ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আমাদের দেশের বন, জলাশয়গুলো জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ

ইশতিয়াক উদ্দীন আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৩ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৪
আমাদের দেশের বন, জলাশয়গুলো জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ইশতিয়াক উদ্দীন আহমেদ, আলোকচিত্র: মোহাম্মদ আরজু

আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ‍অর্জন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাকিস্তানের ইউনিভার্সিটি অব পেশোয়ার থেকে। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন থেকে ‘ফরেস্ট ইনভেনটরি এবং ম্যানজমেন্ট’-এর উপর আবারও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।

ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান বন সংরক্ষক।

২২ মে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবসের প্রাক্কালে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বাংলাদেশের জীব সংরক্ষণ, পরিবেশ, এ বিষয়ে আইইউসিএনের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয় উঠে আসে কথোপকথনে। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম-এর পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নেন ফিচার এডিটর ফারুক আহমেদ


বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম: বনজঙ্গল তো কমে যাচ্ছে, জলাশয় বিলীন হচ্ছে— এটি বন্যপ্রাণীদের জীবন-যাপন বা বংশবিস্তারে কতটুকু প্রভাব ফেলছে?

ইশতিয়াক উদ্দীন আহমেদ: বন্যপ্রাণির আবাস স্থল বন বা জলাশয়। সেগুলো ধ্বংস বা সংকুচিত হলে অবশ্যই তার প্রভাব পড়বে এবং ইতিমধ্যে তার প্রভাব পড়ছে। বন্যপ্রাণি বনে থাকে। বন কোনো একক উদ্ভিদ দিয়ে সৃষ্টি নয়, এটি বিভিন্ন উদ্ভিদের সামগ্রিক মিশ্রণ (Total Composition)। যেমন উঁচু বৃক্ষ আছে, তারপর মধ্যম উচ্চতার বৃক্ষ আছে, তার নিচে আরেকটি স্তর আছে এবং সর্বশেষ লতাগুল্ম ও ঘাস আছে। তারপরও কিন্তু আরেকটা মিশ্রণ থাকে যেটার সাথে মাটির (soil) এর সম্পর্ক আছে। এখন একটা বন সৃষ্টির সাথে এসবগুলোই কিন্তু সম্পৃক্ত। এখন যদি বলি, বড় গাছ প্রথমে ধ্বংস হচ্ছে। গাছ ধ্বংসের সাথে কিন্তু আরগোরিয়াল বা যারা কোনোদিনই মাটিতে নামে না এ ধরনের প্রাণিগুলোও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যেমন ধরা যাক উল্লুক, শকুন এসব। তারপর মধ্যম উচ্চতার বৃক্ষের সাথে সম্পর্কিতও কিছু প্রাণি আছে এবং একদম ঘাস বা লতাগুল্মের সাথে কিছু প্রাণির সম্পর্ক আছে। আবার অনেক কীটপতঙ্গ আছে যেগুলো এসব প্রাণির খাদ্যচক্রেরই অংশ। এখন দেখা যাচ্ছে যে যদি কোনো একটি স্তর না থাকে তবে পুরো খাদ্যচক্রটিই ধ্বংস হয়ে যাবে।

আমাদের উচ্চবৃক্ষগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে যে মধ্যম সারির গাছগুলোও জ্বালানীর কাজে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ এখন পুরো বনটাই অনেক ক্ষেত্রে ন্যাড়া হয়ে গেছে। ফলে সেখানে যে ধরনের প্রজাতি রয়েছে সেটা যদি তার একমাত্র আবাসস্থল হয় তখন হয়ত তাকে সেখান থেকে স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। তারপরও সে যেখানে আবাস বদল করছে সেটাও যদি সংকুচিত হয়ে যায় তাহলে শুধু বন্যপ্রাণি নয়, উদ্ভিদও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা তৈরি হয়। বন হোক বা জলাশয় হোক দুটো ধ্বংস হওয়ার ফলেই বন্যপ্রাণি বিলুপ্ত হচ্ছে।


