ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

পাহাড়ে শান্তি আসবে কবে?

আদিত্য আরাফাত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১১
পাহাড়ে শান্তি আসবে কবে?

শান্তিচুক্তির এক যুগ পার হলেও শান্তি আসেনি পাহাড়ে। আদিবাসী পাহাড়ি ও পুনর্বাসিত বাঙালিরা পারস্পরিক বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ।

গত ১০ বছরে পাহাড়ে বিবদমান দু’টি গ্রুপের মাঝে প্রায় ১৯০টি সংঘর্ষ ঘটে। এসব সংঘর্ষে ৪৫০ পাহাড়ি-বাঙালি প্রাণ হারান। অপহৃত হন সাড়ে আট শতাধিক। হাজারো ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এ নিয়ে পাহাড়িরা ভবিষ্যতে আরো বড় ধরণের সংঘাতের আশঙ্কা করছেন ।

এদিকে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন পাহাড়িরা। তারা বলছেন, শান্তিচুক্তির পর এ পর্যন্ত পাহাড়ের সংঘর্ষগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে শান্তির অন্বেষায় ১৩ বছর আগে সশস্ত্র আন্দোলন বন্ধ হলেও শান্তি আসেনি পাহাড়ে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও তার পরবর্তীকালে পাহাড়ের নানা ঘটনা প্রবাহকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।

পিছনে ফিরে দেখা
পার্বত্যবাসীর পক্ষে জনসংহতি সমিতি এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ এ। চুক্তিটি চারটি ভাগে বিভক্ত: (ক) সাধারণ, (খ) পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদসমূহ, (গ) পাবর্ত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও (ঘ) পুনর্বাসন, সাধারণ ক্ষমা এবং অন্যান্য বিষয়।

চুক্তিটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য- পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া। চুক্তির ফলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ’-এর জন্ম হয়। এর মাধ্যমে জেলা পরিষদগুলোকে শক্তিশালী করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি চুক্তির আরেক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পাহাড়ে শান্তির ধারা ফিরিয়ে আনতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, উদ্বাস্তুদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব চুক্তিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দেশের অধিক সংখ্যক মানুষের সমর্থন পায়। পশ্চিমা কূটনীতিকরা একে ‘একটি বিরাট সাফল্য’ (ইত্তেফাক ৪ ডিসেম্বর ১৯৯৭) বলে অভিহিত করেন। ‘শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ না হলেও গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে বলে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট মন্তব্য করে। তবে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে। চুক্তি হবার আগেই ‘শান্তিচুক্তি হইলে হরতাল ছাড়াও কঠিন কর্মসূচি দিব’ (ইত্তেফাক ১৬ নভেম্বর ১৯৯৭) বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এই হুঁশিয়ারির পথ ধরেই ৭ ডিসেম্বর (১৯৯৭) বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ৭টি সমমনা দল পাবর্ত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রতিবাদে সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে। ৩ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া চুক্তি গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় ২৮ দফা যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘এই-চুক্তির মাধ্যমে এই সরকার বাংলাদেশের এক দশমাংশ অঞ্চল থেকে স্বাধীন সার্বভৌম এককেন্দ্রিক ক্ষমতা প্রত্যাহার করে দেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়েছে এবং স্বাধীনতার সংকট সৃষ্টি করেছে। ’

বর্তমানে পার্বত্য এলাকায় বাস করছে প্রায় ৩০ হাজার পরিবার। দেশের বিভিন্ন স্থানের নদীভাঙা পরিবারসহ ছিন্নমূল লোকজনকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়ার জন্য তৎকালীন সরকার ১৯৮২-৮৩ সালে ২৬ হাজার ২২০ পরিবারকে চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় নিয়ে আসে। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি পরিবারকে খাগড়াছড়িতে পুনর্বাসন করা হয়। অবশিষ্ট পরিবারগুলোকে রাঙামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায় বাসস্থান করে দেওয়া হয়। বসতঘর ও ক্ষেতখামার করার জন্য সরকার তাদের প্রত্যেককে পাঁচ একর করে জায়গা বরাদ্দ দেয়। ফলে পাহাড়ি জমি দখল-বেদখল নিয়ে পাহাড়িদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৯৮৬ সাল থেকে ‘শান্তি বাহিনী’র হামলার ঘটনা বাড়তে থাকলে সেখান থেকে লোকজন নিরাপদে সরে যেতে থাকে। প্রায় ১০ হাজার উপজাতীয় পরিবার সে সময় ভারতে চলে যায়।

অন্যদিকে ২৬ হাজার পুনর্বাসিত বাঙালি পরিবারের সদস্যরা জীবন বাঁচাতে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন সেনাক্যাম্প সংলগ্ন ৮১টি গুচ্ছগ্রামে অবস্থান নেয়। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি হওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে।

