ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রেড সিটি সৈয়দপুরে ঘুরে আসুন!

মো. আমিরুজ্জামান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০২৩
রেড সিটি সৈয়দপুরে ঘুরে আসুন!

নীলফামারী: উত্তরের জেলা নীলফামারীর মনোরম একটি শহরের নাম সৈয়দপুর। শহরের অধিকাংশ ভবনই লাল রঙের।

একজন পরিব্রাজক শহরটির নাম দিয়েছেন ‘রেড সিটি’। নামকরণটি অনেকেই যৌক্তিক মনে করেন। কেননা শহরটি আজও বহন করছে ব্রিটিশ কলোনিয়ান স্মারক।

রেলওয়ের পূর্ত বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের প্রধান রেল কারখানাটি সৈয়দপুরে গড়ে ওঠে। কিন্তু এর আগেই এ শহরের সয়েল টেস্ট করেন ব্রিটিশরা। সম্ভাব্যতা যাচাই হয় দীর্ঘসময় ধরে। এরপর তারা নিশ্চিতও হন ভৌগোলিক সুবিধাজনক সৈয়দপুর শহরেই গড়ে তোলা হবে রেলওয়ে কারখানা। সমুদ্র সমতল থেকে ১৯০ ফুট উচ্চতায় সৈয়দপুরের অবস্থান। কেবল রেল কারখানা হলে তো চলবে না? এজন্য প্রয়োজন একটি নগর পরিকল্পনা। পরে ব্রিটিশরা শুরু করে সৈয়দপুর নগর তৈরির কাজ।

সূত্র থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে রংপুরের জমিদারের কাছ থেকে সৈয়দপুরে রেলওয়ে স্থাপনা গড়তে মাত্র পাঁচ সিকায় (১২৫ পয়সা) চান্দিনার শর্তে কিনে নেওয়া হয় সাড়ে ৮০০ একর জমি। এর মধ্যে ১১০ একর জমিতে তৈরি হয় বিশাল রেলওয়ে কারখানা। ১৮ একর জমিতে গড়া হয় রেলওয়ে সেতু কারখানা। আর মালামাল যোগান দেওয়ার জন্য ৬৮ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় সরঞ্জাম গুদাম (স্টোর ডিপো)। ব্রিটিশ নগর পরিকল্পনা অনুযায়ী গোটা শহরটিতে তৈরি হয় কংক্রিটের পাকা সড়ক। তৈরি হয় স্ট্রিট লাইট, যা তেল দিয়ে জ্বালানো হতো। শহরে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে জরুরিভাবে নির্বাপণের জন্য তৈরি করা হয় ওয়াটার রিজার্ভার ও ফায়ার সার্ভিস। এক কথায় তিলোত্তমা শহর হিসেবে গড়ে ওঠে সৈয়দপুর।

রেলওয়ে কর্মকর্তাদের জন্য পরিপাটি অফিসার্স কলোনি গড়ে ওঠে। একই সঙ্গে রেল কারখানার ফোরম্যান ও চার্জ ম্যানদের জন্য সাহেবপাড়া, খালাসিদের (শ্রমিক) জন্য খালাসি মহল্লা, করনিকদের জন্য মুন্সিপাড়া, মিস্ত্রিদের জন্য মিস্ত্রীপাড়া, বাবুদের জন্য বাবুপাড়া, নীচু কলোনি, উঁচু কলোনি, হাতিখানা ইত্যাদি নামে পাড়া গড়ে ওঠে তখন। এছাড়াও পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জন্য গড়ে ওঠে সুইপার কলোনি।

রেলওয়েতে কর্মরতদের গড়ে তোলা হয় একটি রেলওয়ে হাসপাতাল, বিনোদনের জন্য ক্লাব মিলনায়তন, প্রার্থনার জন্য দুটি গির্জাও স্থাপন করা হয়।

রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুজ্জামান জোয়ার্দার তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, ব্রিটিশ প্রকৌশলীরা কারখানা ও শহরের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তাদের সহযোগিতা দিতে সৈয়দপুরে ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক প্রদেশ থেকে লোকজন ধরে আনে। ফলে তখন মিশ্র সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয়। অধিকাংশ লোক উর্দু ও হিন্দিতে কথা বলা শুরু করেন শহরটিতে। মূলত বিহার প্রদেশ থেকে বেশি সংখ্যক লোক সৈয়দপুরে এসে রেলওয়ে কারখানা ও শহর গড়ে তোলার কাজে যুক্ত হন। ১৮৭০ সালে রেলওয়ে কারখানাটি উৎপাদনে গেলে অধিকাংশ বিহারীকে চাকরি দেওয়া হয় রেলওয়ে কারখানায়। অবশ্য অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবাদে সৈয়দপুরে আসেন। ওই সময় গেট, রেল বাজার নামে বিভিন্ন বাজার গড়ে উঠে।