সুন্দরবনের অভয়ারণ্য। যদিও নেই অভয়ারণ্যের সীমারেখা। মানুষ নির্বিবাদে ঢুকে যাচ্ছে বনের গভীরে। ভীতসন্ত্রস প্রাণিদের অভয় দেবে কে? আলোকচিত্র: সংগ্রহিত

বাংলানিউজ:
বনজঙ্গল বা জলাশয় কমে যাওয়া শুধু নয়, পরিবেশ দূষণের ফলেও প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ছে প্রাণিকূল। এক্ষেত্রে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত?

ইশতিয়াক: এরপর আছে পরিবেশ দূষণের বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের যে কথা আমরা বলে থাকি সেটা সম্পূর্ণই মনুষ্য সৃষ্ট, এতে কোনো সন্দেহ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের যে কারণগুলো সেগুলো আমাদের সৃষ্ট নয়, কিন্তু আমার তার ভুক্তভোগী। এছাড়া আর কিছু কারণ, যেগুলো আমরা সৃষ্টি করছি, যেমন বন কাটা বা অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে বন সংকুচিত হচ্ছে। এছাড়াও আরো কিছু দূষণ আছে যেমন, পানিবাহিত বিভিন্ন শিল্পকারখানার যে বর্জ্য, নগরায়নের ফলে যেগুলো হচ্ছে। অনেকে মনে করতে পারেন, সেটা তো নগরে হচ্ছে; কিন্তু সেগুলো তো পানিবাহিত হয়ে অনেকদূর চলে যাচ্ছে। এর ফলে জলজ যেসব উদ্ভিদ আছে সেগুলো সংক্রমিত হচ্ছে। এখন কিছু আগে যে খাদ্যচক্রের কথা বললাম। কিছু প্রাণি আছে যেগুলো জলজ উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। তারাও সমানভাবে সংক্রমিত হচ্ছে।
 
আমাদের দেশের বন, জলাশয়গুলো জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। এখানে যে সব সম্পদ (resource) রয়েছে সেগুলোর উপর আমাদের জনগণ জীবনজীবিকার দিক দিয়ে নির্ভরশীল। এর ফলে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ অতিরিক্ত আহরণ তো রয়েছেই সেই সাথে যেসব দূষণ প্রক্রিয়া হচ্ছে সেগুলোর কারণেও এসব সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। এতে অনেকপ্রাণি হয়ত চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।

প্রাণিগুলোর আবাসস্থল নষ্টের ফলে নানা জায়গায় তাদের অভিবাসন করতে হচ্ছে। হয়ত তাদের আবাসস্থলগুলো সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এগুলোর সাথে যে প্রাণিচক্র/খাদ্যচক্র জড়িত, যেমন জলাভূমির কথা যদি বলি, সেখানে যদি দূষণ হয় তবে মাছের আয়ু যদি কমে যায়, প্রজনন যদি বংশবৃদ্ধি না হয়, তবে সেটা কিন্তু অর্থনীতির উপরও একটা বিশাল চাপ সৃষ্টি করবে। আবার সেই সাথে যদি সেই প্রজাতিটি কমে যায়, যেমন চিতল মাছের কথা বলা যায়—একেবারেই কমে গেছে, তারপর আকারও অনেক ছোট হয়ে গেছে—এগুলো ছোট হওয়ার কারণ আছে। ছোট হওয়ার কারণ তার বিচরণ পরিধি যেটা ছিল সেটা সম্পূর্ণই সংকুচিত হয়েছে, তারপর তার আবাসস্থল যেটা সেটাও সংকুচিত হয়েছে।

