ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

চলুন বাঁচাই সারথীর লাল টিলা ।। কাকলী প্রধান

পরিবেশ প্রকৃতি / মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৫
চলুন বাঁচাই সারথীর লাল টিলা ।। কাকলী প্রধান

সকালের আলোটা কেবল ছড়াচ্ছে চারদিকে। ডে অফ তাই ঘুম ভাঙলেও, চোখ খোলার দায়-দায়িত্ব নেই।

যাকে সবচেয়ে ভয়, সেই ফোনটাই বেজে উঠল। একি!—এত সকালে সিলেট থেকে সারথী! ভয়ানক উৎকণ্ঠা মাখা কণ্ঠস্বর সারথীর, ‘আপা, আপনি কিছু শুনতে পাচ্ছেন?’ আমি বললাম, ‘সারথী তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি—আর অন্যসব কী আওয়াজ?’ এবার পাহাড় সমান মনোবলের সারথী কান্নায় ভেঙে পড়ল। ‘আপা ওরা আবার বিল্ডিং বানাচ্ছে। আপনি যে জায়গাটার ছবি তুলেছিলেন, টিলা কেটে ওরা প্লট বানিয়ে রেখেছিল, সেখানে এখন আবার ওরা এসে কাজ শুরু করেছে। ’

আমি বললাম, এত দিন তো কাজ বন্ধ ছিল। আবার তাহলে নতুন করে কেন, কিভাবে?’ সারথী জানাল, ‘আপা, এতদিন চুপ ছিল। আপনার আসা-যাওয়া, মিডিয়ার চাপ, এখন সব শান্ত হয়ে গেছে। তাই ওরা আবার.. আপা আপনি আমাদের বাঁচান, কিছু একটা করেন। ’

আমি সারথীর কাছ থেকে তথ্য নিতে থাকি:

: যে টিলাগুলোতে এখন তোমরা আছো, সেগুলো কি তোমাদের নামে কখনও ছিল?
- জ্বি, আপা ছিল।
: তারপর?
- আমরা তখন অনেক ছোট। ২০০২ সালের ঘটনা। অ্যাডভোকেট কমরেড মালেক নামে একজন ষড়যন্ত্র করে আমার জ্যাঠা বাবা—সমরা ওঁরাওকে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রাখে। জ্যাঠা বাবারা ছিলেন নয় ভাই। বন্দী অবস্থায় জ্যাঠাবাবার কাছ থেকে ওরা নকল দলিলে সই করিয়ে রাখে।
: তারপর? তোমার জ্যাঠাবাবার অন্যান্য ভাইরা তো ছিলেন, তাদের তো দলিল থাকার কথা তাই না?
- আমার অন্য দুইজ্যাঠা তখন মৃত। নয় ভাইয়ের মধ্যে বাকি ৬ জনকে এসে কমরেড মালেক একটি সংবাদ সম্মেলন করার প্রস্তাব দিলেন এবং সে উপলক্ষে সাদা কাগজে ৬ ভাইর সই সংগ্রহ করে নিলেন।
: তারপর কি আদৌ সংবাদ সম্মেলন হয়েছিল?
- হয়েছিল, তবে সাজানো। সম্মেলনে উনি ঐ ৬ ভাইকে বললেন, তোমরা আমাকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দাও। আমি তোমাদের সম্পত্তি দেখাশোনা করলে আর কোনও সমস্যা হবে না।

: তারপর সমস্যা কবে বুঝলে?
দু’বার হাত বদল হয়ে গেছে। অ্যাডভোকেট কমরেড মালেক চেয়ারম্যান মোসাব্বিরের কাছে বিক্রি করে দেয় আমাদের চন্দন টিলা। চেয়ারম্যান আবার বিক্রি করে দেয় অন্যান্যদের কাছে।
: তারপর! তারপর এখন কি অবস্থা?
- এখন টিলা কেটে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্লট করে করে বিল্ডিং বানানো হচ্ছে।
: তারপর?
- আপা, আপনার কি আরও কিছু তারপরও দরকার? তাহলে আমরা কার কাছে যাব? এরপর-তারপরের উত্তর যে একটাই আপা, আমাদের হারিয়ে যাওয়া নয়ত মৃত্যু। আপনার কোনটা হলে ভালো হয়? আপা কিছু একটা করেন।
: সারথী তোমরা তো জানো না আমাদের ক্ষমতা কত সীমিত। আমাদের কাগজ-কলম, আমাদের ক্যামেরা অনৈতিকতা দিয়ে আগাগোড়া বাঁধা।
- আপা তাহলে কি আমাদেরও চলে যেতে হবে? আমরা কোন ঠিকানায় যাব, কোথায় নতুন ঠিকানা খুঁজব?
: সারথী জজ, ব্যারিস্টার, উকিল, দলিল, প্রশাসন, আদালত এগুলোর তুলনায় আমরা আসলেই তলানীতে। আমি জানি না, শুধু জানি যে বাঙালি, বাংলাদেশ বহুজাতি বহু ভাষাভাসির বহু সংস্কৃতির অভয়ারণ্য, আমার দেশ সেই গর্ব , সেই অহঙ্কার হারাতে বসেছে।
- আপা আপনি কি আমাদের পাশে দাঁড়াবেন না?
আমি দাঁড়াব তোমার পাশে, কিন্তু আর কাকে যে পাশে নিয়ে দাঁড়াব, কে যে আমাদের পাশে দাঁড়াবে...

ওপাশ থেকে সারথীর সুতীব্র জিজ্ঞাসা, ‘আমরা কার কাছে যাব? এত সংগঠন, এত সচেতন মানুষ। এত মানবাধিকার কর্মী। একবার আসুন না আমরা আর একবার একত্রিত হই, একবার বেড়িয়ে আসি সবুজ সিলেটে। সিলেটের উত্তর বালুচর, নতুন বাজার চন্দন টিলায়। আসুন সারথী, শিপা, রিতাদের পাশে দাঁড়াই। বাঁচিয়ে দেই সারথীর লাল টিলা। কিংবা সবুজ বাংলাদেশ।

লেখক: ফটোজার্নালিস্ট, দৈনিক কালের কণ্ঠ

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।