ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস

সেন্ট মার্টিনস ঘিরে সংরক্ষিত জলাঞ্চল দরকার

মোহাম্মদ আরজু | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৫ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৪
সেন্ট মার্টিনস ঘিরে সংরক্ষিত জলাঞ্চল দরকার

প্রাণ ও প্রকৃতি নিয়ে কিছু বলতে যাবার আগেই একটা বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়। লোকেদের একটা আগাম প্রতিক্রিয়া অনুমান করে নেই।

অধিকাংশ সময়ই সেই প্রতিক্রিয়াটি পাই। সেটা হচ্ছে, ‘ভাই, ষোল কোটি মানুষ, এদের তো খেয়ে পরে বাঁচতে হবে। ’ কিংবা ‘তাই বলে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিতে হবে?’। এই যেমন ধরুন আজকের দিনটিকে জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর বায়োলজিকাল ডাইভারসিটি’ হিসেবে। মানে পৃথিবীতে প্রাণের যে বৈচিত্র্য, তাকে উদযাপনের বিশেষ দিবস হচ্ছে ২২ মে। উদযাপন খুব ভালো ব্যাপার। এটা নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। এবারের দিবসটি গুরুত্ব দিচ্ছে ‘দ্বীপের প্রাণবৈচিত্র্য’কে। এখন যদি সেন্ট মার্টিনস এবং বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অন্যান্য দ্বীপগুলোর প্রাণের বৈচিত্র্যের সুরক্ষার ব্যাপারে আমরা কথা বলি, তবে গতানুগতিক ষোলো কোটি মানুষের বেড়ানো ও মাছ খাওয়ার সমস্যার কথা তোলা হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অজুহাত তোলা হবে।

অথচ প্রাণের যে বৈচিত্র্য রয়েছে দ্বীপগুলোতে, তাকে টিকিয়ে রাখার মধ্যেই রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবি। সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ ও দ্বীপের চারিদিকের জল এলাকার বিচিত্র্য প্রাণের সুরক্ষার মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশবাসীর বেড়ানো ও মাছ খাওয়ার নিশ্চয়তা। অথচ এই দ্বীপগুলো ও এর চারপাশের জল এলাকায় বসতি যাদের, সেইসব প্রাণের ব্যাপারে আমাদের জানাশোনা বিন্দুমাত্রই। সমুদ্র উপকূলীয় দেশ হওয়ার পরও দুর্ভাগ্যজনক, সাগরের সঙ্গে আমাদের অপরিচয় অশেষ। চেনাজানার এ অভাব বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সেই প্রভাব কতটুকু ক্ষতিকর, তা টের পাচ্ছি, গত বছরগুলোতে সেন্ট মার্টিনস ঘিরে সাগরে স্কুবা ডাইভ করে তলদেশের প্রাণবৈচিত্র্যের আলোকচিত্র ও ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে।

দ্বীপটি ঘিরে গভীর সাগর জলের তলদেশে প্রাণ ও প্রকৃতির বিপন্ন অবস্থা। সাগরতলে যেতে হবে না, আপনি সৈকতে বসেও তা আন্দাজ করতে পারবেন। বিপন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ ও ডলফিনের মৃতদেহ হামেশাই সৈকতে দেখতে পাবেন। আর নির্বিচার মাছধরার চর্চার শিকার হয়ে নানা প্রজাতির হাঙরের অপমৃত্যু তো চলছেই। মাছধরার ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকা যখন সাগর থেকে ফেরে, প্রতিদিনই নানা প্রজাতির মৃত হাঙর দেখতে পাবেন। এই শিকারি প্রাণীদের এমন নিধনে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। উপকূলজুড়ে নানা ধরনের নিষিদ্ধ জালের মাধ্যমে নির্বিচার মাছ শিকার ও পরিবেশ বিধ্বংসী পর্যটন চলছে। যদিও সেন্টমার্টিনসহ উপকূলের বেশ কয়েকটি এলাকাকেই সরকার ‘পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা’র আওতায় রেখেছে; কিন্তু জনবল নেই পর্যাপ্ত, তহবিল নেই, পরিবেশ অধিদফতর খুব সামান্যই ভূমিকা রাখতে পারছে।

