ঢাকা, শনিবার, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

রাজনীতিতে উত্তরাধিকার তৈরি করা সহজ হবে না

এ কে এম শাহনাওয়াজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২৫
রাজনীতিতে উত্তরাধিকার তৈরি করা সহজ হবে না

বংশপরম্পরায় শাসন বা ডাইনেস্টিক রুল ছিল রাজতান্ত্রিক যুগে দুনিয়াজুড়ে একটি শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা। যে রাজবংশে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী না থাকত, দুর্বল হয়ে যেত তাদের শাসন।

ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র চলত। বিশৃঙ্খলতায় ছেয়ে যেত।

প্রাচীন বিশ্বসভ্যতায় যেমন, মধ্যযুগের ইউরোপীয় সভ্যতায়ও রাজবংশীয় শাসন দৃঢ় অবস্থানে ছিল। প্রাচীন ভারতের মৌর্য-গুপ্ত শাসনও ছিল রাজবংশীয় শাসন। বাংলার পাল বংশের রাজারা সফল শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই সাফল্যের সঙ্গে চার শ বছর অতিক্রম করেছিলেন।
ভারতের ও বাংলার সুলতানি শাসন ও মোগল শাসনও ছিল রাজবংশীয় বা এক ধরনের পারিবারিক শাসন।

পারিবারিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে বড় সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটে। এর বড় উদাহরণ সাত শতকের বাংলার স্বাধীন রাজা শশাঙ্কর শাসনামল। শশাঙ্ক যদি রাজবংশ গড়তে পারতেন তাহলে বলা যায় ভারতবর্ষের ইতিহাস ভিন্নভাবে লিখতে হতো।

গৌড়ের স্বাধীন রাজা শশাঙ্ক এতটাই শক্তিশালী ছিলেন যে তাঁর বিজয় অভিযান অনেকটা উত্তর ভারত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। যদি শশাঙ্ক যোগ্য উত্তরসূরি রেখে যেতে পারতেন তাহলে তাঁরা সমগ্র ভারত হয়তো জয় করতে পারতেন।
ঔপনিবেশিক শাসন ও বাণিজ্য অর্থনীতি শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসের গতিধারায় বড় পরিবর্তন এনে দেয়। এ পর্যায়ে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে যায়। ইংল্যান্ডের মতো কয়েকটি দেশে রাজা-রানি আছে বটে, তবে তা আলংকারিক পদের মতোই।

এখন বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করে আছে। কোনো কোনো দেশে সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী ব্যবস্থা বহাল থাকলেও তা সংস্কারের মধ্য দিয়ে অনেকটা আধুনিক করা হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বংশীয় শাসনের বেশির ভাগ দল এখন আর ক্ষমতায় নেই। ভারতের রাজনীতিতে পাঁচ প্রজন্ম ক্ষমতায় ছিল নেহরু-গান্ধী পরিবার। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি গান্ধী পরিবারকে ক্ষমতার বাইরে ঠেলে ফেলেন। ভারতের রাজনীতি ভিন্ন ধারায় চলে আসে। শ্রীলঙ্কায় বন্দরনায়েকে পরিবারের তিন প্রজন্মের শাসনের অপসারণ ঘটিয়ে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০০৫ সালে প্রজাতান্ত্রিক শাসন শুরু করেন। তিনিও একটি রাজবংশীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মৈত্রীপালা সিরিসেনার হাতে অপসারিত হন। পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবারের শাসনের অবসান ঘটিয়ে নওয়াজ শরিফ শাসন শুরু করেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঘটনার পারম্পর্য একই রকম। শেখ মুজিবের মধ্য দিয়ে যে আওয়ামী লীগ শাসন শুরু হয়, উত্তরাধিকারী হিসেবে সেই শাসন শেখ হাসিনা অব্যাহত রেখেছিলেন। মাঝখানে ক্ষমতার পালাবদলের পরও শেখ পরিবারের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। জিয়া পরিবারের শাসনও জিয়াউর রহমানের পর খালেদা জিয়া অব্যাহত রাখেন। রাজনৈতিক পালাবদলে বিএনপি ক্ষমতায় এলে হয়তো তারেক রহমান উত্তরাধিকারী হিসেবে ক্ষমতায় বসবেন। তবে খালেদা জিয়ার শাসন অব্যাহত না থাকায় বিএনপির পারিবারিক শাসন কিছুটা নড়বড়ে হয়ে যায়। শেখ হাসিনার শাসন অপ্রতিরোধ্য মনে হলেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ পরিবারের শাসনের আপাতত অবসান ঘটে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির এসব বাস্তবতা ইঙ্গিত করে, শক্ত করে পারিবারিক শাসন বা বংশীয় শাসন ফিরিয়ে আনা এখন অনেকটাই কঠিন।