এদিকে বন্দোবস্ত পাওয়া সরকারি খাস জায়গায় গড়ে তোলা ঘরবাড়িসহ সহায়-সম্পত্তি ফেলে পুনর্বাসিত বাঙালি পরিবারগুলোকে গুচ্ছগ্রামে আনার পর তারা জীবনে বেঁচে গেলেও শুরু হয় আরেক কঠিন জীবন সংগ্রাম। গুচ্ছগ্রামে বরাদ্দ পাওয়া জায়গা ও ঘর খুবই ছোট হওয়ায় গাদাগাদি করে থাকতে হয় তাদের। পরিবারপ্রতি বরাদ্দ পাওয়া মাত্র পাঁচ শতক জায়গায় বসবাস করা এসব পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার পাহাড়ি ভূমি সোনামিয়া টিলায় ৮১২ পরিবারকে সরকার ১৯৮২ সালে পুনর্বাসন করে। ’৮৬-এর ভয়ানক পরিস্থিতির কারণে তাদের সাময়িকভাবে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। শান্তিচুক্তির পর ভারত থেকে শরণার্থীরা এলে দ্বিতীয় দফায় ঘরবাড়ি ছাড়তে হয় তাদের।

মূল বিরোধ কোথায়?
বাঙালিরা চাইছে নিজেদের জায়গায় ফিরে যেতে। সরকারিভাবে তাদের জন্য যে ভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাতে তারা থাকতে চায়। অন্যদিকে পাহাড়িদের মতে, এ জমি তাদের। প্রথাগতভাবে পাহাড়ি ভূমি নিজেদের বলে সবসময় দাবি পাহাড়িদের। তারা পাহাড়ি ভূমি কাউকে দেবে না। ফলে ভূমি নিয়ে পাহাড়ি-বাঙালির পরস্পরবিরোধী অবস্থান বছরের পর বছর ধরে চলছে। এমন অবস্থানের কারণে বারবার ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা। গত ১০ বছরে পাহাড়ে বিবদমান দুটি গ্রুপের মাঝে প্রায় ১৯০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে ৪৫০ পাহাড়ি-বাঙালি প্রাণ হারিয়েছেন। অপহৃত হয়েছেন সাড়ে আট শতাধিক। হাজারো ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
 
আদালতের কাঠগড়ায় পার্বত্য চুক্তি    
১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন করা হয়। এছাড়া পার্বত্য জেলা কাউন্সিল আইন-১৯৮৯ তে সংশোধনী এনে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ সংশোধনী আইন ১৯৯৮ প্রণয়ন করা হয়। এই দুই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা মো. বদিউজ্জামান হাইকোর্টে রিট করেন। পরে ২০০৪ সালে শান্তিচুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সম্পূরক আবেদন করে রিট করেন মো. বদিউজামান।

আদালত ২০০৪ সালের ১ আগস্ট রুল জারি করেন। সর্বশেষ ২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাজুল ইসলাম পার্বত্য চুক্তি নিয়ে হাইকোর্টে আরেকটি রিট করেন। ২৭ আগস্ট আদালত রুল জারি করেন। ২০১০ সালের শুরুতে রিট দুটির রুলের ওপর শুনানি শুরু হয় এবং  রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ১২ এপ্রিল আদালত রায় দেওয়া শুরু করেন।
 
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি সম্পাদনকারী তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ৩ সদস্য বিশিষ্ট চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি তৈরি করে। পার্বত্য চুক্তির আলোকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠন করে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে একজন পাহাড়িকে নিয়োগ দেয়।
 
চুক্তির পরবর্তীকালে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এক পর্যায়ে জনসংহতি নেতা ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) সাথে চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে বাড়তে থাকে দূরত্ব। এর মধ্যে ২০০১-এর নির্বাচনে জেএসএস আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে।

চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তি
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়ার প্রাক্কালে তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলের মতামত না নিয়ে বিদেশে কোনো চুক্তি হয় না। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকবে না তখন এই চুক্তির কি হবে? (ভোরের কাগজ, ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭) চুক্তির যে কোনো অগ্রগতি মান্নান ভূঁইয়ারা ক্ষমতায় এসে করবেন না তার কথাতেই তখন স্পষ্ট ছিল। এবং কার্যত হয়ে ছিলোও তাই।  

কিন্তু মজার ঘটনা হলো, চুক্তি সম্পাদনের প্রাক্কালে ‘চুক্তি হলে দেশের সার্বভৌমত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে’ বা ‘ক্ষমতায় গেলে চুক্তি বাতিল করব’ বলে হুংকার দেখালেও ক্ষমতায় থাকার পাঁচ বছরে বিএনপি চুক্তি বাতিল করেনি। চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি-এর বিপরীতে বিএনপি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত’ একটি কমিটি করে। এই কমিটি ও ভূমি কমিশনের উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মকা- বিএনপির ৫ বছরে চোখে পড়েনি। চুক্তি নিয়ে বিএনপির অবস্থান ছিল অদ্ভূত রকমের। চুক্তি বাতিলও নয় এবং বাস্তবায়নও নয়-এমন এক নীতি নেয় বিএনপি-জামায়াত। তারা একজন পাহাড়িকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বানায়। আবার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের উপমন্ত্রীর যে মর্যাদা ছিল, তা বাতিল করে।

