ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আমার মায়ের সোনার নোলক

আদনান সৈয়দ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৯ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৫
আমার মায়ের সোনার নোলক

প্রতিদিন ঘুমোতে যাবার আগে আমি আমার আম্মার সঙ্গে কথা বলি। এটা আমার প্রবাস জীবনের এক অলিখিত নিয়ম।

আমি যত ব্যস্তই থাকি না কেন, মার জন্য এই সময়টা আমার বরাদ্ধ থাকবেই। আমার আম্মাও তার পুত্রের মতই। আমার সঙ্গে কথা না বললে তার দিন কাটে না। দিন কাটেতো তার রাত কাটে না। আমি জানি আমার মত আর সব প্রবাসীদের জীবনেও মাকে নিয়ে আছে প্রায় একই রকম গল্প।

আম্মা আমার অবাল্য বন্ধু। এক অসাধারণ বন্ধু বলতে যা বোঝায় তিনি ঠিক তাই। একটা ঘটনা এখনো মনে আছে। তখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। আমার মা যাবেন আমার নানা বাড়ি বেড়াতে। তিনি যাবেন একা একা। আমরা ভাইবোন আর বাবা যাব সপ্তাহ দুই পরে। আমি আর বাবা আমরা দুজন মাকে নিয়ে যাচ্ছি কমলাপুর রেল স্টেশনে ট্রেনে তুলে দিতে। মা বসলেন জানালার ধারে একটা সিটে। চোখ মুছে যখন মাকে বিদায় জানাতে যাবো, তখন মাতো আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবা কোনরকমে আমাকে মায়ের আঁচল থেকে মুক্ত করলেন। বাবার সেই আশার বাণী, ‘কিছুদিন পরতো আমরা সবাই কত মজা করতে করতে যাব। ’ 

আমরা ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। মা একা একা চললেন তার বাবার বাড়ির পথে। এদিকে ট্রেনটা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। আমার বুকের ভেতরটা কে যেন হাতুরী দিয়ে দুমরে-মুচরে ভেঙে দিয়ে গেল। কেন জানি মনে হতে লাগলো, মা আমার থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছেন। আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে সেই যে আমি চিৎকার দিয়েছিলাম তখন আমার সেই চিৎকারে কমলাপুর স্টেশনে লোক জড়ো হওয়ার উপক্রম। ধীরে ধীরে নিষ্ঠুর ট্রেনটা চোখের সামনে আমার মাকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধু ঝাপসা চোখে মায়ের মুখটা গেঁথে রইল। বাড়িতে আসার পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। প্রচণ্ড জ্বর। দুদিন পরই দেখি একটা অফ হোয়াইট শাড়ি আমার নাকের খুব কাছে এসে আমার কপালে হাত রাখছে। আর সেই  শাড়ি জুড়ে আমার মায়ের ঘ্রাণ। আমার কপালে হাত রেখে শুধু বললেন, ‘এত বোকা কেন তুই? আমি কি মরে গেছি?’ আমি তখন এক লাফে মাকে জড়িয়ে আরেক প্রস্থ কান্না। সেই কান্নার দাগ আমার মনে এখনো লেগে আছে। আমরা সব প্রবাসীরাই সেই কান্নার দাগ নিয়ে হেঁটে যাই। কারন আমাদের হাঁটতে হবেই। থেমে থাকাতো আমাদের কাজ না। বুকে পাথর বেঁধে আমরা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে যাই। প্রবাসীর হৃদয়ের গহীন কূপে জমে থাকা এই কান্নার দাগ আমাদের সবার জন্ম দাগের মতই চিরসাথী হয়ে যায়।

আম্মাকে নিয়ে আরেকটি ঘটনা বেশ মনে পরে। যুক্তরাষ্ট্রে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে আসার আগের রাত। বোন কাঁদছে, আব্বার মুখ থমথমে আর মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোনটা পরিষ্কার করছে আর আমার ব্যাগ গোছাচ্ছে। কাজ করতে করতে বললেন, নিয়মিত যেন চিঠি লিখি, নিয়ম করে যেন খাওয়া দাওয়া করি, গোসল করি, নখ কাটি, আরো কত কী। আমি তার সবকিছুতেই ‘হ্যাঁ’ বলে যাচ্ছিলাম। আম্মা কি মনে করে যেন আমার মাথার চুলের ঘ্রাণ নিলেন। কপালে চুমো দিলেন। তারপর বললেন, জীবনের জন্যে অনেক কঠিন কিছু করতে হয়।

মা শব্দটি বুকে নিয়ে আমরা ঘুমাতে যাই আবার ঘুম থেকে জেগে উঠি। শুধু কোন দিবস দিয়ে মাকে কি মূল্যায়ন করা যায়? কোনভাবে কি তা সম্ভব? আমরা যারা দেশ থেকে অনেক দূরে আছি সেইসব হারাধনরা তাদের ছোট্ট ধমনীতে ‘মা’ নামের এই শব্দটিকে ধারণ করে নিত্য পথ চলি। মা আছেন বলেই আমাদের কাছে পৃথিবী এত সুন্দর আর নির্মল। মার প্রতি কৃতজ্ঞতার কি কোন শেষ আছে? পৃথিবীর কোন পার্থিববস্তু দিয়ে তা কি সম্ভব?

লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।