ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

নববর্ষকে রাঙাতে ব্যস্ত নরসিংদীর মৃৎশিল্পীরা

সুজন বর্মণ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০২৩
নববর্ষকে রাঙাতে ব্যস্ত নরসিংদীর মৃৎশিল্পীরা

নরসিংদী: প্রযুক্তি, রুচি, আধুনিকতা ও বাজার বিশ্বায়নের ফলে বাঙালির সংস্কৃতির অংশ মৃৎশিল্প এখন নরসিংদীতে বিলিন হওয়ার পথে। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে পাওয়া এ পেশা অনেকেই ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় ঝুঁকেছেন।

গত দুই বছর মহামারি করোনা এ শিল্পকে তছনছ করে দিয়েছে। পাশাপাশি বৈশাখী মেলার সংখ্যা ও কমে যাওয়ায় এ শিল্পের ভবিষ্যত নিয়েও শঙ্কায় রয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

জেলার প্রায় সব উপজেলাই অল্প কিছু মৃৎশিল্পী সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখন ও টিকে রয়েছে। তবে পলাশ উপজেলায় এ সংখ্যাটা একটু বেশি। এখানে প্রায় শতাধিক পরিবার শখ, বংশগত ঐতিহ্য বা জীবিকার তাগিদে এ ক্ষুদ্র শিল্পকে ধরে রেখেছে। তবে তারা এখনো এ পেশায় টিকে থাকলেও সব মিলিয়ে ভালো নেই । তবুও বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষকে রাঙাতে মাটির পণ্য প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন উপজেলার মৃৎশিল্পীরা। তবে বৈশাখে রোজা আর সামনে ঈদ থাকায় মাটির জিনিসপত্র কতটুকু  বিক্রি করতে পারবে তা নিয়েও মৃৎশিল্পীরা বেশ শঙ্কায় রয়েছেন।

বাংলা নববর্ষে জেলার বিভিন্ন স্থানের মেলায় বিক্রির জন্য মৃৎশিল্পীরা তাদের নিজের হাতে নিপুণ কারুকাজে মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন শিশুদের জন্য রকমারি পুতুল, ফুলদানি, রকমারি ফল, হাড়ি, কড়াই, ব্যাংক, বাসন, থালা, বাটি, হাতি, ঘোড়া, বাঘ, টিয়া, ময়না, ময়ূর, মোরগ, খরগোশ, হাঁস, কলস, ঘটি, মুড়িভাজার ঝাঞ্জুর, চুলা ও ফুলের টবসহ বিভিন্ন মাটির জিনিসপত্র।

উপজেলার ঘোড়াশাল পৌর এলাকার কুমারটেক, পাল পাড়া, টেঙ্গরপাড়া, চরসিন্দুর ইউনিয়নের লেবুতলা, কুমার পাড়া ও জিনারদী ইউনিয়নের বরাব, কাটা বেড় নামক গ্রামগুলোতে মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে শতাধিক পরিবার। তারা বিভিন্ন উৎসবে মাটির তৈরির জিনিসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

সরেজমিনে উপজেলার পৌর এলাকার কুমারটেক পাল পাড়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, মৃৎশিল্পী দিপালী রানী পাল, জয় কিশোর চন্দ্র পাল, নৃপেন্দ্র চন্দ্র পাল, রেখা রানী পাল, চিনু রানী পাল ও শেফালী রানী পাল তাদের মাটির খেলনা তৈরি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

এখানকার মৃৎশিল্পীরা জানান, পারিবারিকভাবেই তারা পৈতৃক পেশা হিসেবে এ মাটির কাজ ধরে রেখেছেন। পণ্যের রং ও নকশার কাজ নিজেরাই করে থাকেন। খেলনা তৈরির জন্য মাঠ থেকে মাটি আনা, মাটি নরম করা, সাঁচ বসানো, চুলায় পোড়ানো, রোদে শুকানো, রং করাসহ প্রায় সব কাজই এখানকার নারীরা করেন।

আসছে বৈশাখী মেলাকে সামনে রেখে এক একটি পরিবার প্রায় ১৫০০ খেলনাসহ মাটির জিনিসপত্র তৈরি করেছেন এবং রঙের কাজও প্রায় শেষ করা হয়েছে। মেলায় বিক্রির জন্য পাইকাররা এসে এসব খেলনা কিনে নিয়ে যায়।

বাঙালির ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের একসময় বিপুল কদর থাকলেও বছরের অন্যান্য দিনে তারা বেশ দূর অবস্থায় থাকেন। শুধু মেলা এলেই কেবল কর্মমুখর হয়ে ওঠে চিরচেনা ঐতিহ্যময় প্রাচীন এই মৃৎ শিল্পীসমৃদ্ধ পাল পাড়া গ্রাম। পহেলা বৈশাখের আগে খানিকটা সময়ের জন্য হলেও মৃৎশিল্প তার হারানো গৌরব ফিরে পায় এবং মৃৎশিল্পীরাও ব্যস্ত হয়ে ওঠেন নানা সামগ্রী তৈরিতে। কিন্তু বছরের অন্যান্য দিনগুলো মানবেতর জীবনযাপন করেন এ মৃৎশিল্পীরা।

রেখা রাণী পাল বলেন , বর্তমান সময়ে মাটি ও রং এর দাম অনেক বেশি। যার কারণে মূল্য একটু বেশি থাকায় এসব জিনিস কিনতে আগ্রহ দেখান না ক্রেতারা। এতে আমাদের লোকসান গুনতে হয়। বাংলা নববর্ষ বরণে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের বিপুল কদর থাকলেও বছরের অন্যান্য দিনে আমরা বেশ দূর অবস্থায় মানবেতর জীবন-যাপন করি।

আরেক মৃৎশিল্পী নিপেন্দ্র চন্দ্র পাল বলেন, পারিবারিকভাবেই আমরা পৈতৃক পেশা হিসেবে এ মাটির কাজ ধরে রেখেছি। পণ্যের রং ও নকশার কাজ নিজেরাই করে থাকি। বছর ভরে বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করার মাধ্যম হয় এ বাংলা নববর্ষে। কিন্তু বর্ষবরণের কিছু দিন যেতে না যেতে আবারও বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বিপাকে থাকি দিনের পর দিন।

সহদেব পাল নামে আরেকজন বলেন, এখন আর আমাদের পরিবারের অন্য সদস্যরা মাটির কাজ শিখতে চায় না। তারা অনেকেই অন্য পেশায় ঝুকঁছেন। আবার অনেকেই অন্য কোনো কাজ না জানার কারণে এ পেশায়ই লেগে আছেন। বর্তমানে আমাদের অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। এরপরও কেউ আমাদের খোঁজখবর নেন না। সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা পেলে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো।

পলাশ উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা উজ্জ্বল মুন্সি বলেন, আমরা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীদের সাহায্য করে থাকি। বিভিন্ন ধাপে যাচাইবাছাই করে তাদের তালিকা করে সাহায্য করা হয়। আর মৃৎশিল্পীরা হারিয়ে যাওয়া শিল্পকে ধরে রেখেছে। তাদের মাধ্যমেই অতীত ঐতিহ্য টিকে রয়েছে। তাদের এ কাজে টিকে থাকতে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের ভবিষ্যতে প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। যাতে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা ভালো থাকতে পারেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০২৩
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।