বর্তমান সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তি    
২০০৯-এর জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর পরই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরীকে প্রধান করে চুক্তি বাস্তবায়ন করতে তিন সদস্যের জাতীয় কমিটি গঠন। কমিটির অন্য দু’জন সদস্য হলেন জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা এবং আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ ও পার্বত্য  চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কমিটির প্রধান জোতিন্দ্র লাল ত্রিপুরা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার বর্তমান সরকারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে পাহাড়ি জনপদ থেকে পর্যায়ক্রমে সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে একটি ব্রিগেড ও ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে ২৯ জুলাই (২০০৯) প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পক্ষ থেকে। আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর  এই প্রত্যাহারের ঘটনাকে ‘চুক্তির পরে সবচেয়ে বড় মাপের সেনা প্রত্যাহার’ বলে অভিহিত করে।

সরকারের ঘোষণার পর প্রথম ক্যাম্পটি প্রত্যাহার করা হয় ৭ আগস্ট (২০০৯) লক্ষèীছড়ি সেনা জোনের অধীন মানিকছড়ি থেকে। সেপ্টেম্বর (২০০৯)-এর মধ্যে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সমস্ত ক্যাম্পই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের এই ঘটনাকে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা ‘সাধারণভাবে ইতিবাচক’ বলে মন্তব্য করেন।

তবে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা দাবি করেন।

ইউপিডিএফ-নেতৃত্ব অবশ্য এই সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের ঘটনাকে ‘আই ওয়াশ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং এই ক্যাম্প প্রত্যাহারের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সামরিকায়নে কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে মন্তব্য  করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি সেটেলাদের সংগঠনগুলো এই সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের তীব্র বিরোধিতা করে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট এই বিরোধিতায় শামিল হয়।

সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী তাজুল ইসলাম গতবছরের ৯ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগে দুটি পিটিশন দায়ের করেন সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য। হাইকোর্ট ১৬ আগস্ট ক্যাম্প প্রত্যাহার প্রক্রিয়া ১৯ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সরকারের প্রদত্ত নথি এবং যুক্তি শোনার পর হাইকোর্ট ওই পিটিশন দুটি পরিহার করে সরকারকে কাজ চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়। বিএনপি সাংসদ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও জামায়াত নেতা আব্দুর রাজ্জাক পিটিশন দায়েরকারীর পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমা সম্প্রতি গণমাধ্যমে সরকারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘সরকারকে শিগগিরই শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় আদিবাসীরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। ’
 
পাহাড় অশান্ত করছে কারা?
শান্তি চুক্তিকারী সংগঠন জেএসএসের ছত্রছায়ায় ‘সদক’ নামে ক্যাডার সংগঠন পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে খাগড়াছড়িতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও ‘সদক’ এ দুই সংগঠনের ক্যাডাররা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চাঁদা আদায়ে এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধি রয়েছে তাদের। গোটা খাগড়াছড়ির লোকজন কে কি করে, কত টাকা আয় তার সবই ক্যাডারদের নখদর্পণে। মহালছড়ি, দীঘিনালাসহ অনেক এলাকায় চাকরিজীবীদের মাস শেষে বেতনের দুই শতাংশ টাকা তুলে দিতে হয় সন্ত্রাসীদের হাতে।

এছাড়া ধানসহ মৌসুমের ফসল ঘরে উঠলেই একটি অংশ তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। এছাড়া অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, হত্যাকা- ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া তো রয়েছেই।

ইউপিডিএপ-এর সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা জানান, জনসংহতি সমিতির হামলায় তার দলের ২০০-এর বেশি নেতাকর্মী খুন হয়েছেন।

অন্যদিকে জেএসএস-এর সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা জানান, ইউপিডিএফর হাতে নিহত হওয়া তাদের নেতাকর্মীদের সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি।
 
পাহাড়ে শান্তি আসবে কবে?
শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন কবে হবে এ প্রশ্ন এখন পাহাড়িদের। চুক্তির ফলে দু’দশকের সংঘর্ষের অবসান হয়েছে ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধের অবসান শান্তির নিশ্চয়তা দেয়নি। আত্মনিয়ন্ত্রণের যে দাবি পাহাড়িরা করেন, সেটি হঠাৎ চাওয়া কোনো দাবি নয়। উন্নয়নের নামে পাহাড়িদের জীবন ও প্রকৃতি বিরোধী কর্মকা-, মানুষের বিপর্যয়, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার প্রক্রিয়ার ফলেই পাহাড়ি মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চেয়েছে।

উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, মানুষের গণতান্ত্রিক দাবির প্রতি শ্রদ্ধা না জানালে রাষ্ট্র বিরাট ধাক্কা খায় এবং এক পর্যায়ে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। পাহাড়ের মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি শ্রদ্ধাই ওই অঞ্চলের শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে।    

লেখক- সিনিয়র রিপোর্টার, পলিসি ম্যাগাজিন একপক্ষ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।