ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ভৈরব দুর্ঘটনা

লোকোমাস্টারের ওপর দায় চাপিয়ে বাঁচতে চায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ 

নিশাত বিজয়, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২৩
লোকোমাস্টারের ওপর দায় চাপিয়ে বাঁচতে চায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ 

ঢাকা: কিশোরগঞ্জের ভৈরব স্টেশনের আউটারে যাত্রীবাহী এগারসিন্দুর গোধূলি এক্সপ্রেসের সঙ্গে চট্টগ্রামগামী মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষের দায় শেষমেশ লোকমাস্টারের দিকেই দিতে যাচ্ছে রেলওয়ে।

যদিও রেলওয়ের বিভিন্ন সূত্র থেকে উঠে এসেছে তিনটি কারণ।

প্রথমত, মান্ধাতার আমলের সিগন্যালিং ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত, লোকোমাস্টারের (রেল চালক) সিগন্যাল অমান্য করে স্টেশনের দিকে এগিয়ে আসা।

শেষটি হচ্ছে ঢাকা (কমলাপুর) রেলওয়ে স্টেশনে ইঞ্জিন ঘোরানোর যন্ত্র (টার্ন টেবিল) নষ্ট। ফলে ইঞ্জিনের দূরতম অংশ থেকে ট্রেন চালানো লাগছে লোকমাস্টারদের।  

সিগন্যাল দেখতে পেয়ে যখন ব্রেক চাপা হয় তখন মালবাহী ট্রেনের বেশকিছু কোচের ব্রেকিং সিস্টেম অকার্যকর হওয়ায় যথাসময়ে ট্রেনটি থামাতে পারেননি লোকোমাস্টার - এমন দাবি বিশেষজ্ঞ ও অন্য লোকোমাস্টারদের।

লোকোমাস্টারের সিগন্যাল অমান্য করায় দুর্ঘটনা ঘটেছে দাবি করে রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, আমার লোকোমেটিভ মাস্টারের জন্য দুর্ঘটনা ঘটেছে।  

অন্যদিকে দুর্ঘটনায় নাশকতার শঙ্কা করে মন্ত্রী বলেছেন, আমরা তদন্ত করে দেখছি শুধুমাত্র সিগন্যাল অমান্য করার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে নাকি তার পেছনে কোনো নাশকতার উদ্দেশ্য আছে।  

কেন নাশকতার আশঙ্কা করছেন জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আমরা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট যা দেখছি এছাড়াও সেখানে লাইনের ওপর কিছু হয়েছে কিনা।  

এদিকে ঢাকা (কমলাপুর) রেলওয়ে স্টেশনে ইঞ্জিন ঘোরানোর যন্ত্র টার্ন টেবিল নষ্ট। ফলে ইঞ্জিনের দূরতম অংশ থেকে ট্রেন চালানো লাগছে লোকোমাস্টারদের। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা করে লোকোমাস্টারদের পক্ষে দু-দিন আগে একটা চিঠি পাঠানো হয়েছে।

কমলাপুরের টার্ন টেবিল নষ্টের দায় কার এ বিষয়ে বাংলানিউজের প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আমরা একটা তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। তারা যথাযথভাবে যাচাই করবে যে কারা দায়ী। তবে প্রাথমিকভাবে আমরা যা বুঝতে পেরেছি সেভাবেই আমরা কথা বলছি। কিন্তু এটা তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ওপর বোঝা যাবে। রিপোর্ট না আসার পর্যন্ত এর সঠিক কোনো কথা আমরা বলতে পারছি না।  

লোকোমাস্টারদের দাবি টার্নটেবিল নষ্ট 

মালবাহী ট্রেনের যে ইঞ্জিন এগারসিন্দুরকে ধাক্কা দিয়েছে সেটির নম্বর ৩০২৮। এটিতে চালক এক দিকে বসতে পারে। যখন ধাক্কা দেয় তখন এটি উল্টো ছিল।  

এই ইঞ্জিনের মোট দৈর্ঘ্য ৬৩ ফুট, যা অন্যান্য ইঞ্জিনের তুলনায় দৈর্ঘ্যে বেশি। যখন এটি উল্টো চালানো হয়, তখন এটিকে লংহুড বলে। লংহুডে ইঞ্জিন থাকলে চালকের আসন বাদে চালককে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮ ফুট দূর থেকে সিগন্যাল দেখতে হয়। এই ইঞ্জিনটি লম্বা হওয়াতে সিগন্যাল এবং চালকের মাঝে অনেক সময় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ভৈরবের দুর্ঘটনাতেও এমনটি হয়েছে দাবি করেছেন কয়েকজন লোকোমাস্টার।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন যাবৎ ঢাকার টার্ন টেবিল নষ্ট, মেরামত না করে উল্টো লোকো দিয়ে ট্রেন চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। উল্টো লোকোমোটিভের ক্যাব থেকে ঠিকমতো সিগন্যাল, রেলক্রসিং দেখা যায় না। লোকোমাস্টারেরা লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরও কোনো সমাধান হয়নি।  

যদিও এমন দাবি মানতে রাজি নন রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

রেলেওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামগামী মালবাহী ট্রেনটিকে স্টেশনে আউটারে থামতে সিগন্যাল দেওয়া হয়। ট্রেনটির লোকোমাস্টার (চালক) সংকেত অমান্য করে স্টেশনে ঢুকে পড়ে।

প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ব) তাপস কুমার দাস বলেন, ইঞ্জিনের বসার অবস্থান নিয়ে যে অভিযোগ করেছে লোকোমাস্টাররা সেটি একদম অযৌক্তিক। এভাবেই বছরের পর বছর এভাবেই ট্রেন চলছে। যদি সিগন্যাল দেখতে না পায় তাহলে সেটি ভিন্ন বিষয়।

