ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপন্যাস

নীল উড়াল: ঊনত্রিংশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৭
নীল উড়াল: ঊনত্রিংশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অসৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

২৯.
মার্গারেট সফর বাতিল করে ঢাকাতেই রয়ে গেছে। জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে ছুটি নিয়েছে সে।

আমাকে নিয়ে কয়েক দিন হাসপাতালে টানাটানি করায় সে বেশ ক্লান্ত। আমি চোখ মেলায় সে ক্লান্তি মুছে মুখে হাসির আভা মিশিয়ে বললো:
-বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। থ্যাঙ্কস গড। নাউ য়্যু আর সেফ।

নীল উড়াল: অষ্টবিংশ পর্ব

হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিজেকে মনে হলো এক সাদা আলখাল্লা পরিহিত সত্ত্বা, যে ‘ঘুমের বিছানা ছেড়ে’ চলে যেতে চাচ্ছে এক নম্র রমণীর শাওনের আমন্ত্রণে। আমি মার্গারেটকে দেখি। সে নিবিড় তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

ঘরে ক’দিনে পত্রিকা জমে আছে। আমি হাত বাড়িয়ে একটি পেপার নিতে চেষ্টা করতেই বাধা দিয়ে মার্গারেট বললো:
-এখন না। আরেকটু সুস্থ হয়ে সব পড়তে পারবে। আমি ডে বাই ডে সব পত্রিকা সাজিয়ে রেখেছি। বাই দ্য ওয়ে, তুমি তো এখন হিরো। কাগজে হেডিং দিয়েছে, ‘মাদকের বিরুদ্ধে বলায় গবেষক গুলিবিদ্ধ’। আরেকটি প্রধান শিরোনাম হলো, ‘মাদক সিন্ডিকেটের তথ্য পেয়েছেন এক গবেষক’। আমরা এতোদিন যা করতে পারি নি মাদকের বিরুদ্ধে, তুমি এক সেমিনারে তার চেয়ে অনেক বেশি করেছো।

আমি হাসলাম। মার্গারেটের প্রশংসা মানে প্রকৃত প্রশংসাই। এর কোনও উত্তর হয় না।
মার্গারেট জানালো:
-তোমার উপর আক্রমণ করার নিন্দা জানিয়েছে অনেকগুলো মাদকবিরোধী সংগঠন। শহরে কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিলও হয়েছে। অতএব তোমার আপাতত রেস্ট ও সুস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার ছাড়া আর কিছু না করলেও হবে।
মার্গারেট কথা বলা কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে আবার বললো:
-অবশ্য তুমি ইচ্ছে করলে তোমার পাণ্ডুলিপি নিয়ে ভাবতে পারো এবং তোমার বই প্রকাশের ব্যাপারে প্রকাশক ও এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো। আমাকে বললে, তোমার মেইল এবং চিঠি চালাচালির কাজ করে দিতে পারি।
আমি জানি মার্গারেট সেটা খুবই সুচারুভাবে পারবে। আমার ধারণা, যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, সে কানেকটিভিটির মধ্যেই থাকে। ওকে মেইল করে আমাকে কখনও উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হয় নি।

গত কয়েকটি দিন ঘুমের ঘোরে কেটে গেছে। চিকিৎসার জন্য বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে। আমি এখন যথেষ্ট সুস্থ। বার বার চলে যেতে চাচ্ছি। সব শুনে ডাক্তার জানালেন যে, ‘আমার কপাল ভালো। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। বুলেট সঠিকভাবে এসে লাগলে আমার মগজ বেরিয়ে যেতো। তখন বাঁচার আশা ছিল না। ’ চিকি‍ৎসকদের ধন্যবাদ দিলাম। এখন যত তাড়াতাড়ি হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেওয়া যায়, ততই ভালো। কাজ গুছিয়ে এখন ফিরে যাওয়ার পালা। চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপি তৈরি করে ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সেসব কাজ বাংলাদেশের বাইরে কানাডা গিয়েও করা যাবে।

