ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপন্যাস

নীল উড়াল: একত্রিংশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৭
নীল উড়াল: একত্রিংশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অসৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

৩১.
এনামুল সিডিটা শক্ত ভাবে প্যাকেট করলো। একটি ছোট্ট চিরকুট লিখে প্যাকেটের মধ্যে ঢুকালো।

এনামুলের মুখ এখন আরও ম্লান। মনে হচ্ছে কে যেন তার মুখের সব আলো কেড়ে নিয়েছে। সে ইন্টারকমে রোকসানাকে ডাকলো।

নীল উড়াল: ত্রিংশ পর্ব

রোকসানা এনামুল স্যারকে এতো মিয়ম্রাণ কখনও দেখে নি। কি হয়েছে স্যারের? স্যারের বন্ধু চলে যাওয়ার পর কেমন মিইয়ে গেছেন লোকটি। রোকসানা তার উপস্থিতি জানান দিল:
-ইয়েস স্যার!
ধ্যান ভাঙল এনামুলের। সে অচেনা কণ্ঠে বললো;
-রুক ডার্লিং তোমাকে একটি ছোট্ট কাজ করতে হবে। আর্জেন্ট।
রোকসানা এখনও স্যারের দিকে অবাক তাকিয়ে আছে। সে বললো:
-কি কাজ স্যার?
এনামুল টেবিলের উপরে রাখা সিডির প্যাকেটটি রোকসানার দিকে ঠেলে দিতে দিতে বললো:
-এটা জরুরি, অন্তরার কাছে পৌঁছাতে হবে।
বাধ্যগতভাবে মাথা নেড়ে রোকসানা বললো:
-ওকে স্যার।
এনামুল রোকসানার দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে বললো:
-সাবধান! অন্তরা ছাড়া অন্য কারও হাতে যেন না যায়।
রোকসানা আশ্বস্ত করলো:
-আপনি দুশ্চিন্তা করবে না স্যার। আমি ঠিক মতোই পৌঁছে দেবো।

চেম্বার ছেড়ে আসার সময় রোকসানা দেখলো স্যারের চোখ চিকচিক করছে। সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো, ‘এই লোকের চোখে জল? অসম্ভব। কার জন্য?‘ রোকসানা কিছুই বুঝতে পারছে না। সে ভীষণ বিভ্রান্ত।  

অন্তরা নিশ্চয় বাসাতেই আছে। রোকসানা গাড়িতে উঠে দেখলো ঢাকার আকাশে শেষ বিকেলের টান। আজ ভিড়ও কিছুটা কম। যেতে বেশি সময় লাগবে না। এনামুল স্যারের মুখ ভেসে এলো। বন্ধু চলে যাওয়ার পর এমন হয়ে গেছেন কেন স্যার? তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে কে জানে? তবে বেশ সিরিয়াস কথা হয়েছে সেটা সে বুঝতে পেরেছে। স্যারের বন্ধু গটগট করে তার বান্ধবীকে নিয়ে চলে গেলেন। আমাকে ‘বাই’ পর্যন্ত বললেন না। রোকসান কিছুটা ক্ষুণ্ন বোধ করছে। স্যারের বন্ধুটিও কেমন? নিঃসঙ্গ যোদ্ধা। কারও সাহায্য নেবেন না। কারও সাহায্য চাইবেন না। অতিরিক্ত সাহসী। ভদ্রলোক ভয়ানক বিপদে জড়িয়ে যাচ্ছেন, এটা সে ঠিকই টের পাচ্ছে। কিন্তু সে কিছুই করতে পারছে না। তার মন বিষণ্ন হয়ে আসছে। কার জন্য? এনামুল স্যারের জন্য? না স্যারের বন্ধুর জন্য? সে আজ বড়ই বিভ্রান্ত। তার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আজ তার মন খারাপের দিন।

সন্ধ্যার মুখে সে অন্তরার বাসায় পৌঁছালো। প্যাকেটটা নিতে নিতে অন্তরা বললো:
-তুমি বসে মায়ের সঙ্গে গল্প করো। আমি আসছি।
অন্তরা প্যাকেট হাতে ওর ঘরে চলে এলো। আস্তে আস্তে প্যাকেটটা খুললো। প্রথমে সে চিঠিটি পড়লো। তার চেহারা বদলে গেছে। ধীরে ধীরে সে অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। টিভিতে সিডি প্লে করার আগে কান পেতে শুনলো ড্রয়িং রুমে মা আর রোকসানা এক মনে আলাপ করছে।
ছোটখালা কপট রাগে বলছেন:
-তোমাদের ব্যাপারই বুঝি না বাপু?
রোকসানা বিনয়ী ভাষায় জানতে চায়:
-কেন খালাম্মা, কি হয়েছে?
ছোটখালা এবার সময় নিয়ে বলেন:
-এই যে তুমি আর অন্তরা। শুধু জানি চাকরি কর। কি চাকরি, কোথায় অফিস, কিছুই জানি না। শুধু কি তা-ই?

