ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দীনেশদা, তুমি কথা রাখলে না...

রক্তিম দাশ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১২
দীনেশদা, তুমি কথা রাখলে না...

কলকাতা: দীনেশ দাস চলে গেলেন। একজন সৎ মানুষ আবারও পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন, ঘাতক বাস কেড়ে নিল তার প্রাণ মধ্য যৌবনে।



রোববার সকালে ঘুম ভেঙে গেল বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট আনোয়ারুল করিম রাজুর ফোনে। ফোন ধরতেই রাজু কাপা গলায় বলে ওঠল ‘দাদা দিনেশ দা নেই’। কাকরাইল মোড়ে বাস তার জীবন কেড়ে নিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

মনে পড়ছিল, দীনেশ দার কথা। আমাদের সময়ের প্রথম দিনটি থেকে তার সাথে আমার যোগাযোগ। খুব মজা করে আমার সাথে হিন্দিতে কথা বলার চেষ্টা করতেন। বলতেন ক্যায়সা হো রক্তিম বাবু?

দেখা হলে সব সময় হেসে কথা বলতেন। আমার সর্ম্পকটা ছিল তুমির। আমি তাকে, তুমি বললেও আমায় আপনি বলতো সবসময় মানুষটি। বলতো, রক্তিম বাবু।

আমাদের সময়ের চাকরি ছাড়ার পর যতবার গেছি, এই সেদিনও খুজঁতাম তাকে। ডেস্কের কোনে মাথা নিচু করে একমনে কাজ করছে দিনেশ দা। সবাই তাকে বলতো মাওলানা দিনেশ। ঢাকায় সাংবাদিক মহলে একটা চালু রসিকতা ছিল, দিনেশ দা জুম্মার নামাজ পড়ে জামায়াতের নেতাদের ইন্টারভিউ নেন।

সেই দিনেশদার এই কানেকশান কাজেও লেগে ছিল আমাদের সময়ে, নিয়মিত ইসলামী দলগুলির অভ্যন্তরে ঢুকে নিউজ কালেকাশানে। আর কোনো হিন্দু সাংবাদিককে এতটা বিশ্বাস করতেন জামায়াত বা ইসলামিকদলগুলো আমার মনে হয় না। এই সুযোগকে কাছে লাগিয়ে ধারাবাহিক একটি প্রতিবেদন আমাদের সময়ে লিখে ফেলেছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে দীনেশ দা।

প্রতিবাদ এসেছিল, এসছিল প্রাণনাশের হুমকি। না দিনেশ দার কিছুই হয়নি। এই লেখা লেখার পরও তিনি আবারও ফিরে গেছিলেন মাওলানা দিনেশের ভূমিকায়।

আমি সন্দিহান হয়ে পড়েছিলাম। তবে কী মানুষটি সত্যিই মৌলবাদী নাকি? একদিন সরাসরি জানতে চাইলাম। দীনেশ দার সেই হাসি। কী যে বলেন রক্তিম বাবু, আমি তো কমিউনিস্ট। বুঝে ছিলাম একজন সাংবাদিক হতে গেলে কতটা চালাক হতে হয়। কী সুকৌশলে কাজ করতে হয়।

প্রতিবছর একুশের বইমেলায় দীনেশ দা কভার করত। আর যত নতুন বই পেত একটাও বাসায় না নিয়ে সহকর্মীদের কার কোন বই ভালো লাগে তাকে সেটাই দিয়ে দিত। একবার বইমেলায় সময় আমায় একটা সাপের কামড়ের চিকিৎসার বই এনে দিল। আমি বললাম এটা? বললো, আরে আপনি তো সাপ নিয়ে কাজ করেন, আপনার লাগবে বলে নিয়ে এলাম।

মাঝে মাঝেই অনেক রাত পর্যন্ত আমি দীনেশদা আর রাজিব আমাদের সময়ের আইটি রুমে আড্ডা মারতাম। দীনেশ দা বলতো, আমায় কলকাতার কোনো সংবাদপত্রে কাজের সুযোগ করে দিন না।

আমি বলতাম, কলকাতার একটি বিশেষ পাড়া থেকে দৈনিক বের হয়ে কাজ করবে? অশ্লীল এই ইঙ্গিতে না ক্ষেপেও দীনেশ দা বলতো, আরে এটা তো চ্যালেঞ্জ হাম কাম করেঙ্গে।

কলকাতায় বেড়াতে আসার খুব ইচ্ছা ছিল। পূজোর সময়। আমাকে প্রায়ই বলতো, আপনার ওখানে যাব। আমার কোন আত্মীয় নেই কলকাতায়। আপনি আছেন। কিন্তু পাসপোর্ট নেই। আমার, পলির আর অথৈর পাসপোর্ট করেই একদিন চলে যাব।

গত সেপ্টেম্বরে দেখা, কী হল কলকাতায় আসবে না? এবার যাব পাসপোর্ট হয়ে গেছে। আপনার বাসায় উঠব।

না, দিনেশ দা আর আসেনি। ঢাকার কর্মব্যস্ত জীবনে ব্যস্ত, এই মানুষটির চাকরি কেড়ে নিয়ে তাকে কর্মহীন করে দেওয়া হল। ঘাতক বাসটি নয়, ওই চালকটিও নয়, ঘাতক মালিকপক্ষ যারা সাংবাদিকের কর্মহীনতার যন্ত্রণা না বুঝে তাকে চিরতরে অবসরে পাঠাল।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।