আমি ভাবছি, দেখতে দেখতে ছয় মাস কোথা দিয়ে যে চলে গেলো! কাজে মগ্ন থাকলে সময় টের পাওয়া যায় না। দ্রুতই ফুরিয়ে যায়। অলস বসে থাকলে সময় কাটতেই চায় না। সময়ও কাজ বোঝে, আলস্য বোঝে।
মার্গারেটের মুখ দেখে আমার মনে হলো, সে কিছু বলতে চায়। ঘরে কেউ নেই। এই সুযোগে আমি বলি:
-তুমি কি কিছু বলতে চাচ্ছ?
মার্গারেট সম্মতি জানাল:
-হু।
কিন্তু সে কিছু বললো না। আমি আবার বলি:
-বলো, কি বলতে চাও?
সে শান্ত গলায় বললো:
-ভাবছি তোমার এই শারীরিক-মানসিক অবস্থায় কথাটা বলবো কি-না?
আমি তাকে আশ্বস্ত করে বলি:
-আমি এখন ঠিক আছি। বলো। কোনও অসুবিধা হবে না।
আমাকে দারুণভাবে চমকে দিয়ে সে বললো:
-এনামুল তোমার সুস্থতা কামনা করে ফুল পাঠিয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখ বিস্বাদে বিকৃত হয়ে গেলো। এক দলা তেতো থু থু ডাস্টবিনে ফেললাম। মার্গারেট তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ওর আঙুল আমার চুলে মাছেদের মতো খেলা করছে। এক সময় সে বললো:
-মন খারাপ করো না। পৃথিবীতে নানা ধরনের মানুষ আছে। পৃথিবী বাগানের মতো। ফুল গাছের সঙ্গে আগাছা এবং কাঁটা গাছও আছে।
আমি অতি কষ্টে উচ্চারণ করি:
-আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে এনামুল আমার বন্ধু!

মার্গারেট আমাকে সান্তনা দেওয়ার ভঙ্গিতে পিঠে হালকা টোকা দিল। একই সময় দরজায় টোকার শব্দ পাওয়া গেল। আমরা দু’জনে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। কে হতে পারে? ডাক্তার তো এই মাত্র গেল। ওদের টোকার শব্দ এমন নয়! মার্গারেট বললো:
-ইয়েস। কাম ইন প্লিজ।

ঘরে ডাকাত এলেও মনে হয় এতোটা ভড়কে যেতাম না। আমাদের চোখ কপালে উঠে এসেছে। সমগ্র আবহাওয়াকে দুষিত করে এনামুল পা টিপে টিপে প্রবেশ করেছে। আমি আর স্থির থাকতে পারছি না। তীব্র ঘৃণায় কঁকিয়ে উঠি:
-তুই! এখানে!
আমার অবজ্ঞা পাত্তা দিল না সে। সোজা বিছানার কাছে এসে কপট গলায় বললো:
-তোর এমন অবস্থা আর আমি না এসে পারি?
আমি আর সহ্য করতে পারছি না। স্পষ্ট ভাষায় বলি:
-না এলেই ভালো হতো। তোর ফুল পেয়েছি। সেটাই যথেষ্ট ছিল।
এনামুল খেঁকিয়ে উঠলো
-তা তো বলবিই। আমাকে তো তুই পরিত্যাগ করেছিল। চাস না আমি আসি। না বলে আমার ফ্ল্যাট থেকে চলে এলি। কিছু বললিও না। আমি তো তোকে ত্যাগ করতে পারি না। তুই আমার বন্ধু।

ওর ভণিতায় গা জ্বলে গেল। আমি চাই সে দ্রুত বিদেয় হোক। সোজাসুজি বললাম:
-কেন এসেছিল বল? আমি জানি মতলব ছাড়া তুই আসবি না। কি চাস?
যাওয়ার বদলে সে আরও জাঁকিয়ে বসলো। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বললো:
-এই তো গুড বয়। সরাসরি কাজের কথা। আমি তোর সঙ্গে লাঞ্চ করতে চাই। ফেয়ার ওয়েল লাঞ্চ। তোর চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। আবার কবে আসিস, কে জানে! আয়, একবেলা এক সাথে খাই।

আমি ঠিক করেই রেখেছি, এনামুলের সঙ্গে দেখা না করে দেশ ত্যাগ করবো না। আমি যে চোরের মতো ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছি না, সেটা জানানোর জন্য হলেও একবার ওর সঙ্গে দেখা করা দরকার ছিল। ভালোই হলো প্রস্তাবটা সে নিজেই দিয়েছে। আমাকে কষ্ট করে কিছু করতে হলো না। আমি মন স্থির করে বলি:
-ঠিক আছে, কবে লাঞ্চে বসতে চাস?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল এনামুল:
-সেটা তুই ঠিক কর। তোর শরীরের অবস্থা বুঝে সময় বল। আমি ফ্রি থাকবো।
আমিও কালক্ষেপণ না করে বলি:
-আমার শরীর এখন ঠিক আছে। যারা আমার ক্ষতি করতে চেয়েছিল, তারা ব্যর্থ ও পরাজিত হয়েছে। আমি বেঁচে আছি এবং সুস্থ আছি।
আমার কথায় এনামুলের মুখ কালো হয়ে গেলো। কণ্ঠস্বর এক ধাপ নিচে নামিয়ে সে বললো:
-তাহলে কবে তুই আসতে চাস?
ওর সঙ্গে যেহেতু একবার বোঝাপড়া করতেই হবে, তাহলে সেটা দেরি করে লাভ কি? আমি বলি:
কাল বা পরশুই চলে আসতে পারি। তোর কোনও অসুবিধা আছে?
এনামুল হাত নেড়ে বললো:
-না, না। আমার অসুবিধা কি? তোর সঙ্গে বসাটা আমার জরুরি প্রয়োজনেই তাড়াতাড়ি হওয়া ভালো। ঠিক আছে চলে আয়। তবে...