দুর্ঘটনার পেছনে অব্যবস্থাপনাকে দায় বিশেষজ্ঞদের 

এ দুর্ঘটনার পেছনে লোকোমাস্টারের চেয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের সার্বিক অব্যবস্থাপনাকে দায় দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে দায় শুধু চালককে দিলে হবে না। যারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বিশেষ করে যারা প্রকৌশলী আছেন, তাদের আগে বিষয়টি দেখা উচিত ছিল। এটা চিঠি চালাচালির বিষয় না। এটা নিয়মিত বিষয়।  

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সিগন্যাল না দেখার জন্য চালকেরা যে আগে থেকেই কথা বলেছেন সেটা সবাই জেনেছে। আবার অনেকক্ষেত্রে কোচগুলোর ব্রেক নষ্ট থাকে। দেখা যায় ৩০টা কোচের মধ্যে ১০টার ব্রেক নেই। এতে সিগন্যাল দেখে ট্রেন থামালেও সেটি থামতে দেরি হয়, তাতে বড় দুর্ঘটনা হয়ে যায়।

সাইফুন নেওয়াজ বলেন, দুর্ঘটনা শেষে চালকদের দায় দিয়ে শেষ করলে সমাধান আসবে না। এখানে যান্ত্রিক ত্রুটি আছে। সেটা কেন ঠিক করা হয়নি বা যারা এই পদে আছেন তারা বেতন নিচ্ছেন তাহলে কেন চিঠি দিতে হবে।

সিগন্যালিং ও রেলপথ সংস্কারের আগ্রহ কম

২০১৯ সালের ২৪ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ব্রিজ ভেঙে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান ৫ জন। অথচ বাংলাদেশ রেলওয়েতে গত ১২ বছরে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ করেছে বাংলাদেশ সরকার।  

কিন্তু এসব বরাদ্দের অধিকাংশই পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী-কক্সবাজার রেল সম্প্রসারণ, বঙ্গবন্ধু রেল সেতুসহ নতুন নতুন প্রকল্পে।

কিন্তু রেলওয়ের চলমান ব্রিটিশ আমলের সিগনালিং ব্যবস্থা আধুনিকায়ন ও অবকাঠামো পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা নেই বাংলাদেশ রেলওয়ের।

নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পরিবহন বিষয়ক গবেষক আশীষ কুমার দে বাংলানিউজকে বলেন, রেলওয়ের বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণে যত আগ্রহ, তার ছিটেফোঁটা আগ্রহ নেই রেলপথ সংস্কার ও রেলওয়ের সিগনালিং আধুনিকীকরণে।

রেলপথ সংস্কার ও রেলওয়ের সিগন্যালিং আধুনিকীকরণে রেলওয়ের সদিচ্ছা নেই কেন বাংলানিউজ প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, দীর্ঘকাল রেলওয়েতে কোনো বিনিয়োগ ছিল না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে নতুন বিনিয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে যেসব নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানে সিগন্যালিং সিস্টেম উন্নত করা হচ্ছে।  

নুরুল ইসলাম সুজন মন্ত্রী থাকাকালে দ্বিতীয় বৃহৎ দুর্ঘটনা

ভৈরব দুর্ঘটনা বর্তমান রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের মেয়াদকালে দ্বিতীয় বৃহৎ দুর্ঘটনা। এর আগে ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবায় দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২১ জনের মৃত্যু হয়। একই বছরের ২৪ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান ৫ জন।

এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী বলেন, আমি রেলের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবার যে দুর্ঘটনা হয় সেখানে ২১ জন নিহত হয়েছিল৷ দীর্ঘদিন পর আবার একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটল৷ এ ঘটনায় ২০ জন মারা গেছেন৷ 

কাজ করছে তিন তদন্ত কমিটি, রিপোর্ট সাত দিনে 

তদন্ত কমিটি প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন রেল মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ আগামী সাতদিনের মধ্যে এই কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে৷ এ ঘটনায় আমরা সংশ্লিষ্ট ৩ জনকে সাসপেন্ড করেছি৷ তদন্ত প্রতিবেদন পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ 

বরখাস্ত তিনজন হলেন- ১. লোকোমাস্টার জাহাঙ্গীর আলম ২.সহকারী লোকোমাস্টার আতিকুর রহমান ও ৩. গার্ড আলমগীর হোসেন।

এ নিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ে আলাদা তিনটি কমিটি করেছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে যুগ্মসচিব (অডিট ও আইসিটি) আহ্বায়ক ও উপসচিব (প্রশাসন-৬)-কে সদস্য সচিব করে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।  

অন্যদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগীয় অফিস ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে। কমিটিতে আছেন- ১.  মো. শহিদুল ইসলাম, সিওপিএস ২. মোহাম্মদ জাকির হোসেন,   চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ৩. আরমান হোসেন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার ৪. তুষার,  সিএসপি এবং ৫. আহাদ আলী সরকার চিফ মেডিকেল অফিসার।

আর বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় অফিস ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে। কমিটিতে আছেন- ১. বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা,ঢাকা ২. বিভাগীয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার লোকোমোটিভ ৩. বিভাগীয় প্রকৌশলী -১ ঢাকা ও ৪. বিভাগীয় সিগন্যাল ও টেলিকমিউনিকেশন প্রকৌশলী, ঢাকা।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২৩
এনবি/এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।