ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘অনলাইন’ সুযোগ নয়, অধিকার

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৬
‘অনলাইন’ সুযোগ নয়, অধিকার

ডিজিটাল বাংলাদেশ সময়ের দাবি। তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ ও প্রয়োগ ছাড়া বর্তমান বিশ্ব কল্পনাও করা যায় না।

‘ডিজিটাল বিশ্ব’ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ইন্টারনেট তথা ডিজিটাল সেবাকে আরো সহজলভ্য করতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতি, আইন, বিধি ও কৌশল প্রবর্তন করে।  

ডিজিটাল বিশ্ব গড়ার জন্য রাষ্ট্রসমূহ বেশকিছু সমন্বিত নীতি ও কৌশল প্রণয়ন করেছে।

বাংলাদেশ এর বাইরে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে বর্তমান সরকার নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের বেশকিছু সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সেবা এখন প্রায় পুরোপুরি ডিজিটাল। ডিজিটাল পরিসেবাকে আরো বিস্তৃত করার জন্য কাজ চলছে। সেই সঙ্গে বর্তমান সেবাগুলোকেও আরো সহজতর করারও সুযোগ আছে।

জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ডিজিটাল বিশ্ব’ ধারণা নিয়ে কাজ করছে।

যদিও জাতিসংঘের এসব পদক্ষেপ অনুযায়ী অনেক দেশই যথাযথ কর্মসূচি প্রণয়ণে ব্যর্থ। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ব্যাপারে বর্তমান সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিলেও এ ব্যাপারে আমাদের আরো অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি দেশকে ডিজিটাল সেবার আওতায় আনতে হলে ইন্টারনেটকে আরো সহজলভ্য করতে হবে। সেই সঙ্গে এ বিপুল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে ইন্টারনেট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

বর্তমান সময়ে এসে ইন্টারনেট তথা তথ্যপ্রযুক্তিকে আর গুরুত্বহীন মনে করার সুযোগ নেই। বরং উন্নয়নের চাকাকে আরো বেগবান করতে হলে ইন্টারনেটের পরিধি আরো বাড়াতে হবে। ইন্টারনেটকে আরো কার্যকরভাবে ব্যবহার করে মানব উন্নয়ন তথা ক্ষমতায়নের চাকা আরো গতিশীল করা সম্ভব। বর্তমান বিশ্ব সে পথেই অগ্রসর হচ্ছে।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইন্টারনেটকে অন্যান্য মানবাধিকারের মতোই বিবেচনা করা হয়। ইন্টারনেট ব্যবহারের অধিকার লঙ্ঘন করা সেই সব দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।   

বর্তমান বিশ্বে ইন্টারনেট ছাড়া জীবনকে কল্পনা করা যায় না। জ্ঞান ও তথ্য প্রবাহের স্রোতধারায় চলতে হলে ইন্টারনেট অপরিহার্য। বর্তমানে জ্ঞান ও তথ্য ভাণ্ডারের প্রধান বাহন বা প্লাটফরম হচ্ছে ইন্টারনেট। আমাদের জীবন ধারার যে বৈপ্লবিক বিবর্তন তা ইন্টারনেটেরই অবদান।

ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগকে শুধু সুযোগ হিসেবে না দেখে এটিকে বর্তমানে অধিকার হিসেবে দেখাই বাঞ্ছনীয়।

আন্তর্জাতিক বিশ্ব ইন্টারনেট ব্যবহারকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউরোপ এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

কাউন্সিল অব ইউরোপের পার্লামেন্টারি কমিটি ২০১৪ সালের মার্চে এটিকে এক ধরনের অধিকার হিসেবে গ্রহণ করেছে। ইউরোপ-যেখানে মানবাধিকার বা নাগরিক অধিকার (civil liberty) সর্বাধিকগুরুত্বপূর্ণ সেখানে ইন্টারনেটের অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, শিক্ষা ও গণমাধ্যম বিষয়ক সংসদীয় অ্যাসেম্বলি এ বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। তাদের প্রতিবেদনে ইন্টারনেটকে অধিকার হিসেবে স্বীকার করা হয়। এর মাধ্যমে সূচিত হয় মানবাধিকারের এক নতুন অধ্যায়।

‘মানবাধিকার’ বা ‘অধিকার’ ধারণার সাথে যোগ হয় এক নতুনমাত্রা। সুনির্দিষ্টভাবে এটি শুধু মত বা ভাব প্রকাশের ধারণার সঙ্গেই সম্পৃক্ত না, বরং অন্যান্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের সাথেও সম্পৃক্ত। নাগরিক ও রাজনৈতিক  (civil and political)  অধিকার এখন ইন্টারনেট ছাড়া এক অলীক কল্পনামাত্র। নাগরিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের বাস্তবায়নেও ইন্টারনেট বর্তমানে এক অপরিহার্য অংশীদার।

বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ডিজিটাল প্রজন্ম। তথ্য প্রযুক্তিতেই তাদের বসবাস ও জীবন ধারণ। তাদের প্রায় প্রতিটি কর্মযজ্ঞেই আছে ইন্টারনেটের প্রয়োগ। তথ্য প্রবাহের অবাধ দ্বার তাদের কাছে উন্মুক্ত। জ্ঞানের প্রতিটি শাখা এখন তাদের কাছে সমুদ্রসম। খুলে গেছে জ্ঞান ও তথ্যের বন্ধ দুয়ার। একে রোধ করার উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই।

প্রয়োজন যথোপযুক্ত ব্যবহার। প্রয়োজন শুধু গাইডলাইন। তবেই তারা জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।