জেলেরা প্রবাল ও শৈবাল সমৃদ্ধ পাথুরে সমুদ্রতলে জাল পুঁতে রেখে আসে। সর্বশেষ গত মাসেও দ্বীপের উত্তর দিকে সাগরে ডাইভ করতে গিয়ে এমন জালের মুখে পড়েছি আমরা। পাথর বেঁধে জালগুলো এমনভাবে বিছিয়ে রেখে আসা হয়, যাতে পাথুরে সমুদ্রতলের গুহা-গর্ত থেকে বের হতে গেলে প্রাণীরা আটকা পড়ে। সামুদ্রিক কচ্ছপের নানা প্রজাতি বিপন্নপ্রায়, যে কচ্ছপরা সেই প্রাচীন ডাইনোসর যুগ থেকে এ যাবত্ টিকে ছিল। বিশেষত প্রবালের নানা প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে এখান থেকে। সাধারণত দ্বীপের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম, পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণ দিকে থাকা প্রবাল সমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে এভাবে জাল ফেলা হয়। এসব জালে আটকে অন্যান্য প্রাণীর জীবনের সঙ্গে সঙ্গে মারা পরে প্রবালেরাও।



                        মাছ ধরতে পরিবেশ-বিধ্বংসী জালের ব্যবহার ও অন্যান্য দূষণের পরও বেঁছে আছে কিছু কিছু বসতি। ছবি: শরীফ সারওয়ার/ সেভ আওয়ার সি


পৃথিবীর মহাসাগরের মাত্র এক শতাংশ জায়গাজুড়ে আছে প্রবাল। বঙ্গোপসাগরেও সে রকমই। সেন্ট মার্টিনস ঘিরে খুবই অল্প জায়গায় গড়ে উঠেছে প্রবালপ্রাচীর। কিন্তু এ প্রবালই সমুদ্রে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ প্রাণীর বসতি ও খাবার জোগায়। প্রবাল মূলত ‘পলিপস’, অনুজীব। দেখতে চুনাপাথরের মতো এ প্রবাল জমে জমে পাচীর গড়ে তোলে। আশ্রয় দেয় সাগরতলের নানা উদ্ভিদ ও শৈবালকে। অভয়ারণ্য হয়ে থাকে মাছসহ সব প্রাণীর। এরা অক্সিজেনও জোগায় সমুদ্রে। অথচ নির্বিচার আহরণ ও দূষণের কারণে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী ৩০ বছরে বিশ্বের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ প্রবাল নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে বর্তমান অবস্থা চালু থাকলে। এছাড়া আছে সমুদ্রের ফাইটোপ্লাংকটন। আণুবীক্ষণিক এ উদ্ভিদরা একদিকে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ অক্সিজেন জোগায়, অন্যদিকে এক-তৃতীয়াংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়।

এ সামুদ্রিক পরিবেশ যদি সুরক্ষিত রাখতে না পারি আমরা, তবে মানুষের ইতিহাসের এ সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণের যুগে তা মোটেও সুখকর হবে না। বিশেষত বাংলাদেশের মতো নিচু সমতলভূমির মানুষের জন্য। নিজেদের ক্ষতি যা করার তা করতে আর বেশিকিছু বাকি রাখিনি আমরা। আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরার সুযোগ বাদ দিলও নিজস্ব অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমাই দেশের আয়তনের দেড় গুণ, এ যাবত্ মীমাংসিত সীমা কমপক্ষে ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার। অথচ দেশে সামুদ্রিক মত্স্য উত্পাদন সে তুলনায় নামমাত্র। ২০১১-১২ সালে মোট সামুদ্রিক মত্স্য উত্পাদন ছিল মাত্র ৫ লাখ ৭৮ হাজার টন, অথচ অভ্যন্তরীণ চাষ করা মাছের উত্পাদন ছিল ১৭ লাখ ২৬ হাজার টন। গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বে চাষ করা মাছ উত্পাদনে বাংলাদেশ পঞ্চম। অন্যদিকে একই বছরে দেশে কৃষিতে ৪০ লাখ ৪৯ হাজার টন রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ, উপকূলীয় বাংলাদেশের জন্য কৃষি ও মত্স্য চাষের এ পরিস্থিতি এক বিরাট লজ্জার ব্যাপার।

