ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

৩০-৪০ হাজার টাকায় তৈরি জাল স্ট্যাম্প বিক্রি হতো আড়াই লাখে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৪ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২৩
৩০-৪০ হাজার টাকায় তৈরি জাল স্ট্যাম্প বিক্রি হতো আড়াই লাখে

ঢাকা: ঢাকার আশুলিয়া ও মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি চক্রের অন্যতম হোতা সোহেল কাজীসহ একই চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। মঙ্গলবার (১৩ জুন) রাতে তাদের গ্রেপ্তার করে র‍্যাব-৪।

 

বুধবার (১৪ জুন) দুপুরে কাওরানবাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।  

গ্রেপ্তাররা হলেন, মো. সোহেল কাজী, মো. জাহাঙ্গীর আলম ওরফে জাহিদ (৪০), সোহেল রানা (৩৫), মো. সাব্বির হোসেন (২২), মোছা. সাবিনা ইয়াছমিন (৩০),  শাহনাজ আক্তার (৩১), কামরুল হাসান (২৬), মো. সুমন (২২), বিল্টু (১৯) ও মো. সেন্টু মিয়া (২৫)।

গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে র‍্যাব ৫০০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৩ লাখ ৮০ হাজার ৮৬০টি, ২০০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৬২ হাজার টি, ১০০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৯২ হাজার ২০০টি, ৫০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৬০ হাজার ৭৬০টি, ২০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৩২ হাজার ২০০টি, ১০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৪ লাখ ২১ হাজার ৯০০টি, ৫ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৯ হাজারটি, ৪ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৩৬ হাজার ৯০০টি, ২ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৫ হাজার ৬০০টি, পারফেক্ট মেশিন ৩টি ও স্ট্যাম্প তৈরির প্যাটেন্ট ২০টি জব্দ করে। সর্বমোট ২২ কোটি ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যমানের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ১১ লাখ ১ হাজার ৪২০টি ও নগদ ৩০ হাজার ৭৪৫ টাকা ও অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।  

র‍্যাব জানায়, ১০ থেকে ১৫ জনের একটি সংঘবদ্ধ চক্র প্রায় দুই বছর ধরে ঢাকার আশুলিয়ার বলিভদ্র এলাকায় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি তৈরি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়। এভাবে তারা প্রতারণার মাধ্যমে সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করে আসছিল, হাতিয়ে নিচ্ছিল কোটি কোটি টাকা।  

খন্দকার আল মঈন জানান, সাম্প্রতিক সময়ে র‌্যাব গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারে যে, এক শ্রেণীর প্রতারক চক্র দীর্ঘদিন ধরে আশুলিয়া বলিভদ্র এলাকায় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি তৈরি করে প্রতারণামূলকভাবে সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হতে বঞ্চিত করছে। মঙ্গলবার রাতে র‌্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাব-৪ এর একটি দল অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি তৈরির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

তিনি বলেন, চক্রটি মূলত সোহেল কাজীর মাধ্যমে পরিচালিত হতো। অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি ও বিক্রয়ে অন্যান্যরা সোহেল কাজীর সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। সোহেল কাজী আগে বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেসে চাকরির সুবাদে সেখান থেকে সে বিভিন্ন রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরির কাজ রপ্ত করেন। অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প চিহ্নিতকরণ সহজ না হওয়ায় এবং অধিক মুনাফা লাভের আশায় তিনি নিজ ব্যবস্থাপনায় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি ও বিক্রির পরিকল্পনা করেন। আশুলিয়ার ‘কনফিডেন্স প্রিন্টিং’ প্রেসের মালিক ও অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি উল্লেখিত ছাপাখানায় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প মুদ্রণের কাজ শুরু করেন।  

র‍্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘কনফিডেন্স প্রিন্টিং’ প্রেসে তার অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প মুদ্রণের কাজে নিয়োজিত ছিলেন সাব্বির, সুমন, কামরুল সেন্টু ও বিল্টু। অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প মুদ্রণের পর পারফেক্ট মেশিনের মাধ্যমে কাটিং ও ছিদ্রকরণ করা হতো। পরে জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে রাজধানীর উত্তরা, বনানী, গুলশান, সাভার ও টঙ্গীসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে কোর্ট ফি ও অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প সরবরাহ করা হতো। বিভিন্ন সময় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প সরবরাহ করার সুবাদে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি করতে পারেন, এমন অনেক ব্যক্তির পরিচয় হয় এবং তারা সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এভাবে তারা ১০-১৫ জনের একটি চক্র গড়ে তোলেন। এ ছাড়া তার সঙ্গে বিভিন্ন অনুমোদিত ভেন্ডরের সঙ্গে সু-সম্পর্ক থাকায় তিনি তাদের কাছে কম মূল্যে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সরবরাহ করতেন। ভেন্ডররা এ সব অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করতেন।  

খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে এক রিম কাগজের মাধ্যমে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি করতে গড়ে তাদের ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ হতো, যা সোহেল তৈরি করে জাহিদের কাছে এক লাখ টাকায় বিক্রি করতেন। পরে জাহিদ ওই অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্পগুলো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আনুমানিক ২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। এভাবে তারা প্রতি মাসে ৮-১০ রিম কাগজ দিয়ে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করে আসছিলেন।  

সোহেল কাজী প্রায় ১৬ বছর আগে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেসে কাজ শুরু করেন। তার নেতৃত্বে প্রায় ২ বছর ধরে চক্রটি অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি তৈরি ও বিক্রির কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। এক পর্যায়ে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরির চাহিদা বেড়ে গেলে সোহেল কাজী এই কাজে স্ত্রী সাবিনা ইয়াছমিনসহ স্ত্রীর বড় ভাই সোহেল রানাকেও সম্পৃক্ত করেন। তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াছমিন বাসা থেকে মালামাল ডেলিভারি ও আর্থিক বিষয় দেখাশোনা করতেন। প্রিন্টিং প্রেসে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি মুদ্রণের পর সোহেল রানার বাসায় পারফেক্ট মেশিনের মাধ্যমে কাটিং ও ছিদ্রকরণসহ পরবর্তী ধাপের কার্যক্রম সম্পন্ন হতো। এ ছাড়া তার একটি নিজস্ব ট্রাক রয়েছে। ওই ট্রাকের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে মালামাল পরিবহনের আড়ালে তিনি বিভিন্ন সময় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প সরবরাহ করতেন। সোহেল কাজীর বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জ থানায় একটি মামলা রয়েছে এবং ওই মামলায় তিনি কারাভোগ করেছেন।    

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা বেশ কয়েকজন ভেন্ডরের নাম জানতে পেরেছি। এই ভেন্ডরদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছি। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান থেকে অনুমোদিত মূল্যে স্ট্যাম্প সংগ্রহ করে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করার কথা। এখন পর্যন্ত আমরা যে তথ্য পেয়েছি, তাতে দেখেছি অবৈধ স্ট্যাম্প বিক্রির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন ভেন্ডররা। তাদের লাভের পরিমাণ বেশি। কোনটা আসল আর কোনটা জাল স্ট্যাম্প, তা নির্ণয় করা কঠিন। আসামি সোহেল প্রথমে জাল টাকা তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন। জাহাঙ্গীর ও অন্যান্যরা তাকে পরামর্শ দেন জাল স্ট্যাম্প তৈরি করে বাজারজাত করলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম। সাধারণ মানুষ যখন স্ট্যাম্প কিনবে, তাদের জন্য বোঝা খুব কঠিন কোনটা আসল, কোনটা নকল। অনুমোদন হিসেবে স্ট্যাম্প টাকশালে তৈরি হওয়ার কথা।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চক্রটি প্রতি মাসে আনুমান ৮-১০ রিম কাগজ প্রিন্ট করত অবৈধ স্টাম্প তৈরিতে। ২ থেকে ৫০০ টাকা মূল্যের অবৈধ স্ট্যাম্প তৈরি করতো। এভাবে তারা প্রায় দুই থেকে তিন বছর ধরে তৈরি করে আসছিল। চক্রটি অনেক বড়। চক্রটি প্রতি রিমে দুই লাখ টাকা লাভ করতো। আমরা তাদের কাছে ৫০০ টাকা মূল্যের ৮ কোটি টাকার নকল স্ট্যাম্প পেয়েছি। সোহেল কাজীর দুটি ট্রাক ও কিছু যায়গা জমি রয়েছে। জাহিদের একটি বাড়ি আছে, আর একটির কাজ চলছে।  
আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান র‍্যাবের এই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৬ ঘণ্টা,  জুন ১৪, ২০২৩
এমএমআই/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।