শুধুমাত্র বনজঙ্গল নয়, আমাদের নদীপ্রণালীতে (River system) কার্প নামের যে মাছ, এরা ডিম পাড়ার জন্য অভিবাসন (migrate) করে। তার অভ্যাসের যে পরিবর্তন এটা তার জীবনচক্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই ডিমগুলো যখন বাচ্চা হয়ে ফোটে এগুলো সাধারণত ছায়াচ্ছন্ন অথবা অগভীর পানিতে চলে যায়। সেখানে বড় হয়ে সেগুলো আবার বর্ষাকালে নদীতে নেমে আসে। এখন সেগুলোও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেখানে সার, কীটনাশক, রাসায়নিক ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে যে প্রাণিগুলোর উপর জনগণ অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল ছিল তারা যদি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে আমরা যে খাদ্যনিরাপত্তার কথা বলি সেটার ক্ষেত্রে অবশ্যই একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এবং তার বিশাল একটা প্রভাব পড়বে।


অফুরন্ত জীববৈচিত্র্যের কারণে বিভিন্ন ঋতুতে বাংলাদেশে অসংখ্য প্রজাতির পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। দিন দিন পরিযায়ী পাখির আগমনও কমে যাচ্ছে। আলোকচিত্র: সংগ্রহিত

বাংলানিউজ:
এসব ঘটনা প্রাণিকূলের ভবিষ্যৎকে বেশিরকম সংকটের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। তাদের পরিবেশ সহনীয় মাত্রায় রাখার জন্য কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

ইশতিয়াক: পরিবেশ, জলবায়ু, প্রাণিবৈচিত্র্য প্রভৃতি বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগই সবচেয়ে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। সরকারের তো বিশাল বিভাগ (Department) রয়েছে, বনের জন্য বনবিভাগ রয়েছে, জলাশয়ের জন্য যদিও জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রিত দপ্তর রয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে। যে পরিমাণের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা হওয়ার দরকার ছিল, সেটা হচ্ছে না। মৎস্য-সম্পদের জন্য হ্যাচারি বিভাগ রয়েছে। সরকারের বিভাগ রয়েছে ঠিকই কিন্তু যথাযথ সমন্বয় নেই। এবং তাদের প্রয়োজনীয় সক্রিয়তাও দেখা যাচ্ছে না। আবার যথাযথ নীতিমালা প্রণয়ন, অর্থায়ন এসবেরও অভাব রয়েছে। যেমন বাংলাদেশে বনায়নের একটা সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বনায়ন করতে গেলে অর্থের প্রয়োজন। আবার শুধু অর্থের জোরে বনায়ন করলেও সেই বনায়ন টিকবে কিনা সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। আমরা অনেক কার্যক্রমই বাস্তবায়ন করছি, কিন্তু সেটা দেখা যাচ্ছে টেকসই হচ্ছে না। টেকসই না হওয়ার অনেক কারণ আছে। প্রথমেই ব্যবস্থাপনার কথা বলতে হয়। দ্বিতীয় হচ্ছে যে সম্পদগুলোর উপর জনগণ নির্ভরশীল, তাদের একটি দ্রুত প্রাপ্তি (return) দরকার। সেটা হয়ত সেই পরিপক্বতায় (machurity) পৌঁছানোর আগে, অথবা ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই সেটা গোলায় (harvest) উঠে যাচ্ছে। এসব কারণে জনগণকে সাথে নিয়েই যে ব্যবস্থাপনা করতে হবে, এতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা জনগণেরও উপলব্ধি করার মতো অবস্থায়ও যাচ্ছে না। আবার যারা এই ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদেরও হয়ত সেটা সেই পর্যায়ে নেওয়ার সুযোগ হচ্ছে না। অর্থাৎ দুটোর মাঝে যে একটা সমন্বয়ের প্রয়োজন, সেটি হয়ত ঠিকঠাক মতো হচ্ছে না।

বাংলানিউজ: একটা সময় বাংলাদেশ পরিযায়ী পাখিদের বিশেষ পছন্দের জায়গা ছিল, এখন তা হ্রাস পাচ্ছে। পাখি কম আসতে শুরু করেছে, এটাও কি পরিবেশ বিপর্যয়, শিকারীদের পাখি হত্যা, সচেতনার অভাব ইত্যাদির জন্যই ঘটছে?

