ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রতিবন্ধী মানে প্রতিভাবন্ধী নয়

প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০১৪
প্রতিবন্ধী মানে প্রতিভাবন্ধী নয়

ঢাকা: কোন ব্যক্তির শরীরের কোন অংশ যখন স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না তখন আমরা তাকে প্রতিবন্ধী বলি। হতে পারে সে বাকপ্রতিবন্ধী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী, মানসিক প্রতিবন্ধী, শ্রবণ প্রতিবন্ধী ইত্যাদি।



প্রতি বছর ৩ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হয়। ‘ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট ২০১১’ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষ কোন না কোন ভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ অর্থাৎ ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ প্রতিবন্ধী। বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। প্রতিবন্ধী মানে তো প্রতিভাবন্ধী নয়। সৃজনশীলতাবন্ধী নয়। স্বুল-কলেজ পড়ুয়া অর্র্থাৎ শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রেই কম বেশি অনেকেই স্টিফেন হকিং এর আত্মজীবনী জানেন। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তিনি গেহরিক (এবযৎরম) রোগের শিকার হন। মাংসপেশির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী হন। কেবল হাত ও মাথা যৎসামান্য নড়াচড়া করতে পারেন। পুরো শরীরের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে তিনি চাকাচালিত চেয়ারে আবদ্ধ হন। শুধু কম্পিউটারের কণ্ঠ সংশ্লেষণ পদ্ধতিতে কথা বলতে পারেন যা তার সংবাদকে শব্দে পরিণত করে। গণিত শাস্ত্রবিদ অন্যতম এই পদার্থ বিজ্ঞানী শারীরিক অক্ষমতার নিকট মাথা নত করেননি। কম্পিউটারের সাহায্যে গবেষণা চালানো ও বক্তৃতা উপস্থাপনে তিনি একজন গতিশীল কর্মী। তিনি অনন্তকাল ধরে প্রতিবন্ধীদের জন্য বাঁচার শক্তি হিসেবে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাবেন। বর্তমান সমাজে অসংখ্য প্রতিবন্ধী আছে যাদের সবাই কাজে অক্ষম নয়। তাদের মধ্যে কেউ বা জন্মগত প্রতিবন্ধী কেউ বা পরিস্থিতির শিকার। কিন্তু সুখের বিষয় হল এদের অনেকে সমাজের অন্য দশজনের মতো বাঁচতে চায়। অনেকে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখে, মানুষকে ভালবেসে এদের জন্য কিছু করতে চায়, দেশাত্মবোধে জাগ্রত হয়ে দেশের জন্য কিছু করতে চায় আরো কত কি। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে দেখা যায় সমাদর পেলে এরা কাজের প্রতি খুবই আন্তরিক হয়ে উঠে। একই সাথে অনাদরে প্রচণ্ডভাবে হতাশ হয়। নিজ জীবনের প্রতি হীনভাব জন্মে। এইভাবে সে জীবনের প্রতি ক্রমশ মায়াহীন হয়ে উঠে। অনেক সময় সে মনে করে মৃত্যুই এর চূড়ান্ত সমাধান। কিন্তু কেন ? এ পৃথিবী তো সবার জন্য। সবার জীবনের একদিন সমাপ্তি ঘটে। তবে সমাপ্তিটা যদি সুন্দর হয় তাহলে জীবনের প্রতি সম্মান দেখানো হয়। অন্যথায় জীবনকে লাঞ্চিত করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে পত্র-পত্রিকাগুলোতে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য ছাপা হয়। এদের কিছু কিছু মধুর আর কিছু বেদনা বিধূর। আমি এইও দেখেছি যে এদের অনেকের মধ্যে আবেগ প্রবণতাও বেশি। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে যা যে কোন ধরণের দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। আমিও অনেক প্রতিবন্ধীকে কাছ থেকে উপলব্ধি করেছি। তাদের দেখলে প্রতিটি বিবেকবান মানুষের তো এমনিতেই দয়া হওয়া উচিত। তাদের কথা ভেবে সরকারও প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। পড়ালেখার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে। কিন্তু এত সব কেন ! গত ১০ই এপ্রিল ২০১১ তারিখের দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার আইন অধিকার সংখ্যায় দেখলাম বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের প্রতিভাবান স্বল্পমাত্রার বাকপ্রতিবন্ধী (তোতলানো) শিক্ষার্থী মধুসূদন চক্রবর্ত্তীর আত্মহত্যার শিকার নিষ্পাপ চেহারাটি। তার নিরীহ চাহনি বলছে যে অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে জীবনের সাথে এমন কঠোর আচরণ করেছে সে । যে চাহিদার অপূরণে সে জীবনটাকে বলি দিল তা তো তার প্রাপ্য অধিকার। এক বন্ধু অপর বন্ধুর কাছে এবং এক শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের কাছে, এক রোগী তার ডাক্তারের কাছে একটু সুন্দর ব্যবহার, একটু মার্জিত আচরণ, একটু সহমর্মিতা অবশ্যই কামনা করতে পারে। অনেকে বলেন ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক থাকা উচিত। আমি ও তাই মনে করি। তবে বর্তমানে রুচিহীন সম্পর্ক দেখে খুবই লজ্জিত হই। ছাত্র শিক্ষক পান চিবাতে চিবাতে পথ চলা, একজন আর একজনের সামনে ধূমপান করা, মন্দ-সন্দ দু’চার কথা বলা, চক্ষু লজ্জাহীন আচরণ করা, ঠাট্টা-মশকরা করা এর নাম বন্ধুসুলভ সম্পর্ক নয়। কোন শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের পাঠ একবারে বুঝতে পারলো না। সে বোঝার  স্বার্থে তার শিক্ষককে বার বার বিরক্ত করবে কিন্তু শিক্ষক তাতে আরো আনন্দিত হন, ছাত্র-ছাত্রী বিপথগামী হলে শিক্ষক তাদের এক হাতে শাসন করেন অন্যহাতে স্নেহ করেন, সৎ পরামর্শ ও উপদেশ দেন, শোষণ করেন না, তাদের ভুলত্রুটি শুধরে দিতে সচেষ্ট থাকেন, আন্তরিকতার সাথে পাঠ নেন এই গুলিই বন্ধুসুলভ সম্পর্কের উপাদান। আর শিক্ষকের এসব গঠনমূলক শাসন মানতে পারলে এইগুলোই হবে শিক্ষকের প্রতি কোন শিক্ষার্থীর প্রকৃত পূজা আর সালাম।