এনামুল একটু থামলো। আমার দিকে ভালো করে দেখলো। ঘরের কোণে সোফায় বসে মার্গারেট এক মনে গভীর মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। এনামুল মার্গারেটের দিকেও তাকালো। তারপর সে তার অসমাপ্ত বাক্য শেষ করলো:
...তবে আমার দু’টি শর্ত আছে।
আমি বেশ বিরক্তই হলাম:
-এখানে শর্ত আসছে কেন?
এনামুল বেশ গুছিয়েই বলতে শুরু করলো:
-আসছে আসছে। বসার প্রস্তাবটা যেহেতু আমার, সেহেতু আমার শর্ত ও সুবিধা তোকে দেখতে হবে।
আমি কিছু না ভেবেই বলে ফেলি:
-ঠিক আছে। শুনি, তোর কি শর্ত?
এনামুল বললো:
-শর্ত এক, লাঞ্চ করবি আমার অফিসে। শর্ত দুই, তুই আসবি একা। কাউকে সঙ্গে না নিয়ে।

আমি তার অদ্ভুত শর্তের কিছুই বুঝতে পারছি না। এতো দিন হলো ঢাকায় এসেছি, সে কোনও দিন ওর অফিসে আমাকে ডাকে নি। চা খাওয়ার জন্যও নয়। সে-ই বরং আগ-বাড়িয়ে আমার কাছে চলে এসেছে বা ফোন করেছে। মনে হয়েছে সে তার অফিস-ব্যবসা আমার কাছ থেকে আড়াল করে রাখতে চেয়েছে। আমিও উপযাজক হয়ে সেসবের খোঁজ-খবর নিতে যাই নি। এখন হঠাৎ অফিসে ডাকছে কেন? আর একা যেতে বলছে? কেন? আলোচনাগুলো গোপন রাখার জন্য? নাকি আমাকে একা বাগে পেয়ে কব্জা করার জন্য? আমি ওর দুই শর্তের ব্যাপারে চট করে সায় দিতে দ্বিধা করছি। কি উত্তর দেবো আমি?
মার্গারেটের দিকে তাকালাম। ও কিছু বলছে না। ওর মুখে জমে আছে রাগ, ঘৃণা ও বিরক্তি। সে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি মার্গারেটের মনোভাব বুঝতে পারলাম না। এনামুলের দিকে তাকালাম। সে আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ভাবছি, কিছু ঝুঁকি কি নেবো? কি আছে জীবনে? বহু ঝুঁকি তো নিয়েছি। আরেকটি না হয় নিলাম। আমি শেষ পর্যন্ত মুখ খুলি:
-ঠিক আছে এনামুল। আমি তোর শর্তে রাজি। তোর দু’টি শর্ত মেনেই আমি তোর অফিসে আসবো। একাকিই আসবো।
মার্গারেটের তীব্র কণ্ঠ শোনা গেলো:
-না।
আমি আর এনামুল হতচকিত হয়ে ওর দিকে তাকাই। মার্গারেট ধীরে ধীরে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দৃঢ় পায়ে হেঁটে আমি আর এনামুলের মাঝখানে দাঁড়ালো। তারপর গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বললো:
-না, তুমি একা যাবে না। আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।

এনামুল হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। একবার আমাকে দেখছে। আরেক বার মার্গারেটকে দেখছে। তারপর ভুতগ্রস্ত মানুষের কণ্ঠে বললো:
-ঠিক আছে, মার্গারেট, আপনিও আসুন।
বলে এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না সে। টলতে টলতে চলে গেল। এনামুলকে এমনভাবে ভারসাম্য হারাতে আমি কখনও দেখি নি।  

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

উপন্যাস এর সর্বশেষ