রংপুর গবেষণা পরিষদ নীলফামারী জেলা শাখার সভাপতি অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান বলেন, ব্রিটিশ আমলের হাফপ্যান্ট পরা পুলিশ এদেশের মানুষকে ভয় দেখাতেন। গড়বড় করলে লাল ঘর দেখাবো (অপরাধ করলে জেলের ভাত খাওয়াবো)। তখন থেকে লালঘর ভীতি এই জনপদে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ আমলে থানা, জেলখানা, রেলস্টেশন, সরকারি অফিস, হাসপাতাল, টেলিগ্রাফ অফিস, বাংলো প্রভৃতির রং ছিল লাল। সৈয়দপুর শহরটি এখনও তার অতীত ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এই শহরের অধিকাংশ বাড়িঘর লাল। বিশেষ করে রেল ও সরকারি স্থাপনার। এসব সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

দেশের বৃহত্তম সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) সাদেকুর রহমান বলেন, আমার অফিস ও বাংলো দুটোই লাল। এসব ব্রিটিশদের স্মারক। রেলের প্রায় সব ভবনই লাল।

সৈয়দপুর শহরের প্রবীণ ব্যক্তি নিকোলাস গোমেজ বলেন, ১৮৬০ থেকে ১৮৮০ সালের মধ্যে ধর্ম প্রচারের জন্য সৈয়দপুরে ইতালিয়ান যাজকদের আগমন ঘটে। সৈয়দপুরে এখনও লাল রঙের ফাদার কুঠি রয়েছে। আছে রোমান ক্যাথলিক গির্জা ও প্রোটেস্ট্যান্টদের ক্রাইস্ট চার্চ। ওই উপাসনালয়গুলোও লাল।

শতবছরের ঐতিহ্যবাহী সৈয়দপুর শিল্প সাহিত্য সংসদের সভাপতি ম. আ. শামীম বলেন, সৈয়দপুরে ১৮৮২ সালে স্থানীয় বাসিন্দাদের বিনোদনের জন্য দুটি মঞ্চ তৈরি হয়। একটির নাম মূর্তজা ইন্সটিটিউট (ইউরোপিয়ান ক্লাব) ও অপরটি ফিদা আলী ইন্সটিউট (ব্যাক পাইপার)। এছাড়াও শহরের সাধারণ মানুষের জন্য সমসাময়িক সময়ে একটি নাচঘর স্থাপন করা হয়। যেখানে নর্তকীরা এসে সারারাত মুজরা (এক ধরনের নৃত্য) করতেন। এসব ভবনের রং লাল।

রেলওয়ে পূর্ত বিভাগের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী ওয়ালিউল হক বলেন, সৈয়দপুর শহরে ২৪০০ রেলওয়ে কোয়ার্টার রয়েছে। এর মধ্যে ৭০টি অফিসার্স বাংলো। যার সবগুলোই লাল। এমনকি ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাবটিও লাল রঙের।

বিশ্ব ঐতিহ্য পরিব্রাজক এলিজা বিনতে এলাহি সৈয়দপুরের লাল ভবনগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি অসংখ্যবার সৈয়দপুর ভ্রমণ করেছেন। এলিজা বলেন, ভারতের রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরকে পিংক সিটি বা গোলাপি শহর বলা হয়। ১৮৭৬ সালে ব্রিটেনের রানি জয়পুর সফরে আসেন। তখন রাজা রাম সিংহ গোলাপি রং দিয়ে গোটা জয়পুর সাজিয়ে তোলেন।

এলিজা আরও বলেন, আমার দৃষ্টিতেও সৈয়দপুর লাল লাল বিল্ডিংয়ের শহর। অসম্ভব সুন্দর শহর এটি। শহরটি পর্যটন খাতে নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে। কেননা এই শহরে রয়েছে রেল, সড়ক ও আকাশ পথে সুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমি সৈয়দপুরকে রেড সিটি ঘোষণার দাবি করছি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০২৩
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।