ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শাহীনের হাতের ব্যাট যাবে বিশ্ববাজারে

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০১ ঘণ্টা, জুলাই ২, ২০২৩
শাহীনের হাতের ব্যাট যাবে বিশ্ববাজারে ব্যাট মেরামত করছেন শাহীন।

রাজশাহী: ‘ব্যাট ডক্টর’ নামটা এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলসহ বিশ্বের তারকা খেলোয়াড়দের কমবেশি সবারই জানা। কারণ ক্লাসিক্যাল শচীন টেন্ডুলকার, হার্ডহিটার শহীদ আফ্রিদি, আন্দ্রে রাসেল কিংবা বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানসহ বিশ্বের বহু নামিদামি আর প্রতিষ্ঠিত তারকার উইলোতে হাতের ছোঁয়া আছে আফতাব শাহীনের।

একজন ক্রিকেট ব্যাটের কারিগর হিসেবে অসামান্য কীর্তির কারণেই যিনি পেয়েছেন এই ‘ব্যাট ডক্টর’ উপাধি।

যেকোনো ক্রিকেট ব্যাট মেরামত থেকে শুরু করে নতুন ব্যাট তৈরির, সবই করে থাকেন ওই ব্যাটের কারিগর। তার নাম হুসাইন মোহাম্মদ আফতাব। অবশ্য ‘আফতাব শাহীন’ নামেই রাজশাহীর ওই ব্যাটের কারিগর সবার কাছে সুপরিচিত। আর তাকে নিয়েই নতুন এক মিশনে নেমেছেন জাতীয় দলের অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ ও অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ইমরুল কায়েস।

তারা তিনজন মিলে নামতে যাচ্ছেন ক্রিকেট ব্যাট তৈরির এক নতুন ব্যবসায়। এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম ব্যাট প্রস্তুতকারক কোনো প্রতিষ্ঠান। যার নাম রাখা হয়েছে ‘এমকেএস’ স্পোর্টস। উত্তরের বিভাগীয় শহর রাজশাহী মহানগরেই গড়ে তুলতে চান ওই ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কারখানা। তাই অদূর ভবিষ্যতে দেশের চাহিদা পূরণ করে ‘এমকেএস’ স্পোর্টস’র ব্যাট যাবে বিশ্ববাজারে। যাতে লেখা থাকবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’।

সোনালি স্বপ্নের মতোই রঙিন এই প্রত্যাশায় শাহীন তো খুবই রোমাঞ্চিত। জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা তো আছেনই, তাদের সঙ্গে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট, হাই পারফরম্যান্স মেয়েদের ক্রিকেট, এমনকি ক্লাবপর্যায়ে খেলা স্থানীয় ক্রিকেটারদের ব্যাটে ‘এমকেএস স্পোর্টস’র লোগো বসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তার। বাদ যাবে না কেউই। এমন স্বপ্নই দেখছেন শাহীন আফতাব।

ভারতের এ সময়ের জনপ্রিয় ক্রিকেটার সূর্যকুমার যাদবের ব্যাট নিয়ে বর্তমানে ভীষণ ব্যস্ত ব্যাট ডক্টর আফতাব শাহীন। কয়েকদিন আগেই কাজ করেছেন পাকিস্তানের অলরাউন্ডার শহীদ আফ্রিদির ব্যাটের। দেশি-বিদেশি বহু খেলোয়াড়ের ব্যাটেই আছে শাহীনের হাতের ছোঁয়া। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে ও ইংল্যান্ডের বহু খেলোয়াড় তার তৈরি ব্যাটে বিশ্ব আসরে খেলেন।
 




আর শাহীন আফতাব এখন পর্যন্ত মুশফিকুর রহিম, মুমিনুল হক, আফিফ হোসেন, নাজমুল হোসেন, মোসাদ্দেক হোসেন ও মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিনের জন্য ব্যাট তৈরি করেছেন।

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বাইরেও অনেকে তার কাছ থেকে নিয়মিত ব্যাট নেন। ব্যাটে শাহীনের কাজ পছন্দ হয়েছিল এবারের বিপিএল খেলতে আসা পাকিস্তানের খুশদিল শাহ, সিকান্দার রাজা, আন্দ্রে  রাসেলদেরও। এর মধ্যে খুশদিলের জন্য নতুন ব্যাটই বানিয়ে দিয়েছিলেন শাহীন। অর্ডার ছিল রাসেলেরও। আর সিকান্দার রাজা তো শাহীনের কাজের ভক্তই।

গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ দলের হয়ে জিম্বাবুয়ে সফরে গিয়ে ব্যাট নিয়ে হঠাৎই জটিল সমস্যায় পড়েন এনামুল হক। ওইসময় সমাধানের জন্য এনামুল তার সতীর্থ রাজার শরণাপন্ন হন। কিন্তু একরকম হতাশই হন। রাজা নাকি এনামুলকে বলেছিলেন, ‘এই দেশে তো কোনো শাহীন নেই যে তোমার ব্যাট ঠিক করে দেবে। ’

শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটার নয়, বিভিন্নভাবে যোগাযোগ হওয়ার পর এখন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্স জাতীয় দলের অনেক ক্রিকেটারের ব্যাট তৈরির কাজও পেয়েছেন শাহীন।