কোন শিক্ষার্থী তার শিক্ষা জীবনের নীতি আদর্শ মানল না, প্রতিটি মানুষের দৈনিক ধর্মাচরণের যে একটা কর্তব্য আছে সেটাও মানল না কিন্তু কোন শিক্ষকের সামনে পড়ে গেলে সালাম, নমস্কার দিতে ভুল করলো না। এটা কিন্তু শিক্ষকের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন হলো না। আর এখন তো আমাদের শিক্ষার্থী ভাই-বোনদের সালাম বা নমস্কার দেওয়ার কায়দাও পুরোপুরি বদলে গেছে। সালাম বা নমস্কার দেওয়ার যে একটা পদ্ধতি আছে তা বর্তমানে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। কারণ যার পেটে ক্ষুধা থাকে না যে গুরুত্বের সাথে বা যত্নের সাথে খাবার খাবে না। একইভাবে যখন নিজের ভিতরে শ্রদ্ধা কাজ করে না তখন হাত তুলে সালাম বা নমস্কার দেওয়া যায় কি করে ! অবশ্যই কতিপয় শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের স্বভাব আর আচরণ দোষে শিক্ষক মানে কি, তাদের প্রতি কোন ধরণের আচরণ করা কর্তব্য তা আজ শিক্ষার্থীরা ভুলতে বসেছে। শিক্ষার্থীরা দুই শ্রেণীর মানুষের ছত্রছায়ায় জীবনের দীর্ঘ সময় কাটায়। প্রথমত পিতামাতা। দ্বিতীয়ত শিক্ষকের সান্নিধ্যে। সেই সুবাদে পিতামাতা এবং শিক্ষকদের রীতি নীতি আদর্শ এবং জীবনধারা শিক্ষার্থীদের জীবনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এটা আমার মনগড়া কথা নয়। পরীক্ষিত উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। পূজনীয় পিতামাতা এবং শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ যদি মনে করেন যে তাঁদের কেউ না কেউ অনুসরণ করছে, তাহলে বোধহয় মধূসূদন চক্রবর্ত্তীর জীবনে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডি পূর্ণ দুর্ঘটনাবলী শিক্ষকতার মত মহান পেশা বা ধর্মকে লজ্জিত করার সুযোগ পাবে না। শিক্ষার জগতে আমূল পরিবর্তন সম্ভব না হলেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। শিশু শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতন বন্ধের নীতিমালাও হাইকোর্ট থেকে এসেছে। একইভাবে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপর শিক্ষকবৃন্দ এবং সহপাঠীদের আচরণের  নীতিমালাও হাইকোর্ট থেকে প্রণয়ণ হতে পারে।

অবশ্যই সবচেয়ে উপরের হাইকোর্ট হল বিবেক। আমরা বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে অভ্যস্ত নই বলে থানা, পুলিশ, উকিল, বিচারক, কোর্ট-কাচারি ইত্যাদির জন্ম হয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের শান্তি-শৃংখলা আইন, বিচার এবং প্রশাসন নির্ভরশীল হয়ে গেছে। কিন্তু এইভাবে নিরাপদ হওয়া যায় না। যার মন ও বিবেক নিরাপদ তিনিই নিরাপদ ব্যক্তি। যার মন ও বিবেক সুন্দর তিনিই সুন্দর মানুষ। লোকে বলেন, তিনি ডাক্তার বা শিক্ষক হিসেবে খুবই ভাল। তবে মানুষ হিসেবে ভাল না। আমার এই অপ্রিয় কথাগুলো কারো মনে ব্যাথা দেওয়ার জন্য নয়। কেবল বিবেচনার জন্য অন্তরের ডাকমিশ্রিত নিবেদন মাত্র। বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে সকল প্রতিবন্ধীদের অধিকার বঞ্চনা এবং শোষণমুক্ত জীবন কামনা করছি।

বাংলাদেশ সময়: ২২৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।