ছোটখালা থামলেন। রোকসানার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, মেয়েটি তার কথা শোনার জন্য আগ্রহ ভরে চেয়ে আছে। ছোটখালা আদুরে গলায় বললেন:
-তুমি কে, কোথায় তোমার পরিবার-পরিজন, এটা পর্যন্ত জানি না!
রোকসানা কোমল গলায় বললো:
-আপনারাই আমার স্বজন মা।

‘মা’ ডাকে ছোটখালার ভিতরটা ভিজে গেলো। সন্ধ্যার মায়াবী আলোয়-রাঙা মেয়েটার জন্য বুক হু হু করে উঠছে তার বুক। অন্তরা তো এমন গভীরভাবে ‘মা’ বলে ডাকে না! ছোটখালা ভাবছেন, চিনি না, জানি না, অথচ মেয়েটিকে বড়ই আপন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বুকে জড়িয়ে ধরি। কাছে রেখে দিই চিরদিনের জন্য। তার আশা, অন্তরা আর রোকসানা দু’ বোনের মতো ঘর আলো করে হৈচৈ করে বাড়ি মাথায় করে ঘুরে বেড়াক। তিনি আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে শেষ দিনগুলো কাটিয়ে নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করতে পারতেন। তিনি লম্বা করে একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। হায়! তিনি আছেন একটি মরা বাড়িতে। একা জিন্দা লাশের মতো পড়ে রয়েছেন। অন্তরা সারা দিন কোথায় থাকে কে জানে! বাসায় থাকলেও কি? ঘরের দরজা বন্ধ করে কি সব করে এক গায়েবের মালিক আল্লাহ ছাড়া কেউই বলতে পারবে না। কিছু জিজ্ঞেস করাও বিপদ। মন ভালো থাকলে, হেসে অন্য কথায় চলে যাবে। মন খারাপ থাকলে, বিশ্রী ভাবে কথা বলবে। মেয়েটিকে কিছুতেই বোঝা যায় না। তার চেয়ে রোকসানা মেয়েটি বেশ মিষ্টি। কিন্তু? ছোটখালার বয়সী মন আবার কাঁটার মতো খচ্ করে উঠল। এরা কেউ বিয়ে করছে না কেন? এরা কি ঘর-সংসার করবে না? স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের জগত বানাবে না? সারা জীবন আউল-বাউলের মতো উদাসীন থাকবে?

ছোটখালা রোকসানাকে চা-নাস্তা দিয়েছেন। মেয়েটি কি চমৎকার ভাবে কাপে চুমুক দিচ্ছে। ছোটখালা আবার একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আহা! ছেলেগুলো দেশে আমার সঙ্গে থাকলে এমন একটি লক্ষ্মী মেয়েকে বউ করে ঘরে রেখে দিতাম। হায়! আমার কপাল। সবার ভাগ্যে সব কিছু হয় না। ছোটখালা নিজের দুঃখে কাতর হলেন।

রোকসানার চা খাওয়া শেষ। সে উঠবে উঠবে করছে। বার বার ঘড়ি দেখছে। অন্তরা এখনও তার ঘর থেকে বের হয় নি। রোকসানা ভাবছে, ও কি দরজায় নক করবে? না, থাক। এনামুল স্যার বলেছেন, পাকেটটা জরুরি, পৌঁছাতে হবে। অন্য কারও হাতে যেন না যায়। গোপনীয় কোনও ব্যাপার আছে নিশ্চয়। আসুক অন্তরা। অপেক্ষা করাই ভালো। ঠিক তখনই অন্তরা টাওয়ালে মুখ মুছতে মুছতে এলো। এতোক্ষণ সে যে টিভির সামনে অঝোরে কেঁদেছে, তাকে দেখে সেটা কেউ বুঝতে পারবে না। ওকে এখন অনেক শান্ত ও স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসতে বসতে অন্তরা বললো:
-রোকসানাকে চা-নাস্তা দিয়েছো মা?

