ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কুমারী পূজা: শক্তির আরাধনা

তারাপদ আচার্য্য, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০১৪
কুমারী পূজা: শক্তির আরাধনা ছবি : দেলোয়ার হোসেন বাদল / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ’
 
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শ্রেষ্ঠ পূজা দুর্গাপূজার অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত কুমারীপূজা।

সাধারণত কুমারী পূজা সম্পর্কে ভক্তদের জানার গণ্ডি সীমাবদ্ধ। অনেকেই জানেন না কুমারীপূজা কী এবং কী তার রহস্য। এ সম্পর্কে তেমন কোনো পুঁথি-পুস্তকও নেই যা ভক্তদের জ্ঞানপিপাসা মেটাবে।
 
সাধারণত কোনো কোনো রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠে কুমারী পূজা হয়ে থাকে, তবে সব রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠে হয় না। প্রথমে দুর্গাপূজায় কুমারীপূজার প্রচলন থাকলেও পরবর্তীতে এ পূজার চল একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ পুনঃপ্রচলন করেন বেলুর মঠে।
 
ভারতবর্ষের সন্ন্যাসীরা সাধন পথের বাধা হিসেবে নারীজাতিকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন চিরকাল। স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু অত্যন্ত সচেতনভাবে নারীজাতির কথা চিন্তা করেছেন, কারণ যদি নারী ও পুরুষ উভয়ই জীবন সমানভাবে এগিয়ে না যায়, তাহলে দেশ ও জাতির সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন সম্ভব নয়। সাধারণত নারীজাতিকে যথাযথ মর্যাদার দেওয়ার নিমিত্তে শক্তিরূপে পূজা করাই এই কুমারীপূজার উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য।
 
সনাতন ধর্মের অন্যতম গ্রন্থ বেদ, পুরাণ তন্ত্র ও ভিন্ন ভিন্ন দার্শনিক শাস্ত্রগ্রন্থসমূহে যত প্রকার সাধনা, অনুভব ও অভিজ্ঞতা আছে; হিন্দু ধর্ম তার যুগ-যুগান্তরব্যাপী তত্ত্বান্বেষণের সুমহান ইতিহাসে যত দেব-দেবীর সাধনার প্রবর্তন করেছেন দুর্গাপূজায় তার পূর্ণ সমন্বয় ঘটেছে। এই সমন্বিত দুর্গাপূজার অঙ্গপূজারূপে কুমারীপূজা আমাদের কাছে এক গভীর তত্ত্বের দ্বারোদ্ঘাটন করে। দুর্গাপূজা, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা, অন্নপূর্ণাপূজা এবং কামাখ্যার শক্তিক্ষেত্রেও কুমারী পূজার প্রচলন আছে। বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালের কোনো কোনো পূজামণ্ডপে কুমারীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। রজঃপ্রাপ্ত হয়নি এমন সুলক্ষণা কুমারীকে দেবীর মতো করে সাজিয়ে মাতৃজ্ঞানে পূজা করা হয়।
 
শারদীয় দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় কুমারীপূজা। অষ্টমী তিথিতে অষ্টমীপূজা ছাড়াও রাতে অনুষ্ঠিত হয় সন্ধি পূজা। অষ্টমীর শেষ নবমীর শুরু এই সন্ধিক্ষণে অনুষ্ঠিত হয় বলে এ পূজার নাম সন্ধিপূজা। যে মণ্ডপে কুমারীপূজা হয় সেখানে একই দিনে অনুষ্ঠিত হয় তিনটি পূজা। দিনের বেলা অষ্টমী বিহিত পূজা আর কুমারীপূজা, রাতে সন্ধিপূজা। তবে বসন্তকালে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজা তথা বাসন্তীপূজায় কুমারীপূজা হয় না।
 
যোগিনীতন্ত্রের বর্ণনানুসারে কুমারীপূজার প্রচলন হলো এভাবে- ব্রহ্মাশাপে মহাতেজা বিষ্ণুর দেহে পাপ সঞ্চার হয়েছিল। সর্বজ্ঞ বিষ্ণু সেই পাপে প্রপীড়িত হয়ে হিমাচল সন্নিধানে গমনপূর্বক তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন এবং সেই পাপের ক্ষয়কারী মহাকালী অষ্টাক্ষরী মহাবিদ্যা দশ হাজার বছর পর্যন্ত জপ করেছিলেন। ফলে বিষ্ণুর তপস্যায় মহাকালী খুশি হন।
 
দেবীর সন্তোষ মাত্রেই বিষ্ণুর হৃদ্পদ্ম হতে সহসা ‘কোলা’ নামক মহাসুরের আবির্ভাব হয়।
 