তবে এই সত্য মানতে হবে যে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শাসনে পারিবারিক রাজনীতি ও পারিবারিক ক্ষমতা বারবার ফিরে আসতেই পারে। এর বড় কারণ যেকোনো বড় দলেই ক্ষমতাসীন পরিবারের বাইরে অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠার পথই বন্ধ রাখা হয়। পরিবারের বাইরে বিচ্ছিন্ন কেউ শাসনক্ষমতায় সর্বোচ্চ পদাধিকারী হবেন, সেই চিন্তাও বোধ করি দলের ভেতর কেউ করে না।

আমাদের মতো দেশগুলোতে পারিবারিক রাজনীতির একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। ক্ষমতাসীনদের একই মত ও আদর্শের ধারাবাহিকতা থাকলে পরিকল্পনামতো দেশোন্নয়ন যতটা সম্ভব, বিচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতাসীন হলে তার পক্ষে অনেকটা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ নির্দলীয় বা ছোট-দুর্বল দলের ক্ষমতাসীন কেউ কাম্য সমর্থন সাধারণত অন্য রাজনৈতিক পক্ষ থেকে পাবেন না। এমন অবস্থায় তাঁকে আপস করেই চলতে হবে। দেশের মানুষও অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে পারিবারিক শাসন মেনে নিতে।

রাজনৈতিক দল আমাদের মতো দেশে খুব গুরুত্ব ধারণ করে। এ কারণে নির্বাচনে প্রার্থীর চেয়েও দলীয় প্রতীক সাধারণ ভোটারের কাছে বেশি আপন। আওয়ামী লীগ ও নৌকা ঐতিহ্যবাহী দল ও প্রতীক। পাকিস্তান পর্ব থেকে নৌকার পরিচিতি। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যতটা না, নৌকার জয়জয়কার তার চেয়েও বেশি ছিল। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বিএনপির জন্ম। সময়ের সুবিধা নিয়ে দ্রুত জনপ্রিয় হতে থাকে দলটি। এই সঙ্গে ধানের শীষও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। এ দুই প্রতীকের দলও পারিবারিক রাজনীতি থেকে বেড়ে ওঠা। সেই তুলনায় পুরনো দল হলেও জামায়াতে ইসলামী এবং এই দলের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা একান্ত দলীয় কর্মী-সমর্থক ছাড়া ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে তেমনভাবে পৌঁছতে পারেনি। তাই কোনো পর্বেই এককভাবে নির্বাচনে খুব বেশি আসন লাভ করতে পারেনি। এর পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে পারিবারিক রাজনীতির বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে পারি। জামায়াতে ইসলামী আদর্শভিত্তিক দল। পারিবারিক রাজনীতির কাঠামো এই দলে নেই। তা ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর দলীয় আদর্শ ও পদ্ধতি আবহমান বাংলার চিরায়ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধারার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। ফলে প্রগতিশীল চিন্তার শিক্ষিত শ্রেণিকে জামায়াত যেমন আকৃষ্ট করতে পারেনি, সাধারণ মানুষের কাছেও তেমনভাবে পৌঁছতে পারেনি; যতটা পৌঁছতে পেরেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। পারিবারিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে নিজের অবস্থান নিয়ে পৌঁছতে পারত জাতীয় পার্টি। কিন্তু জেনারেল এরশাদ তেমনভাবে উত্তরাধিকারী তৈরি করতে পারেননি। ফলে পারিবারিক রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ততটা সুবিধাজনক অবস্থায় বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল ছাড়া অন্য কোথাও দাঁড়াতে পারেনি এই দলটি।  

এ দেশে পারিবারিক রাজনীতির প্রভাব অনেক বেশি। এমন বাস্তবতা থেকে বের হতে হলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। এ দেশে গণতন্ত্র শক্ত অবস্থানে কখনো দাঁড়াতে পারেনি। পরিবারতন্ত্রের অবস্থান শক্ত থাকায় বিএনপি-আওয়ামী লীগ কখনো দলের ভেতর গণতন্ত্র চর্চা করেনি। দলের সভাপতি পদ যেন মৌরুসিপাট্টা। সম্মেলনে প্রত্যক্ষ ভোটে কখনো সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। সম্মেলনও কালেভদ্রে হয়। শেখ হাসিনা থেকে গেছেন আজীবন সভানেত্রী। খালেদা জিয়া জেলে না গেলে, আইনের প্যাঁচে না পড়লে হয়তো সভানেত্রীই থেকে যেতেন। আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত ছেলে তারেক রহমান পালিয়ে গিয়ে লন্ডনে অবস্থান করছেন বছরের পর বছর। দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাঁর পদাধিকারী হওয়ার কথা নয়। তবু পারিবারিক রাজনীতির ক্ষমতায় তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়ে রইলেন। আসলে পারিবারিক ক্ষমতার রাজনীতিতে গণতন্ত্রচর্চা দুর্বল বলে পারিবারিক গণ্ডিতেই রাজনীতির চালিকাশক্তি অবস্থান করেছে। দলের ভেতর থেকে নতুন নেতৃত্ব বের হতে পারছে না। পারছে না নয়, বলা যায় হতে দেওয়া হচ্ছে না।