জাতীয় উন্নয়নের জন্য দক্ষ ও কর্মক্ষম মানব সম্পদ প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের এ বিপুল জনসংখ্যাকে রাতারাতি জনসম্পদে পরিণত করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট রাখতে পারে বিশেষ ভূমিকা। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দ্রুতই বদলে দেয়া সম্ভব একটি জনগোষ্টীর চিন্তা ও চেতনার জগত। এটি সাংস্কৃতিক বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারা।

বিবর্তনের এ পর্যায়ে শিক্ষা ও তথ্যভাণ্ডারকে উন্মুক্ত করতে হবে। ডিজিটাল সেবার দ্বার উন্মুক্ত হলে আপনা আপনিই নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ চ্যালেঞ্চটি গ্রহণ করার জন্য প্রয়োজন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে দক্ষ জনসম্পদ। এ জনসম্পদ গড়তেও প্রয়োজন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রয়োগ।

ইন্টারনেটের এ ব্যবহার ও প্রয়োগ শুধু তরুণ প্রজন্মের জন্যই না। বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকই এখন প্রযুক্তি নির্ভর। ইন্টারনেট তথ্যপ্রযুক্তির প্রথম পাঠ। বয়স, আয় ও বসবাসের স্থান কাল নির্বিশেষে ইন্টারনেট বর্তমানে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ওই কমিটি এটিকে আইন ও নিয়মিত চর্চা করার মতো একটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করছে। অর্থাৎ এটি শুধু সাধারণ একটি আইনের কোটায় ফেলে বিবেচনা করা যাবে না। কারণ অনেক আইনই আছে যার কোনো চর্চা নেই। কিন্তু ইন্টারনেটের চর্চা সর্বব্যাপী।

ইউরোপীয় সংসদের ওই কমিটির প্রতিবেদন বলছে, “the right to Internet access includes the right to access, receive and impart information and idea through the Internet without interference by public authority, regardless of frontiers…”। অর্থাৎ ইন্টারনেট আজ আর কোনো রাষ্ট্রীয় অন্তর্জালে আবদ্ধ নেই। রাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে তা এখন আন্তর্জাতিক সীমানায় বিচরণ করছে। সর্বব্যাপী ও সার্বজনীন এক অধিকার।

২০১১ সালে জাতিসংঘের বিশেষ র‍্যাপোর্টার ফ্রাঙ্ক লা রু জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ১৭তম অধিবেশনের প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘cutting off users from internet access, regardless of the justification provided, to be disproportionate and thus a violation of article 19, paragraph 3, of the ICCPR.’ অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈকি কনভেনশনের ১৯ এর ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ইন্টারনেট অধিকার খর্ব করা উক্ত সনদের লঙ্ঘন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশই ওই সনদের অন্তর্ভূক্ত। ৩০তম অধিবেশনেও একই সুরে বলা হয়, ‘ restrictions on internet as a general challenge to participation in political and public affairs.’

ইন্টারনেটের গুরুত্ব অনুধাবন করে কয়েকটি রাষ্ট্র ইন্টারনেটের সুযোগকে মানবাধিকার হিসেব স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০০ সালে এসতোনিয়া ইন্টারনেটের সার্বজনীন অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। একই ভাবে ফান্সও এটিকে অধিকার হিসেবে মেনে নিয়েছে। ফ্রান্সে শুধু ইন্টারনেটই নয়, সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যমও অধিকার হিসেবে বিশেষভাবে সংরক্ষিত। খোদ সরকার চাইলেই তা বন্ধ করতে পারে না। এটি নাগরিকদের অধিকার লংঘনের শামিল।

সেখানকার সর্বোচ্চ আদালত বা সাংবিধানিক কাউন্সিল ইন্টারনেট ব্যবহার অধিকার খর্ব করাকে মানবাধিকারের পরিপন্থি বলে রায় দিয়েছে। এর মানে, এটিকে শুধু অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি আদালত, এ অধিকার যাতে অলংঘনীয় থাকে সে ব্যবস্থাও করেছে।

১৭৮৯ সালের মানবাধিকার সনদের (declaration of the rights of Man and the of the Citizens) ১১ অনুচ্ছেদের আদর্শকে আদালত রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘The free communication of thoughts and of opinions is one of the most precious rights of man: any citizen thus may speak, write, print freely, except to respond to the abuse of this liberty, in the cases determined by the law.’

২০১০ সালে কোস্টারিকার আদালতও ইন্টারনেট ব্যবহারের অধিকারকে একইভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

তবে, ফিনল্যান্ডের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২০১০ সালে দেশটি ব্রডব্যান্ডকে নাগরিকদের আইনগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। শুধু ইন্টারনেটই নয়, সুনির্দিষ্টভাবে ব্রডব্যান্ডকে নাগরিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে ফিনল্যান্ড।

ইউরোপে এরকম আরো অনেক নজীর আছে। গ্রীস মনে করে, ইন্টারনেট ব্যবহারের অধিকার প্রদান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। গ্রীস সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫(১)-এ বলা হয়েছে,  Each person is entitled to develop his personality freely and participate in the social, economic, and political life of the country, provided that he does not encroach upon the rights of others, the Constitution, or bona mores.’

বর্তমানে বাক স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, সামাজিক সম্পর্কসহ সব ক্ষেত্রেই ইন্টারনেট অপরিহার্য। এসব অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হলে ইন্টারনেট ব্যবহারেরও সুযোগ দিতে হবে। ইন্টারনেটের গতিকে আরো বেগবান করে জাতীয় উন্নয়ন তথা মানব উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে।

ইন্টারনেট বর্তমানে এক রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক তথা মানবিক শক্তি। এ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে হবে। শুধু সুযোগ হিসেবে বিবেচনা না করে আইনগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে জনগণের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে হবে। মানব উন্নয়নে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুফল পাওয়ার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

বাংলাদেশ সময় : ১০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৬

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।