ইশতিয়াক: পরিযায়ী পাখি হোক আর যে কোনো বন্যপ্রাণিই হোক সব প্রাণিই কিন্তু প্রথমে দেখে তার নিরাপত্তা। সেখানে যে বিচরণ করবে যে আবাসস্থলে যাবে সে স্থান নিরাপদ কিনা। এটি কিন্তু সে বুঝতে পারে। তারপরে সেখানে তার খাদ্য, তার আবাসস্থলটি ঐরকম কিনা, যেখানে সে বিচরণ করতে পারবে, খাদ্য যোগাড় করতে পারবে, তার সাথে যদি বাচ্চা থাকে সেই বাচ্চাকে বড় করতে পারবে—এগুলো হচ্ছে পরবর্তী বিবেচনা। পরিযায়ী পাখি যখন আসে, একটি জায়গায় যখন সে অবতরণ করে, বিচরণ করে, তারা কিন্তু তাদের সেন্স থেকেই ধরে নেয় যে এটা নিরাপদ। এবং সে যদি নিরাপদ বোধ করে তবে পরবর্তী বছরগুলোতে দেখা যাবে যে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পাখির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। আর যেখানে সে নিরাপদ বোধ করছে না, সেখানে কিন্তু পাখির সংখ্যা কমে যাবে। এসব কিন্তু তৎপরতার উপর নির্ভর করে। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেমন টাঙ্গুয়ার হাওর। টাঙ্গুয়ার হাওরে এক সময় কিন্তু প্রচুর শিকার হতো। এর ফলে কিন্তু সেখানে পরিযায়ী পাখির আগমন অনেক কমে গিয়েছে। সেখানে যখন এখন নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে, যখন তারা বুঝতে পেরেছে যে জায়গাটা তাদের জন্য নিরাপদ, শিকার অনেকাংশেই বন্ধ হয়ে গেছে। বন্দুকের শিকার বন্ধ হয়ে গেছে, হয়ত ফাঁদ দিয়ে দুয়েকটি শিকার হয়, কিন্তু বড় আকারের শিকার একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। এতে এখন কিন্তু ওখানে পাখির প্রজাতিভিত্তিক সংখ্যাও বেড়েছে এবং সার্বিক সংখ্যাও বেড়েছে। পাখির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের। এর সাথে যারা যুক্ত, বা আশেপাশের জনগণের দায়িত্ব কিন্তু এসব পাখির আবাসস্থল সৃষ্টির সুযোগ করে দেওয়া। এখন এটা জনগণ হয়ত অনেক সময় বোঝে না। এর ফলে অনেক সময় পাখি ধরে তারা বিক্রি করে। বিক্রি করার কারণটাও কিন্তু চাহিদা। এটা যে মূল্যে বিক্রি করা হয় সেটা কিন্তু শহরের মানুষ ছাড়া কিনতে পারে না। এখন এসব শহুরে মানুষ যদি সচেতন না হয়, এসব বন্যপ্রাণি খেতেই বা হবে কেন, এই বোধ যদি তাদের মধ্যে তৈরি হয়। তবে স্বাভাবিকভাবেই এসব পাখির সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে।


বাংলাদেশের হাওড়, জলাশয়। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’…। আলোকচিত্র: সংগ্রহিত
 
বাংলানিউজ: বন্যপ্রাণিদের অভয়ারণ্য বলতে যা বোঝায়, তাও তো আমাদের নেই। তাছাড়া পর্যটন বা সম্পদ আহরণের নামে বনের ভেতর মানুষের অবাধ বিচরণ প্রাণিদের স্বাভাবিক বিস্তারে কি প্রভাব ফেলছে? এক্ষেত্রে কি কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?