পারিবারিক দলীয়করণ এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার দ্বন্দ্ব তৈরি করে। এতে ফল্গুধারায় সংগোপনে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। পারিবারিক বলয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার জন্য দলের, রাষ্ট্রের, প্রশাসনের—এমনি করে সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রথমে পরিবারের এবং পরে দলের মানুষদের দিয়ে পূর্ণ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে যোগ্যতা থাকলেও সুবিধাবঞ্চিতরা ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হতে থাকে। সম্প্রতি শেখ হাসিনার পতনের কারণ বিশ্লেষণ করলে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে।

এই গণতান্ত্রিক যুগে হয়তো ধারার রূপান্তর হয়েছে, কিন্তু পারিবারিক ক্ষমতার রাজনীতিতে এই ধরনে ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়। এ কারণে শেখ হাসিনার রাজনীতির ধারায় সম্ভাব্য ক্ষুব্ধতা প্রশমনের জন্য পরিবারের শক্তিমানদের নানাভাবে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা হতো। এসবের পথ দিয়েই দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল। বিএনপির শাসনামলেও পারিবারিক রাজনীতি বহাল রাখতে এবং খালেদা জিয়ার ক্ষমতা আজীবন টিকিয়ে রাখার জন্য এখানেও দুর্নীতি করার দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। ছক অভিন্ন। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য শুধু পরিবারকেন্দ্রিক দুর্নীতি নয়, সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনকেও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলা হয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগের পরিবারতন্ত্র ও বিএনপির পরিবারতন্ত্র অনেকটা খুঁড়িয়ে চলছে। এখন আওয়ামী লীগ সরকার পতিত। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের পরিবারতন্ত্রের ওপর তীব্র আঘাত এসেছে। আওয়ামী লীগ যদি এ দেশের রাজনীতিতে এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরেও আসে, তবু সমাজ বাস্তবতায় পরিবারতন্ত্রের বলয়ের পুনরুত্থান কঠিন হবে। শেখ হাসিনা উত্তর বর্তমান বাস্তবতায় শেখ পরিবারের কেউ প্রবলভাবে বেরিয়ে আসতে পারবেন, তেমন ভরসা নেই।

একই ধাক্কা জিয়াউর রহমানের পরিবারতন্ত্রকেও কি বিপন্ন করে তুলছে না! খালেদা জিয়া উত্তর তারেক রহমান দলের হাল ধরবেন, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনীতির মাঠে ঘোরতর আলোড়নের মধ্য দিয়ে তারেক রহমান যদিও ভবিষ্যতে সরকার গঠন করতে পারেন, তো সেই সরকারের স্থিতিশীলতা তৈরি কঠিন হয়ে পড়বে। বর্তমানে যতটুকু দৃশ্যমান, তাঁর পরে বিএনপির নেতৃত্বে ও ক্ষমতায় পারিবারিক রাজনীতির উত্তরাধিকার তৈরি করা খুব সহজ হবে না।

কিন্তু এই বড় দুই দলে একটি অভিন্ন সমস্যা রয়েছে। দুই দলের পরিবারের বাইরে অনেক নেতা-নেত্রী আছেন, কিন্তু পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি এমনভাবে দেয়াল তৈরি করেছে যে পরিবারের বাইরে কাউকে দলের অবিসংবাদিত নেতা ভাবার বাস্তবতা নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়নি। ফলে যখন পরিবারে রাজনীতির আলোতে বেরিয়ে আসার মতো কেউ না থাকবে বা দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য না হবে তখন দুই দলেই এক ধরনের অরাজকতা তৈরির আশঙ্কা দেখা দেবে। এই পর্যায়ে যে ভাঙচুর হবে, এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক হবে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করবেন।

মধ্যযুগের কবি লিখেছেন, ‘রাজার সিংহাসন কভু নাহি যায় খালি’। জন-আস্থা ও শ্রদ্ধার্ঘ্য নিয়েই কোনো নেতা সামনে আবির্ভূত হবেন। সেদিনই এসব দেশের শাপমোচনের সম্ভাবনা দেখা দেবে।

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।