ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

স্কুল শিক্ষক অপহরণ-কাণ্ডের নেপথ্যে যা পাওয়া গেল!

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৫
স্কুল শিক্ষক অপহরণ-কাণ্ডের নেপথ্যে যা পাওয়া গেল!

ফরিদপুর: ফরিদপুরে শংকর বৈরাগী (৪৫) নামে এক স্কুল শিক্ষক অপহরণের তুলকালাম কাণ্ডের তথ্য খুঁজতে গিয়ে নেপথ্যে বেরিয়ে এসেছে তার সঙ্গে একাধিক ছাত্রীর অশ্লীলতার ঘটনা। এ ঘটনায় এক ছাত্রীর সঙ্গে অশ্লীল ছবি আদান-প্রদান, কথাবার্তার তথ্যও বের হয়ে এসেছে।

শিক্ষকের সঙ্গে ওই ছাত্রীর অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগও উঠেছে।  

বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী ছাত্রী পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অভিযোগ দিয়েছে।  

এদিকে অপহরণের ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় গতকাল রোববার (০৯ ফেব্রুয়ারি) মামলা দায়ের করেছেন ওই শিক্ষক শংকর বৈরাগী।  
সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদউজ্জামান।  

জানা যায়, শংকর বৈরাগী শহরের ঈশান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি ওই স্কুলের নবম-দশম শ্রেণিতে গণিতের ক্লাস নিতেন। গত ৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় তিনি শহরের অম্বিকা মেমোরিয়াল হলের সামনে থেকে একটি রিকশায় কয়েক যুবকের সঙ্গে চলে যান। এরপর আধা ঘণ্টার মধ্যে তার স্ত্রী কোতোয়ালি থানা পুলিশকে বিষয়টি অবগত করেন এবং তার স্বামী অপহরণের শিকার হয়েছেন বলে পুলিশকে জানান।

ওই শিক্ষকের স্ত্রীর কথামতো কোতোয়ালি থানা পুলিশ ৩ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে ফরিদপুর শহরের আদমপুর মোল্যাডাঙ্গীর কালাম মোল্যার বাড়ি থেকে উদ্ধার করে শিক্ষক শংকর বৈরাগীকে। এ ঘটনায় ওই শিক্ষক বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় অপহরণ মামলা করেছেন। মামলায় শহরের গুহলক্ষীপুরের সেকেন্দার আলী মোল্যার ছেলে আশিকুজ্জামান সানিমকে (২৮) একমাত্র আসামি করা হয়েছে।

তবে এ ঘটনার নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। বিদ্যালয়টির দুইজন এসএসসি পরীক্ষার্থীর (ক ও খ) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই শিক্ষক তার বাসায় ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়াতেন। সেই সুবাদে ছাত্রীদের পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের আশা দিয়ে বিভিন্ন সময় কুপ্রস্তাব দিতেন। রাজি না হলে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকিও দিতেন। এই সুযোগে এক ছাত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি (শিক্ষক)। পরে ওই ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিষয়টি তারা স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা শামসুন নাহারকে তিন মাস আগে অবগত করেন। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ধামাচাপা দেন এবং ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ওই শিক্ষক।  

এ ব্যাপারে ঈশান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) শামসুন নাহারের কাছে জানতে চাইলে তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে শিক্ষক অপহরণের বিচারের দাবি করেন। এ ঘটনায় কিছু অভিযোগ পাওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ পাইনি এবং অশ্লীল কিছু দেখিওনি। তারপরও মৌখিকভাবে আমাকে জানালে, আমি ওই শিক্ষককে নবম-দশম শ্রেণির ক্লাস নিতে নিষেধ করেছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী (ক) জানায়, স্যারের (শংকর বৈরাগী) একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। কিছুদিন আগে স্কুল থেকে স্যার আমাকে ডেকে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন এবং টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখান। আমি রাজি না হওয়ায় পরীক্ষা দিতে দিবে না বলেও হুমকি দেন। স্যার অনেক বড় আপুদের সঙ্গেও এরকম ঘটনা এর আগেও ঘটিয়েছেন। আমার এক বান্ধবীর (গ) সঙ্গেও শারীরিক সম্পর্ক করেছেন। বিষয়টি প্রধান শিক্ষককে বললে তিনি চুপ থাকার কথা বলেন। বিষয়টি জানাজানি করলে পরীক্ষা দিতে দিবেন না বলে ম্যাডামও হুমকি দেন। তখন আমার পরিবারকে জানাই। পরে এলাকার বড় ভাইদের ঘটনাটি জানানো হয়। বর্তমানে আমি স্কুলেও যেতে পারতেছি না।

‘ক’ ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একই স্কুলের ‘গ’ ছাত্রীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয় ওই শিক্ষকের। তাকে পড়ালেখার বিভিন্ন খরচের জন্য টাকাও দিতেন এবং প্রাইভেট পড়ানোর নামে বাসায় ডেকে নিতেন। তাদের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাটিংয়ে অশ্লীল কথাবার্তা হয়। এমন কয়েকটি স্ক্রিনশট সংগ্রহ করা হয়েছে। যেখানে দেখা যায়, ওই ছাত্রী একাধিক স্পর্শকাতর ছবি তুলে পাঠিয়েছে। শিক্ষকও অশ্লীল কথাবার্তা আদান প্রদান করেছেন।