ইশতিয়াক: ইকো ট্যুরিজমও পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে একেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেমন সিলেট অঞ্চলের মৌলভীবাজারের লাউছড়া অথবা সুন্দরবনের যেসব অভয়ারণ্য আছে এসবের কথা বলা যায়। পর্যটকরা এসব অঞ্চলের কতটুকু যায়গায় বিচরণ করে, লাউছড়া হচ্ছে ১২৫০ হেক্টরের একটা বন। এই বনে প্রথম দিকে কয়েকটা ট্রেইল আছে বা মানুষ যায়। এর বেশি কিন্তু মানুষ যায় না। কিন্তু তারপরেও যতটুকু যায়, এতটুকুই যদি নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে কিন্তু খুব একটা ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা থাকে না। পর্যটনের মাধ্যমে কিন্তু আরেকটি বিষয় অর্জন করা যায়, সেটি হচ্ছে মানুষের একটি সহমর্মিতা। যদি স্বাভাবিকভাবেই আজকে লাউয়াছড়ার কোনো ক্ষতি হয়, লাউয়াছড়ায় একবার যারা গিয়েছিল, বা লাউয়াছড়ার বনকে যারা ভালোবাসছে, তারা কিন্তু সবাই সোচ্চার হবে। প্রাকৃতিক পর্যটনের এটি কিন্তু একটি ইতিবাচক দিক। মানুষকে বনের কাছে নিলে তার যে জ্ঞান হবে, তার যে সহমর্মিতা হবে, এটি তাকে বলে শেখানো যাবে না। অতএব ইকো-ট্যুরিজম খারাপ কিছু নয়; যদি তা নিয়ন্ত্রিত হয়। আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায়, যেমন সুন্দরবন—সুন্দরবনে মানুষ যায় কিন্তু এখনো অতটা নিয়ন্ত্রিত নয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে দেখা যায় যে, পর্যটকরা যে স্পটে যাচ্ছে সেই স্পটগুলো কিন্তু সবগুলো ঘেরা দেওয়া। ওর বাইরে কিন্তু আর পর্যটকরা যেতে পারছে না। তারা এর মধ্যে দাঁড়িয়ে উঁচু জায়গা বা টাওয়ারের মতো উচু স্থাপনায় দাঁড়িয়ে বন দেখতে পারেন। আমাদের এখানেও এই ব্যবস্থাটা করা যেতে পারে। আমাদের এখানে পর্যটকরা নেমে বনের অনেকটুকু চলে যায়, এতে অবশ্যই বন্যপ্রাণির মধ্যে একটা ভীতির সৃষ্টি হয়, আবাসস্থলের সমস্যা হয়, তাদের নিরাপত্তাবোধের ঘাটতি তৈরি হয়। বিশ্বের অনেক জায়গায়ই দেখা যায়, বনাঞ্চলে, বিশেষ করে ম্যানগ্রোভ বনে কোথাও কিন্তু খালি পায়ে কিংবা জুতো পায় দিয়েও নামা যাবে না। তারা মনে করে যদি মাটিতে পদচিহ্ন (footprint) পড়ে, তবে বনের প্রতি ইঞ্চি জায়গায়ই এক ধরনের ইকোসিস্টেম রয়েছে, ফলে সেই ইকোসিস্টেমের ক্ষতি হয়। কক্সসবাজার বিচে আগে জীপ চালানো হত। এতে যে কতধরনের প্রাণি বিনষ্ট হয়েছে। ইদানিং অবশ্য প্রাকৃতিক কারণেই এটা বন্ধ হয়ে গেছে। অতএব পর্যটন যদি নিয়ন্ত্রিত হয় তবে ক্ষতির কিছু নয়।

বাংলানিউজ: আমাদের দেশে প্রাণি রক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা তেমন নেই। আইইউসিএন এ নিয়ে কাজ করছে, কিন্তু তা কি যথেষ্ট বলে মনে হয়? আইইউসিএন বণ্যপ্রাণি রক্ষায় কোন প্রক্রিয়ায় কাজ করে? বাংলাদেশের প্রাণি-জীববৈচিত্রের স্বাভাবিক রক্ষায় কোন বিষয়গুলোর উপর মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন?