অন্য সবার মতো শাহীনেরও স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। ২০০১ সালে জাতীয় পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৫ দলের প্রাথমিক তালিকায় ডাকও পেয়েছিলেন। কিন্তু বয়স বেশি হওয়ায় অনূর্ধ্ব-১৫ দলে আর রাখা হয়নি তাকে। এরপরও টুকটাক খেলেছেন কিন্তু পেশাদার ক্রিকেটার আর হতে পারেননি। তাই ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে কাজ করার সুপ্ত ইচ্ছা অনেক আগে থেকেই ছিল শাহীনের। সেজন্য কারিগরি শিক্ষার কোর্সে কাঠ নিয়ে দুই বছর করেছেন পড়াশোনাও। আর ব্যাট মেরামতের কাজ তখন থেকেই শুরু শাহীনের।

কাজ ও পরিকল্পনা, ওই সবকিছু নিয়েই কথা হয় ‘ব্যাট ডক্টর’ খ্যাত আফতাব শাহীনের সঙ্গে।  

তিনি জানান, ১৯৯৮ সাল থেকে তার এই পথ চলা। পড়াশোনা শেষে চাকরিজীবন শুরু করলেও এর পাশাপাশি ঘরোয়া পর্যায়ে খেলা ক্রিকেটারদের ব্যাট নিয়ে কাজ করতেন। দিনে অফিস আর রাতে ক্রিকেটারদের ব্যাট ঘঁষেমেজে নতুন করাই ছিল কাজ। শাহীনের শুরুটা অনেকটা এভাবেই।
 




শিল্প ও বাণিজ্যের শহর খুলনায় জন্ম নেওয়া আফতাব শাহীন ১৯৯২ সালে বাবার বদলির সূত্রে রাজশাহীতে আসেন। এরপর এখানেই বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা। কারিগরি শিক্ষা নিয়ে কৌতূহলে শুরু করেছিলেন ক্রিকেট ব্যাটের কাজ।

ভারতীয় ও পাকিস্তানি ব্যাট-মেকাররা অনেক টাকা আয় করে ওই ক্রিকেট ব্যাট থেকেই। আর এই বাংলাদেশই তাদের বিশাল বাজার।

আফতাব শাহীন জানান, তারা বাংলাদেশে বাজার ধরলেও এখানকার ক্রিকেটারদের উপযোগী ভালোমানের কোনো প্রোডাকশন নেই। ওরা পারলে আমরা কেন পারব না- এমন একটা জেদ কাজ করতো আমার ভেতরে। এরপর আর কী ইউটিউব ও ফেসবুকে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির বিভিন্ন কনটেন্ট দেখে বুঝলাম আসলে কাজটা যত কঠিন ভেবেছিলাম ততটা কঠিনও নয়। তবে এজন্য কাঠ আনতে হবে ইংল্যান্ড থেকে। কারণ বিশ্বের সবাই সেখান থেকে ব্যাটের কাঠ কেনেন।

শাহীন আগের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, বিগত ২৩/২৪ বছর ধরে ব্যাট মডিফিকেশন ও কাস্টমাইজেশনের প্রতি আমার এক ধরনের নেশা কাজ করেছে। যা এখন পরিণত হয়েছে পেশায়। কেউ আমার কাছে ব্যাট সারতে দিলে মনে হয় এটা তার নিজেরই ব্যাট। তাই নিজের সেরাটা দিয়েই সেই ব্যাট মেরামত করি। ফ্যাক্টরি করলে তার হাতের তৈরি নিখুঁত ব্যাটই যাবে বিশ্ববাজারে। এর গায়ে লেখা থাকবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’'। এর চেয়ে গর্বের বিষয় আর কী হতে পারে?
 




এখন বিশ্ব বাজারে ক্রিকেট ব্যাটের দখল রয়েছে ভারত, পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডের। সেই শেকল ভাঙতেই এখন রাজশাহীতে কারখানা তৈরির স্বপ্ন দেখছেন শাহীন। তার সঙ্গী হয়েছেন  জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় মেহেদী হাসান মিরাজ ও ইমরুল কায়েস।  

ব্যাটের ওই কারিগর বলেন, তার ভেতরে ক্রিকেটের জন্য সুপ্ত ভালোবাসা থেকেই চিন্তা এসেছে যে তিনি নিজেই ব্যাট তৈরি করতে পারবেন। এরপর আর কী? নিজের মধ্যে চেপে বসলো ফ্যাক্টরি করার জেদও। তাই তার হাত ধরেই রাজশাহীতেই হতে যাচ্ছে এমকেএস স্পোর্টস। আর এটি হবে দেশের প্রথম ব্যাট প্রস্তুতকারক কোনো প্রতিষ্ঠান। যা মহানগরের চন্দ্রিমা এলাকায় উৎপাদনে যাবে শিগগিরই।

বাংলাদেশ দলের কোন ক্রিকেটার কেমন ওজনের ব্যাট দিয়ে খেলেন, সেটি এখন ভালোই মুখস্থ রাজশাহীর ওই স্বপ্নবাজ তরুণ আফতাব শাহীনের। কার কী চাহিদা, সেটিও এখন আর শাহীনের কাছে আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় না।  

তার এই নতুন মিশনে জাতীয় দলের অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ ও অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ইমরুল কায়েস যোগ দেওয়ায় ভালো কিছু হতে যাচ্ছে বলেই উল্লেখ করেন তিনি।

শাহীনের স্বপ্ন, একদিন ভারত-পাকিস্তানে তৈরি ব্যাটের সঙ্গে পাল্লা দেবে এমকেএস স্পোর্টসের ব্যাট। ভালো ব্যাট তৈরি করেই সেই সুনাম অর্জন করতে চান ওই ‘ব্যাট ডক্টর’।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, জুলাই ০২, ২০২৩
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।