা হয় এবং তার ফলস্বরূপ হিটলার জার্মানির একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে আবির্ভূত হন।

১৯৩৪ সালের ১৯ আগস্ট এক গণভোটের মাধ্যমে হিটলার জার্মানির একমাত্র আইনগত ফিউরার (নেতা) নির্বাচিত হন। হিটলার রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন এবং তার মুখের কথাই আইন হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। তৎকালীন জার্মান সরকার কোন সমন্বিত ও সুসংগঠিত কাঠামো ছিল না বরং তা ছিল হিটলারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার মাত্র। বৈশ্বিক মহামন্দার সময়ে হিটলার মিশ্র অর্থনীতির প্রচলন করে আর্থিক সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে সমর্থ হন এবং সামরিক ব্যয় বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। হাইওয়ে নির্মাণসহ অন্যান্য জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ নেন। এসব অর্থনৈতিক সাফল্য নাৎসি পার্টির জনপ্রিয়তা বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।

বর্ণবাদ, বিশেষ করে জাতি বিদ্বেষ ছিল নাৎসি পার্টির শাসনামলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জার্মান জনগণ নর্ডিক জাতি হিসেবে পরিচিতিপ্রাপ্ত হয় এবং নিজেদের আর্য জাতির বিশুদ্ধ উত্তরসূরি হিসেবে মনে করা শুরু করে। তারা একসময় প্রভুত্বকারী জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেওয়া শুরু করে। ইহুদি এবং অন্যান্য সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর ব্যক্তিবর্গকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। তাদের বেশিরভাগই অত্যাচার, নিপীড়ন বা হত্যার শিকার হন। হিটলারবিরোধী সকল শক্তিকে দমন করা হয়। উদারপন্থি, সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট বিরোধী দলের সদস্যদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়, বন্দি করা হয়, নয়তো দেশান্তরি হতে বাধ্য করা হয়।

এমনকি চার্চগুলোও নাৎসি পার্টির কড়া নজর থেকে রেহাই পায়নি। বহু ধর্মীয় নেতাকে অবৈধভাবে বন্দি করা হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বর্ণবাদী জীববিজ্ঞান, জনসংখ্যা নীতি ও সামরিক বাহিনীতে ভর্তির যোগ্যতা ইত্যাদি বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়। নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত করা হয়। এমনকি বিনোদন ও পর্যটনের মত সুযোগসুবিধাও সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হত।

হিটলারের জ্বালাময়ী ভাষণ, বিশাল বিশাল মিছিল আর প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলসের চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে সুকৌশলে জনগণের মতামত নিয়ন্ত্রণ করা হত। সরকার চিত্রকলায় বিশেষ কয়েকটি ধারা অনুশীলনে উৎসাহ প্রদান করে এবং অন্যান্য ধারাগুলোকে অনুৎসাহিত করা হয়, কোন কোন ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটিতে র্ণবাদীদের মশাল মিছিল।  নাৎসি জার্মানি তাদের জন্য অতিরিক্ত এলাকা দাবি করে এবং যুদ্ধের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকা দখল করে নেওয়ার হুমকি দেওয়া শুরু করে। ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে দেশটি অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে।

স্তালিনের সাথে হিটলার একটি সমঝোতা চুক্তি সাক্ষর করেন এবং ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পোল্যান্ড আক্রমণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত করেন। ইতালি ও অন্যান্য সহযোগী শক্তির সহায়তায় ১৯৪০ সালের মধ্যে জার্মানি ইউরোপের বেশিরভাগ এলাকা দখল করে ফেলে। বেশিরভাগ দেশে নামেমাত্র সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যান্য সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর ব্যক্তিবর্গকে বিভিন্ন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি করা হয়। পরবর্তীতে এসব হতভাগ্যদের জার্মান গণহত্যার শিকার হতে হয় যা ইতিহাসে হলোকস্ট নামে পরিচিত।

১৯৪১ সালে নাৎসি জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ১৯৪৩ সালের পর বড় বড় যুদ্ধে জার্মান বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ১৯৪৪-এ জার্মানির শহর, রেললাইন ও তেলক্ষেত্রগুলো ব্যাপক বোমাবর্ষণের শিকার হয়। ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত বাহিনী জার্মানির পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমা মিত্রবাহিনী জার্মানির পশ্চিমাঞ্চল দখল করে। হিটলার তবু আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে দেশটির অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটে। যুদ্ধ শেষে যুদ্ধাপরাধের দায়ে নাৎসি জার্মানির অধিকাংশ নেতৃবৃন্দকে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এভাবেই নাৎসিবাদের মতো একটি উগ্র রাজনৈতিক মতবাদের পতন ঘটে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে নতুনভাবে নাৎসি মনোভাবাপন্নদের প্রকাশ্য তৎপরতা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের কারণ। এর ফলে অভিবাসী, বিদেশি, অশ্বেতাঙ্গরা চরম ভীতি ও সঙ্কট কবলিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ‘‘আমেরিকায় গত কয়েক দশকের মধ্যে এত বড় জাতিবিদ্বেষী মিছিল হয়নি। ’’ তারা জানাচ্ছেন, জ্বলন্ত মশাল হাতে নিয়ে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ঘুরে বেড়ান শ্বেতাঙ্গ ছাত্র বিক্ষোভকারীরা। তারা স্লোগান দিতে থাকেন, ‘একটি জাতি, একটি দেশ, অবসান ঘটুক অভিবাসনের’।

যদিও শ্বেতাঙ্গ ছাত্রদের ওই জাতিবিদ্বেষী মিছিলের কড়া সমালোচনা করেছেন শার্লটসভিলের মেয়র মাইক সিঙ্গার, তথাপি নব্য-নাৎসিবাদের পদধ্বনি শুনতে পাওয়াটাও কম ভয়ের বিষয় নয়!

ড. মাহফুজ পারভেজ, কবি-গল্পকার-গবেষক। অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।