ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ব্যয় বাড়িয়েও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি রাবার ড্যামের নির্মাণকাজ

এ কে এস রোকন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩
ব্যয় বাড়িয়েও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি রাবার ড্যামের নির্মাণকাজ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ভূমি না পাওয়ায় ও পানি বৃদ্ধির অজুহাতে নির্ধারিত সময়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীর ওপর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু সংলগ্ন রেহাইচর এলাকায় নির্মাণাধীন রাবার ড্যামের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারল না পানি উন্নয়ন বোর্ড।  

২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ২ বছর ধরে চলমান প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত অগ্রাধিকার ভিত্তিক এ প্রকল্পটির কাজ গত জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল।

তবুও কাজটি শেষ করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। বন্যায় ডুবে গেছে পুরো প্রকল্প এলাকা। অথচ এরই মধ্যে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে ৬৪ কোটি টাকা। তবে ৯০ ভাগ কাজ শেষ দাবি করে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে ভূমি জটিলতা ও কাজ চলতে চলতে হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ঠিকাদাররা কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ ও রাবার ড্যামের অর্থ বাড়িয়ে তিন মাসের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ শেষ করে নদীতে পানি কমলেই আবারও কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্পে কাজের গতি ধীর বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ রয়েছে। তারা জানান, এ প্রকল্পটি জেলার সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হওয়ার পরও যথাসময়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ -৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অন্তত পাঁচবার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে কাজে তাগাদা দিয়েছেন।


চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু সংলগ্ন রেহাই চর এলাকায় এ রাবার ড্যামের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে। এ প্রকল্পের আওতায় রেহাইচরে ৫০০ মিটার ভাটিতে ৩৫৩ মিটার দৈর্ঘ্যের রাবার ড্যাম, ভূমি অধিগ্রহণ ও নদী খননের জন্য চুক্তিমূল্য ধরা হয়েছিল ১৫৫ কোটি ৪৬ লাখ ৩৫ হাজার ১৯৫ টাকা। সেসময় ভূমি অধিগ্রহণের জন্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভূমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে পড়তে হয় জটিলতায়। পরে প্রকল্প ব্যয় সংশোধন করে মোট প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১৮২ কোটি টাকা। বর্তমানে একনেকে ৬৪ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৬ কোটি টাকায়। এর মধ্যে আগের বরাদ্দ সাড়ে তিন কোটি টাকাসহ ৩৭ কোটি টাকা শুধু মাত্র ভূমি অধিগ্রহণেই ব্যয় হচ্ছে। পাশাপাশি উজানে ১০ কিলোমিটার এবং ভাটিতে ২৬ কিলোমিটারসহ মোট ৩৬.০৫ কিলোমিটার খননে ব্যয় হচ্ছে ২৬ কোটি টাকা। আর রাবার ড্যাম নির্মাণে ৩০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ যুক্ত করে ড্যাম নির্মাণে খরচ দেখানো হয়েছে ১৮২ কোটি টাকা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড আরও জানায়, ইতোমধ্যেই মূল স্ট্রাকচারের ৯০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন পাম্প হাউস ও রাবার বসানো বাকি রয়েছে। রাবারটি চীন থেকে আমদানি করা হবে। চুক্তি অনুযায়ী ১৫ জুন নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ভূমি না পাওয়া ও নদীতে পানি বৃদ্ধির জন্য কাজ বন্ধ হয়েছে। প্রকল্পের শুরুতেই ১ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের কথা থাকলেও পরবর্তীকালে তা বেড়ে দাঁড়ায় তিন দশমিক ৫১ হেক্টর। অন্যদিকে নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ও অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের কারণে প্রকল্পটি সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

এদিকে আবারও প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে রাবার ড্যামের সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রধানমন্ত্রী এবং একনেকের চেয়ারপারসন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সংশোধিত এ প্রকল্পে ৬৪ কোটি টাকা বাড়িয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়।

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নদী সংলগ্ন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, ভোলাহাট, গোমস্তাপুর ও নাচোল উপজেলাসহ রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি উপজেলার নদীর তীরবর্তী এলাকায় পানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে এবং আট হাজার হেক্টর জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে। ফলে এ সব অঞ্চলে কোটি কোটি টাকার ফসল উৎপাদন সম্ভব হবে। সেইসঙ্গে মহানন্দা নদীতে ৬৫ কিলোমিটার বিশাল জলাধার তৈরি হবে। ফলে প্রতিবছর মাছ উৎপাদন করা যাবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বাড়বে। এতে বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে এবং জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। মহানন্দা নদী ফিরে পাবে তার নাব্যতা। দেশি জাতের মাছ উৎপাদন বাড়লে বেকার জেলেরা প্রাণ ফিরে পাবে। ফিরে আসবে জীববৈচিত্র্য। রক্ষা পাবে পরিবেশের ভারসাম্য।

