ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

ব্রিটেনে ইসলামী শিক্ষার রূপকার মৌ. ইউসুফ মোতালার মৃত্যু

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৯
ব্রিটেনে ইসলামী শিক্ষার রূপকার মৌ. ইউসুফ মোতালার মৃত্যু শায়খ ইউসুফ মোতালা ও ব্রিটেনে তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা। ছবি: সংগৃহীত

মুহাম্মদ ইউসুফ ইবনে সুলাইমান ইবনে কাসিম মোতালা। ব্রিটিশ-ভারতীয় স্বনামধন্য ইসলামী স্কলার ও শিক্ষাবিদ। তিনি বিশ্ববিখ্যাত হাদিসবিশারদ ও ধর্মবেত্তা শায়খুল হাদিস আল্লামা মুহাম্মদ জাকারিয়া কান্ধলভীর অন্যতম ছাত্র ও শিষ্য। শায়খ মোতালা ব্রিটেনের সর্বপ্রাচীন মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

রোববার (০৮ সেপ্টেম্বর) দিনগত রাতে কানাডায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

শায়খ ইউসুফ মোতালার প্রতিষ্ঠিত ব্রিটেনের সর্বপ্রাচীন মাদরাসাটির নাম দারুল উলুম ব্যরি। ১৯৭৩ সালে তিনি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন। এছাড়াও তিনি আরও বড় বড় দারুল উলুম (ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র) ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

ব্রিটেনের মুসলিম সম্প্রদায়ের বিকাশে তার বৃহৎ ভূমিকা ও প্রভাব রয়েছে। এই বছর বিশ্বে সবচেয়ে ‘প্রভাবশালী মুসলিম তালিকা’য় তিনি সেরা ৫০০-তে ছিলেন।

পূর্বপুরুষ ও জন্ম-বৃত্তান্ত
বহু আলেম-ওলামার মুরুব্বি ও শাইখুল হাদিস আল্লামা ইউসুফ মোতালা ভারতীয় বংশোদ্ভুত ছিলেন। তার বাবার পরিবার ভারতের গুজরাট রাজ্যের সুরাট জেলার গ্রাম ভারেঠির বাসিন্দা ছিলেন।

ভারতে তাদের আয়ের মাধ্যম ছিল কৃষিকাজ। তবুও তার পিতামহ কাসিম মোতালা চুক্তিতে নিজের জমি ও কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরে আয়ের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ব্যবসা। কিন্তু জনাব কাসিম মোতালার হঠাৎ মৃত্যু হয়।

তার মৃত্যুর পর ইউসুফ মোতালার বাবা সুলায়মান মোতালাকে মা আদর-যত্নে বড় করেন। বড় হয়ে তিনি ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেন। এর কিছুদিন পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার বিয়ে হয়েছিল গুজরাটের সুরাট জেলার হাতুড়ান নামক গ্রামের অভিজাত পরিবারে। কিছুদিন পর তাদের ঘর আলোকিত করে মোহাম্মদ আলী নামে এক ছেলের জন্ম হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার স্ত্রী কয়েক বছরের ব্যবধানে মারা যান।

মাদরাসা আল-ইমাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, প্রোসটন।  এরপর সুলায়মান মোতালা শায়খ ইউসুফের মাকে বিয়ে করেন। এই সম্মন্ধ-সূত্র ছিল সুরাটের তাপসিটি নদীর তীরবর্তী খোলওয়াদ নামের এক গ্রামে। পরবর্তীতে কোনো কারণে শায়খের পরিবার নানি নারোলি নামক গ্রামে চলে আসেন। ১৯৪৬ সালের ২৫ নভেম্বর সোমবার রাতে নানির নারোলির নানা-বাড়িতে শায়খ ইউসুফ মোতালার জন্ম হয়।

পড়াশোনা ও শিক্ষা-দীক্ষা 
শায়খ ইউসুফ কোরআন হিফজ ও উর্দুর প্রাথমিক শিক্ষা নেন মাদরাসা তারগিব আল-কোরআনে। ১৯৬১ সালে তিনি জামেয়া হুসেনিয়ায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি প্রথম পাঁচ বছরে ‘আলমিয়া’ সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৬৬ সালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুরে ভর্তি হন। সে বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাক্ষেত্রে তার নতুনযাত্রা শুরু হয়।