বিষয়টি নিয়ে ‘গ’ ছাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের পর সে জানায়, এই শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার সুবাদে তাকে পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের এবং চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কুপ্রস্তাবে রাজি হতে বলতেন। এভাবে একদিন সকাল ৯টায় প্রাইভেট পড়ানো হবে বলে তাকে হোয়াটসঅ্যাপে জানান। পরে সেখানে গেলে অন্য কাউকে দেখতে পায়নি সে। তখন তাকে কুপ্রস্তাব দেওয়া হয়। ওই ছাত্রী হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাটিংয়ে অশ্লীল ছবি দেওয়ার বিষয়েও জানায়, টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করার ভয় দেখিয়ে তার অশ্লীল ছবি নিতেন শিক্ষক শংকর বৈরাগী।

অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, এসব ঘটনার কয়েকটি স্ক্রিনশট ও ছবি ওই ছাত্রীর মোবাইল থেকে গোপনে নিয়ে নেন আরেক বান্ধবী ‘খ’। পরে তার বান্ধবীর মাধ্যমে ওই ছবি চলে যায় শিক্ষকের (শংকর বৈরাগী) করা মামলার আসামি আশিকুজ্জামান সানিমের কাছে। এই ছবিগুলো নিয়ে শিক্ষক শংকর বৈরাগীর সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেন। এমনকি পূর্বে সানিম এ ঘটনায় টাকাও নিয়েছে বলে ফরিদপুর জিলা স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক মো. রেজভী জানান।

ঘটনার দিন শংকর বৈরাগীর সঙ্গে হাঁটাহাঁটি করছিলেন শিক্ষক মো. রেজভী। রেজভী বলেন, ১০ মিনিট কোচিংয়ে পড়ানোর কথা বলে মোবাইলের মাধ্যমে আমাদের এক ব্যক্তি স্প্রিং হিল হাসপাতালের পাশে যেতে বলেন। আমরা তিনজন শিক্ষক হেঁটেই ওই এলাকায় যাচ্ছিলাম। হঠাৎ সানিমসহ কয়েকজন এসে শংকর স্যারকে রিকশায় উঠিয়ে নিয়ে যান। স্যারও কোনো ধস্তাধস্তি না করে তাদের সঙ্গে চলে যান। পরে তার স্ত্রীকে ঘটনাটি আমরা জানাই।

বিষয়গুলো নিয়ে আরও জানতে যোগাযোগ করা হয় আশিকুজ্জামান সানিমের সঙ্গে। তিনি ছাত্রীকে এলাকার ছোটবোন দাবি করে বলেন, শংকর বৈরাগী স্যার ব্ল্যাকমেইল করে আমার এলাকার ছোট বোনকে ধর্ষণ করছে বলে জানতে পারি। এমনকি আমরা প্রমাণও পাই। এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য স্যার নামে এক ধর্ষণকারীকে আমরা উঠিয়ে নিয়ে আসছিলাম। এটা যদি আমাদের অপরাধ হয়ে থাকে এবং আমরা যদি অপহরণ করে থাকি তাহলে শাস্তি মাথা পেতে নেব। এ ঘটনার পেছনে তথ্যগুলো তদন্ত করে ওই শিক্ষককে উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানান তিনি।  

তবে শিক্ষক শংকর বৈরাগী অপহরণের বিষয়টি দাবি করে বলেন, ছাত্রীদের সঙ্গে যৌন হয়রানির বিষয়টি মিথ্যা। অপহরণের পর আমাকে মারধর করেছে চক্রটি। আমাদের (হাঁটাহাঁটি করা তিন শিক্ষক) মিথ্যা কথা বলে ওই চক্রের সদস্যরা অম্বিকার পাশে নিয়ে বলে এক ছাত্রীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক আছে। ওই ছাত্রীর ভাই আপনাকে মারবে। আপনি এখান থেকে দ্রুত চলে যান। এ সময় যাওয়ার জন্য রিকশায় উঠতে গেলে সানিম আমার রিকশায় উঠে মুখ চেপে ধরে নিয়ে যায়। আমার পরিবার পুলিশকে বিষয়টি জানালে আমাকে উদ্ধার করে পুলিশ।  

ওই ছাত্রীদের সঙ্গে আচরণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর না দিয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বলে দাবি করেন।  

এদিকে ভুক্তভোগী ছাত্রীরা ওই শিক্ষকের বিচারের দাবি জানিয়ে পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন।

সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ওসি মো. আসাদউজ্জামান জানান, এ ঘটনায় শিক্ষক শংকর বৈরাগী থানায় অপহরণের এজাহার দেওয়ায় আমরা মামলা নিয়েছি। ঘটনাটি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া ওই শিক্ষকের বিচারের দাবি জানিয়ে ভুক্তভোগী এক ছাত্রী পুলিশ সুপার স্যারের কাছে অভিযোগ দিয়েছে। ওই অভিযোগটিও আমার কাছে এসেছে। অভিযোগটি তদন্তের জন্য একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছি।  

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৫
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।