ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

স্মৃতিকথা | আলী আশরাফ

আমাদের দোস্ত ক্রিকেটার মোহাম্মদ শহীদ

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৫
আমাদের দোস্ত ক্রিকেটার মোহাম্মদ শহীদ

‘ঠিক মনে আছে আমার;
ছোটবেলায় কি ভাবতাম,
বড় হয়ে কি হবো! একজন খেলোয়াড়!’


হুম, ফুটবল খেলোয়াড়, প্রতিদিন আমাদের পাড়ার (তল্লা) সব পোলাপানদের জমিয়ে নিয়ে ছুটতাম কেল্লার মাঠ। নারায়ণগঞ্জের তল্লা এলাকায় আমাদের বাড়ি থেকে যার দূরত্ব ছিল পায়ে হেঁটে বিশ মিনিট।

তখন বুড়োদের মুখে শুনেছিলাম সেই কেল্লাটি আসলে একটি দূর্গ। বারো ভুঁইয়াদের আমলের ঈশা খা’র ঐতিহাসিক দূর্গ। আমাদের মতোই হয়তো কোনো আজাইরা পোলাপান এই দূর্গটিকে খেলার মাঠ বানিয়ে ছেড়েছে।

তো সেই মাঠই ছিল আমাদের পাড়ার এমনকি গোটা নারায়ণগঞ্জের মধ্যে অন্যতম খেলার মাঠ। গোটা নারায়ণগঞ্জে এমন কোন খেলোয়াড় পাওয়া যাবে না, যে ওই কেল্লার মাঠে একদিনও খেলেনি। আমরা প্রতিদিন সাত-আট জন বিকেলে যেতাম খেলতে, মাঝে মাঝে স্কুল পালিয়ে। যেদিন স্কুল পালাতাম সেদিন দেখতাম মাঠে আমাদেরই পাড়ার দুই দোস্ত (দুই হোসেন) মাঠে এসে আগেই বসে আছে, মাদ্রাসা পালিয়ে। আমরা স্কুল পালাতাম আর ওরা মাদ্রাসা। একজন জাকির হোসেন (জাকির) আরেকজন শহীদ হোসেন (শঈদ)। পরে সবার মত নিয়ে ফুটবল হলে ফুটবল আর ক্রিকেট হলে ক্রিকেট খেলা চলতো আমাদের। আমার ঝোঁক ছিল ফুটবল আর শঈদের ক্রিকেট। আর জাকির সবসময় মাঝামাঝি। দুটোতেই রাজি।

ওই সময়ে মোহাম্মদ শহীদ হোসেন- এত বড় নামটিকে আমরা ‘শইদোসেন’ বানিয়ে ফেলেছি। কেউ কেউ আবার ‘শয়তান হোসেন’ বলে ক্ষোভ ঝাড়তো। কারণ খেলার সময় শহীদ এর বোলিং-এর গতিকে সবাই ভয় পেতো। ক্রিকেটে আমিতো মূলত ব্যাটিং করতাম। তবু শহীদের বোলিংয়ের সময় হাঁটু কাপতো। আমরা পিছনের স্প্যাম্প আড়াল করবো নাকি দেহের মাঝখানটা (আমরা তো আর গার্ড ব্যবহার করতাম না তখন) আড়াল করবো। এটা ভাবতে ভাবতেই দেখতাম স্ট্যাম ভেঙে গেছে। শহীদ ব্যাটসম্যান হিসেবেও দারুণ ছিল। উফ্! সেই শহীদ আমাদের গ্রুপ এর ঘাউড়াদের মধ্যে ছিল একজন। যাকে নিয়ে অনেক মজার ঘটনা আমাদের আছে। একটা ঘটনা তো খুবই মজার। তা-ই বলছি...

ফুটবল কি ক্রিকেট, আমরা যখন পাশের মহল্লার সাথে খেলা নিতাম তখন শহীদকে বলতাম, ‘ওই শঈদ কালকে থাকিস, খেলা আছে। ’ শুনেই শহীদ তো আকাশে উড়তো, পাত্তা না দিয়ে বলতো, ‘নারে দোস্ত, কালকে অনেক কাম আছে, বাসায় মেহমান আসবে। ’

এইটা সেইটা নানান রকম অজুহাত। ইস্। আমরা তো বেজায় বিরক্ত। মামার ভাব দেখো। যাহ্, না আসলে নাই। এতোই যখন ঝামেলা তখন আর কি করা, আমাদেরই খেলতে হবে।