পললভূমির মধ্যে শিরা-উপশিরার মতো বয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলোর মাঝপথে জীবনবিনাশী বাঁধ চালু থাকতে দিয়েছি আমরা। নদী স্বাভাবিক থাকলে এখানে কৃষিতে ভূগর্ভস্থ পানি দরকার হওয়ার কথা নয়। পললভূমিতে পুষ্টি স্বাভাবিক থাকলে রাসায়নিক বিষও লাগবার কথা নয়। সঠিকভাবে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলভাগ ও সামুদ্রিক উত্স থেকে মত্স্য আহরণ করলে ‘আধুনিক’ মত্স্য খামার করে পানীয়জলের উত্স, কৃষিজমি ও বনাঞ্চল নষ্ট এবং স্থানীয় জাতের মাছ নির্বংশ করার দরকার হয় না। কিন্তু নদীর স্বাস্থ্যরক্ষা না করে বিপরীতে নির্বিচার গভীর নলকূপ বসিয়ে আর্সেনিকের বিষ উঠিয়ে এনেছি ওপরে, জ্বালানি তেল ব্যবহার করে সেচকাজ পর্যন্ত চালাতে হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষিতে। কথিত ‘আধুনিক’ কৃষি ও মত্স্য চাষের নাম করে রাসায়নিক সার ও বিষে ছয়লাব করে দিয়েছি জলজ পরিবেশ। অভ্যন্তরীণ স্রোতের পানি পানের অযোগ্য করে তুলেছি। যে বিষ নদী পথে ছড়িয়ে পড়ছে সাগরেও। এ প্রক্রিয়ার প্রভাব সর্ববিনাশী।

উপকূলে সাগরে নানা এলাকায় জলে অক্সিজেনের পরিমাণ দৃশ্যত কমেছে, 'মৃত অঞ্চল' তৈরি হচ্ছে, সেন্ট মার্টিনস ঘিরে সাগরে দেখেছি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রবাল প্রাচীরগুলো প্রাণশূণ্য হয়ে পড়ছে, মাছেদের বসতি ছাড়তে হয়েছে। দ্বীপটি ঘিরে এখন আর আগের মত মাছ পাওয়া যায় না। জেলেরাই এটা এখন বলছে। প্রবাল প্রাচীরগুলোর অবস্থা এতই খারাপ যে এখন আর সময় নেই। তবুও শেষ চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। সেন্ট মার্টিনস ঘিরে যতদূর জল অঞ্চলে প্রবাল কেন্দ্রিক জলজ বসতি আছে, তা শনাক্ত করে সংরক্ষিত জলাঞ্চল ঘোষণা করতে হবে। এই উদ্যোগ সফল হলে ক্রমশ হয়তো এসব জলজ বসতিতে আবার প্রাণবৈচিত্র্য ফিরে আসবে।

ক্রমশ এই সংকট শুধু আর সেন্ট মার্টিনসের থাকবে না, পুরো উপকূলে ছড়াবে ছড়াচ্ছে। পানীয়জলের সংকট, জলজ পরিবেশের দূষণের ফলে স্বাস্থ্যহানি, খাদ্যশস্য ও মাছে বিষ, ম্যানগ্রোভসহ বনাঞ্চল উজাড়, নৌপরিবহনে অচলাবস্থা; এসব ক্ষতির অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা হলে তার আকার কত বিশাল হবে অনুমান করা যায়। কাজেই সেন্ট মার্টিনস ও অনান্য দ্বীপগুলোর প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করে আবার মানুষের বেঁচে থাকার কথা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলা আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। বিচিত্র প্রাণের বসতি হিসেবে পৃথিবী টিকে থাকলে মানুষের প্রাণও বাঁচবে, মানুষ তো এই প্রাণবৈচিত্রেরই অংশমাত্র।


লেখক: সামুদ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণবাদী উদ্যোগ ‘সেভ আওয়ার সি’র সমন্বয়ক
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।