রোকসানাই উত্তর দিয়ে উঠল:
-আমি পেট ভরে খেয়েছি। রাতে আর খেতে হবে না।
অন্তরার কথায় ছোটখালা হেসে বললেন:
-কিছুই তো খাও নি তুমি! রাতে খেয়ে যাবে।
অন্তরা চমকে উঠে বললো:
-না মা, ওর কাজ আছে। আজ থাক।
ছোটখালা অবাক হলেন:
-সে কি রে, ও কিছু বলছে না আর তুই না করে দিলি?
এবার কথা বললো রোকসানা:
-কথা দিয়ে গেলাম মা, আরেক দিন এসে প্রাণ ভরে খেয়ে যাবো।
ছোটখালা খুশি হয়ে বললেন:
-মনে থাকে যেন মেয়ে।

রোকসানা এবার উঠবে। অন্তরা চোখের ইঙ্গিতে সায় দিল। সে বললো:
-মা, আমি রোকসানাকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।
দু’জন ঘর থেকে বাইরে এসে বাগানে করমচা গাছটার নিচে দাঁড়ালো। বেশ খানিকক্ষণ কেউ কোনও কথা বললো না। অন্তরা এক সময় বললো:
-আঙ্কেলকে বলো, আমি তার ম্যাসেজ পেয়েছি। যা বলার তাকেই আমি পরে জানাবো।

রোকসানা মাথা ঝাঁকালো। যে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কিন্তু সে যেতে পারল না। টের পেল, ওর কাঁধে হাত রেখেছে অন্তরা। অন্তরা কেমন গলায় বললো:
-রোকসানা আরেকটু দাঁড়াও, প্লিজ।
রোকসানা কিছুটা বিব্রত ও অবাক হয়ে অন্তরার দিকে তাকালো। এই মেয়ে তো এমন তরল কণ্ঠে কথা বলে না। এতো ইন-ফরমালিও স্পর্শ করে না। কি হয়েছে অন্তরার? সে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকে।
অন্তরা আবার বলে:
-রোকসানা, তোমাকে একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি?
ভীষণ চমকে উঠল রোকসানা। এতো দিন এক সঙ্গে আছে, কাজ করছে, কখনও তো ব্যক্তিগত বিষয় উঠে আসে নি? আজ কি হলো? রোকসানা বোকার মতো অন্তরার দিকে চেয়ে থাকে।
অন্তরা এবার সরাসরি জানতে চায়:
-ভাইয়াকে তোমার কেমন লাগে।

কেঁপে ওঠে রোকসানা! অন্তরার কথায়। ওর ভাইয়ার কথা শুনে। তার সর্বাঙ্গে একটি অদ্ভুত শিহরণ জেগে ওঠে। সে কথা বলতে পারে না। মুখ নিচু করে মাটির দিকে চোখ রাখে।

অন্তরা আলতো করে রোকসানার চিবুক হাত দিয়ে স্পর্শ করে। তারপর আস্তে আস্তে ওর মুখটি উপরের দিকে তোলে। রোকসানা এখনও ভারী লাজুক হয়ে আছে। চোখ খুলতে পারছে না। সে অন্তরার গলা শুনতে পায়:
-কিছু বলতে না চাইলে বলো না। আমি বুঝে গেছি। চোখ মেলো।

ধীরে ধীরে চোখ মেলেই ভয়ে একদম কুকড়ে গেল রোকসানা। কাকে দেখছে সে? সাপের মতো দু’টি কুতকুতে চোখে কে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে? অন্তরার জিব বের হয়ে গেছে। ওর নাক দিয়ে হিস হিস করে জান্তব শব্দ হচ্ছে। রোকসানা আর এক দণ্ড এখানে দাঁড়াতে পারছে না। মনে হচ্ছে কে যেন তার গলা টিপে ধরেছে। ত্রস্ত পায়ে পালিয়ে গেলো সে।

রোকসানা চলে যাওয়ার পর অন্তরার মনে হলো, ভাইয়া এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। সে ভাইয়ার কানে বিড় বিড় করে বলছে, ‘যে দিন তোমাকে ঠিক ঠিক বুঝতে পারবো আর তখন তোমাকে যদি আবার আগের মতো একেলা পাই, তাহলে আমি ছাড়া তুমি আর কারও হতে পারবে না। ’

ঘরে ফিরে না এসে অন্তরা রাতের আঁধার ভেদ করে কোথায়ও চলে গেলো!

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

উপন্যাস এর সর্বশেষ