কিন্তু যেদিন খেলা সেদিন আমি, সুজন, জাকির, হযরত, রাব্বি, পাভেল, রনি তো যথাসময়ে গিয়েছি মাঠে। গিয়ে দেখি শহীদ আগে থেকেই মাঠে গিয়ে বসে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এটা একবার দুবার না, প্রতিবারই এমন হতো।

অবশেষে আমরা তো আর শহীদকে জানাতামই না। জানতামই শহীদ মাঠেই আছে, মাঠের ছেলে। এমনই নেশা ছিল খেলাধুলায় পরিশ্রমী ক্রিকেটার আজকের মোহাম্মদ শহীদের। আর আমরা তো প্রায়ই একসাথে টিভিতে খেলা দেখতাম। পরে খেলার মাঠে শহীদ উইকেট কিপার থাকতো যখন মাঝে মাঝে, অযথাই চেঁচামেচি করতো, সাবাশ, ব্রাভো, ইয়েস ইয়েস, গুড গুড বলে। সবাই তো বিরক্ত তখন। আর বলতো টিভিতে খেলাও দেখায়, শুধু চেঁচামেচি শিখিস না আবার। হাহাহা। নাহ্, শহীদ শুধু চেঁচামেচিই শেখেনি। আমাদের একদম জিতিয়ে নিয়ে ফিরতো মাঠ থেকে। এভাবেই কাটছিল আমার মেট্রিক পরীক্ষা পর্যন্ত। মেট্রিক-এর পর আমি টাঙ্গাইল চলে যাই পড়াশোনার সুবাদে। পরে একদিন শুনলাম ভাড়াসূত্রে শহীদ আমাদের বাড়িতেই উঠেছে। তারপর প্রায়ই যখন বাসায় যেতাম টাঙ্গাইল থেকে পরীক্ষা শেষে, কথা হতো, শহীদ তখনও আগের মতোই ক্লাবে খেলতো। পরে রূপগঞ্জের হয়ে খেলেছে।

ছোটবেলায় প্রায়ই বলতো শহীদ- বড় ক্রিকেটার হতে চায়। বলেই জিজ্ঞাস করতো, তুই? আমি বলতাম, ফুটবলার। কিন্তু সাইনাসের সমস্যা থাকায় আর ফুটবল খেলোয়াড় হতে পারিনি মুন্না ভাইদের মতো। আমরা অনেকেই নিজেদের ভাবনায় কিছু হতে চাওয়ার দিকে এগুতে পারিনি (অমলকান্তি কে মনে রেখে)।   অনেক আর্থিক এবং পারিবারিক সমস্যা থাকার পরেও শহীদ পেরেছে, মোহাম্মদ শহীদ হতে পেরেছে। শহীদের পরিশ্রম এবং লক্ষ্যের দিকে ছুটে চলা আর একাগ্রতায় আজ জাতীয় দলের ক্রিকেটার সে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা তো হয়নি খুব একটা। জাতীয় ক্রিকেট দল পর্যন্ত যাবার দৌড়েও খুব আগেভাগে পৌঁছাতে পারেনি। প্রতিষ্ঠিত মামা-চাচা নাই শহীদের, এখন তো বাদাম বিক্রি করতে গেলেও লিংক থাকতে হয়। তবে শহীদ খুব আস্তে আস্তে কষ্ট করে এই পর্যায়ে এসেছে। না হলে হয়তো আরও আগে থেকেই বল-ব্যাট হাতে মাঠ কাঁপাতো শহীদ। কিন্তু যে পরিশ্রম করেছে সারা জীবনে শহীদ, তার উল্লেখযোগ্য সার্থকতা এখন এই জাতীয় দলে খেলা।

২৮ এপ্রিল ২০১৫ পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট ম্যাচে জাতীয় দলে অভিষেক হয় শহীদের। ১৫ এপ্রিল প্রীতি ম্যাচে এই মোহাম্মদ শহীদই পাকিস্তানের বিপরীতে বাংলাদেশের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কোনো একদিন হয়তো সাকিব-তামিম-মুশফিকদের মতো বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রেমীদের মধ্যমনি হয়ে উঠবে মোহাম্মদ শহীদ। ক্রিকেটে ওঠা-নামা আছে, তবু যাই হোক, সেই ছোটবেলার মতো আমরা যাতে শহীদকে মাঠেই পাই সবসময়। খেলার মাঠ থেকে আমাদের এক্কেবারে জিতিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরুক। আমরা ক্রিকেটের দর্শক সেই দিনের অপেক্ষায়।

আলী আশরাফ: সাহিত্যকর্মী

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৫
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।