এ ব্যাপারে সদর আসনের সংসদ সদস্য আ. ওদুদ বিশ্বাস জানান, তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিয়ে আসেন এবং রাবার ড্যাম প্রকল্পসহ অনেক কয়টি প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুরোধ জানালে প্রধানমন্ত্রী জনসভায় সবগুলো প্রকল্পই বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। পরবর্তীকালে তিনি মাঝে ৪ বছর সংসদ সদস্য না থাকায় এবং বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যের কারণে প্রকল্পটি ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে। এরপরও তিনি নানা তদবির করে এবং চলতি বছর উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর প্রকল্পে গতি আনতে সক্ষম হন। একনেকে নতুন করে বরাদ্দ বাড়ায় আশা করা হচ্ছে আগামী বছরের প্রথমদিকেই প্রকল্পটির উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেসুর রহমান জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব বা টিপিপি পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। ২৯ মার্চ প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির পিএসসির সভায় সংশোধিত ডিপিপি উত্থাপন করা হয়। দীর্ঘদিন অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকার পর মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) একনেক সভায় প্রকল্পটিও অনুমোদন দেওয়া হয়।  

তিনি আরও জানান, সংশোধিত প্রকল্পে ব্যয় বাড়িয়ে ৬৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় হবে ৩৪ কোটি টাকা। ৩০ কোটি টাকা বেড়েছে নির্মাণ কাজের জন্য। তার দাবি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য গত দুই বছরে নির্মাণ সামগ্রীর দর বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। চাঁপাইনবাবগঞ্জের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এ প্রকল্পটি শেষ করতে আগামী তিন মাসের মধ্যে জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা হবে এবং নদীর পানি কমে গেলে আবার ড্যামের নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করা হবে বলেন জানান এ প্রকৌশলী।

প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত মেগা প্রকল্প ‘মহানন্দা রাবার ড্যাম’ প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয়। ২১ সালের ২৫ আগস্টে প্রকল্পের কার্যাদেশ পাওয়ার পর প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ১ নভেম্বর। প্রথম বছরে ৪০ শতাংশ নির্ধারিত সব কাজ সম্পন্ন হলেও পর্যাপ্ত ভূমির অভাবে ২০২৩ সালের ৩০মে প্রকল্পের মেয়াদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হয় ৭০ শতাংশ। পরে প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর কথা বলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘বিআইসি-এসএসআরআই(জিভি)।

নিয়ম অনুযায়ী মেগা প্রকল্প শুরুর আগে জমি অধিগ্রহণের নিয়ম থাকলেও জমি এখন পর্যন্ত অধিগ্রহণ করা হয়নি। জমির মালিকদের আশ্বাস দিয়েই প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও সে প্রক্রিয়াও শেষ হয়নি। প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের দিকে হলেও এখন পর্যন্ত কোনো টাকাও পাননি জমির মালিকরা। এ নিয়ে নদীর উভয় পাড়ের জমির মালিকদের মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। জমির মালিকদের অভিযোগ, জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বার বার আশার বানী শোনালেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিক মোরসালিন জানান, তারা গত বছর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে জমির মূল্য দাবি করলেও গত ২ বছরেও তাদের টাকা দেওয়া হয়নি। শুনেছি অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। দেখা যাক কি হয়। তবে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হননি জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিব খান।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘বিআইসি-এসএসআরআই(জিভি) প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান জানান, ব্যয় বেড়ে যাওয়া ও জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে আরও এক বছর। কাজ সঠিকভাবেই চলছে। জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে কাজ চলছে। প্রক্রিয়া শেষে জমির মালিকরা তাদের ন্যায্য টাকা বুঝে পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২৪ সালের জুনের মধ্যেই ‘মহানন্দা রাবার ড্যাম’ প্রকল্পের কাজ শেষ করার আশা রয়েছে।

প্রসঙ্গত: ২০১১ সালের ২৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সফরে এসে স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মহানন্দা নদীতে রাবার ড্যাম নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এর সম্ভাব্যতা সমীক্ষার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিংকে (আই ডব্লিউ এম)। আড়াই বছর সমীক্ষা শেষে ১৮৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করে আই ডব্লিউ এম। এর পর প্রকল্পটির ১৫৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে একনেকে পাশ হয়। শুরু হয় রাবার ড্যামে নির্মাণকাজ।

বাংলাদেশ সময়: ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২৩
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।