অনতিকাল মধ্যে সেই কোলাসুর ইন্দ্রাদি দেবগণকে পরাজিত করে অখিল ভূ-মণ্ডল, বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠ এবং ব্রহ্মার কমলাসন প্রভৃতি হরণ করেন। তখন পরাজিত বিষ্ণু ও দেবগণ ‘রক্ষ’ রক্ষ’ বাক্যে ভক্তিবিনম্রচিত্তে দেবীর স্তব শুরু করেন। বিষ্ণু আদি দেবগণের স্তবে সন্তুষ্টা দেবী বলেন- “হে বৎস, বিষ্ণো! আমি আধুনা কুমারীরূপ ধারণ করে কোলানগরী গমনপূর্বক অসুরকুলবর্বর কোলাসুরকে সবান্ধবে নিহত করব। ” করেনও তাই। সেই থেকে দেব-গন্ধর্ব, কিন্নর-কিন্নরী, দেবপত্মীগণ সকলে সমবেত হয়ে কুসুম-চন্দন-ভারে কুমারীর অর্চনা করে আসছেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহাশ্বরাদি এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবাই নিজ নিজ গৃহে কুমারীপূজায় প্রবৃত্ত হলেন। এই হলো যোগিনীতন্ত্র অনুসারে কুমারীপূজার উদ্ভব।
 
এক এক বছরের কন্যাদের এক এক নামে পূজা করার বিধান রয়েছে। যেমন- এক বছরের কন্যার নাম সন্ধ্যা, দুই বছরের কন্যার নাম সরস্বতী, তিন বছরের কন্যার নাম ত্রিধামূর্তি, চার বছরের কন্যার নাম কালিকা, পাঁচ বছরের কন্যার নাম সুভাগা, ছয় বছরের কন্যার নাম উমা, সাত বছরের কন্যার নাম মালিনী, আট বছরের কন্যার নাম কুব্জিকা, নয় বছরের কন্যার নাম কালসন্দর্ভা, দশ বছরের কন্যার নাম অপরাজিতা, এগারো বছরের কন্যার নাম রুদ্রাণী, বার বছরের কন্যার নাম ভৈরবী, তের বছরের কন্যার নাম মহালক্ষ্মী, চৌদ্দ বছরের কন্যার নাম পীঠনায়িকা, পনের বছরের কন্যার নাম ক্ষেত্রজ্ঞা ও ষোল বছরের কন্যার নাম অম্বিকা।
 
বৃহদ্ধর্মপুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী দেবতাদের স্তবে প্রসন্ন হয়ে দেবী চণ্ডিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে দেখা দিয়েছিলেন। দেবী ভগবতী কুমারীরূপেই আখ্যায়িত। তাঁর কুমারিত্ব মানবীভাব বোঝা খুবই কঠিন। কারণ তিনি দেবতাদের তেজ থেকে সৃষ্টি। শিবের ঘরণী হয়েও তিনি কুমারী।

পণ্ডিত যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বলেন- যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ কুমারীকে ভগবতীর অংশ বলেছেন। শ্রীমা সারদাদেবীকে ষোড়শীরূপে পূজা করা সেই ভাবেরই অংশ এবং এভাবে সাধনার শেষে শ্রীরামকৃষ্ণ ষোড়শীরূপণী জগন্মাতার শ্রীচরণে তাঁর সর্ববিধ সাধনার ফল সমর্পণ করেন।

কুমারী সম্বন্ধে এসব প্রশস্তির দ্বারা এটাই বোঝা যায়, কুমারী দেবী ভগবতীর অতি সাত্ত্বিক রূপ। জগন্মাতা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্ত্রী হয়েও চিরকুমারী। সেজন্য প্রত্যেক শক্তিপীঠেই কুমারীপূজার রীতি প্রচলিত আছে।
 
দুর্গাপূজায় কুমারীপূজার দিন সকালে পূজার জন্য নির্দিষ্ট কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয় এবং ফুলের গয়না ও নানাবিধ অলঙ্কারে তাকে সাজানো হয়। পা ধুয়ে পরানো হয় আলতা, কপালে এঁকে দেওয়া হয় সিঁদুরের তিলক, হাতে দেওয়া হয় মনোরম ফুল। কুমারীকে মণ্ডপে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে তার পায়ের কাছে রাখা হয় বেলপাতা, ফুল, জল, নৈবেদ্য ও পূজার নানাবিধ উপাচার। তারপর কুমারীর ধ্যান করতে হয়। প্রতিমায় দেবীর পূজাতে আংশিক ফল হয়, কিন্তু কুমারীতে দেবীর প্রকাশ উপলব্ধি করে তার পূজায় পরিপূর্ণ ফল পাওয়া যায়।

যাগ-যজ্ঞ-হোম সবই কুমারীপূজা ছাড়া সম্পূর্ণ ফলদায়ী নয়। কুমারীপূজায় দৈব-ফল কোটিগুণ লাভ হয়। কুমারী পুষ্প দ্বারা পূজিতা হলে তার ফল পর্বতসমান। যিনি কুমারীকে ভোজন করান তার দ্বারা ত্রিলোকেরই তৃপ্তি হয়। দেবী পুরাণমতে, দেবীর পূজার পর উপযুক্ত উপাচারে কুমারীদের ভোজনে তৃপ্ত করাতে হবে, তবেই জগতে কল্যাণ।
 
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ
 
বাংলাদেশ সময়: ১২৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।