ইশতিয়াক: এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের বেশ কিছু সংগঠন কাজ করে, এর মধ্যে আইইউসিএন অন্যতম। এই প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ (regulatory) করে না, সংরক্ষণ (conservation) করে। সংরক্ষণ বিষয়ে যদি কোনো বৈজ্ঞানিক পরামর্শর প্রয়োজন হয় আইইউসিএন তা প্রদান করে। যেসব দাতা প্রতিষ্ঠান এসব ক্ষেত্রে অনুদান দিয়ে থাকে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেসব প্রজাতির সংরক্ষণ করা দরকার এই প্রতিষ্ঠান তাদের বিষয়গুলো তুলে ধরে। যেমন, সম্প্রতিকালে, বাংলাদেশ বনবিভাগের সাথেই হাতির সংখ্যা গণনা করছে এবং সেই সাথে একটা কর্মপরিকল্পনাও তৈরি করছে। যে কর্মপরিকল্পনাটা ভবিষ্যতে বিভিন্ন দাতাদের কাছে বা সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে। আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক, যেমন বাংলাদেশ থেকে শকুন হারিয়ে যাচ্ছে, এটা সবাই জানে। কী কারণে হারিয়ে যাচ্ছে এটাও অনেকে জানে। কিন্তু একটা উদ্যোগ তো নিতে হবে। আইইউসিএন বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বনবিভাগের সাথে এই উদ্যোগটা নিচ্ছে। অর্থায়নের যদি সুযোগ তৈরি হয় তবে এই প্রতিষ্ঠান এধরনের কাজ করতে আগ্রহী। যেমন কর্মপরিকল্পনা তৈরি, অথবা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তৈরি, অথবা কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক পরামর্শ যদি দরকার হয়, আমরা সেটাও দিয়ে থাকি। সুন্দরবনে আমরা একটা ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ওয়াইল্ড এনিমেল, সেটা করার চেষ্টা করছি। আইইউসিএন-এর আরেকটা বড় কাজ হচ্ছে, রেডডাটাগ্রুপ বলা হয় একে, এখন যদিও অবশ্য পশুর করা হচ্ছে, এই প্রকল্পটাও বনবিভাগ এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সাতটা প্রজাতির এসেস্ট করব, যে তারা এখন কোন পর্যায়ে আছে। সেট‍া ক্রিটিক্যাল, নাকি এনডেঞ্জারড, নাকি ভালো আছে, নাকি বিলুপ্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এসব এসেস্ট করে আমরা একটা তালিকা তৈরি করব। এই তালিকা সরকারের হাতে যাবে, বা এখানকার বাংলাদেশে যারা গবেষক আছে তাদের কাছে যাবে। বনবিভাগ এই রেডলিস্ট পেলে তাদের সম্পর্কে একটা ধারণা নিতে। কোন প্রাণির আবাসস্থল কোথায়, বিচরণ কোথায় কোথায়, এগুলো সব বলা থাকবে। অতএব তারা যখন মনে করবে যে, এই প্রাণিটির এখন একটি বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তখন তারা সেটা করতে পারবে। এবং সে সাথে এখানে যারা দাতা আছে, তাদের জন্যও এটা উপকারী হবে, তারা প্রিন্টেট ডকুমেন্ট পাবে, যে এখানে এই বন্যপ্রাণিটির এই অবস্থা এটাকে খুব শীঘ্রই ‌উদ্ধার করা দরকার, উদ্ধার না করলে হারিয়ে যেতে পারে।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।