তিনি শায়খুল হাদিস ইউনুস জৌনপুরি (রহ.)-এর কাছে হাদিস শাস্ত্রের মিশকাতুল মাসাবিহ, শায়খ মুহাম্মদ আকিল (রহ.)-এর কাছে তাফসিরে জালালাইন, মুফতি ইয়াহইয়া (রহ.)-এর কাছে ফিকাহশাস্ত্রের আল-হিদায়া (তৃতীয় খণ্ড) অধ্যয়ন করেন। পরে শায়খুল হাদিস জাকারিয়া কান্ধলভি (রহ.)-এর সাহচর্য-সান্নিধ্যে দ্বিতীয় বারের মতো মিশকাতুল-মাসাবিহ অধ্যয়ন করেন।

আরও পড়ুন: ব্রিটেনজুড়ে ইসলামী শিক্ষার সৌরভ

পরের বছর শায়খ ইউসুফ মোতালা শায়খুল হাদিস জাকারিয়া কান্ধলভি (রহ.)-এর কাছে সহিহ বোখারি, শায়খ ইউনুস জৌনপুরী (রহ.)-এর কাছে সুনানে আবু দাউদ ও সুনান আল-নাসাঈ ও মুওয়াত্তা মালিক, শায়খ মোজাফফর হোসাইন (রহ.)-এর কাছে সহিহ মুসলিম ও সুনানে তিরমিজি এবং শায়খ আবদুল্লাহ (রহ.)-এর কাছে শরহু মাআনিল আসার অধ্যয়ন করেন।

কর্ম-জীবন ও অন্যান্য
শায়খুল হাদিস জাকারিয়া কান্ধলভি (রহ.)-এর নির্দেশে শায়খ মোতালা ১৯৭৩ সালে ব্রিটেনের ল্যাঙ্কাশার, ব্যরির হোলকোম্বেতে ‘দারুল উলুম আল-আরবিয়্যাহ আল-ইসলামিয়্যাহ’ নামে ইংল্যান্ডের সর্বপ্রথম মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিশ্বের বহু ইসলামিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। পাশাপাশি বিশ্বের হাজার হাজার মুসলমানের আধ্যাত্মিক পথ-নির্দেশকও ছিলেন। তার হাজার হাজার ছাত্র পৃথিবীর দেশে দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে ও আঙ্গিকে ইসলাম ও দ্বীনের সেবায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন।

জানা যায়, যুক্তরাজ্যের ৭৫ শতাংশ ইংরেজি ভাষাভাষি আলেম-ওলামা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। তারা বর্তমানে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছেন।

জামেয়াতুল কাওছার, ল্যাংকাস্টার, ইংল্যান্ডশায়খ ইউসুফ মোতালা ব্রিটেনে কওমি মাদরাসার বিস্তারে ও সারা ব্রিটেনে দ্বীন-ধর্ম প্রচারে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাবিদ ছিলেন। ব্রিটেনে মুসলিম-কমিউনিটির উন্নতির জন্য মাদরাসা, ইসলামিক স্কুল, জামেয়া (ইসলামিক কলেজ) প্রতিষ্ঠায় জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন। তার ব্যক্তিজীবন ও শিক্ষাবিষয়ক কার্যক্রম মুসলিমরা ছাড়াও অন্য ধর্মের সর্বশ্রেণির মানুষের কাছে প্রশংসিত।  শিক্ষাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৪ সালে অফস্টেড (Office for Standards in Education, Children's Services and Skills: Ofsted) তাকে অনন্যতার স্বীকৃতি দিয়েছে।

তিনি যেসব মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন
এক.
দারুল উলুম আল-আরবিয়্যাহ আল-ইসলামিয়্যাহ (বালক মাদরাসা)। দুই. মদিনাতুল উলুম আল-ইসলামিয়া, কিডমিনিষ্টার (বালক মাদরাসা)। তিন. জামিয়াতুল ইমাম মুহাম্মদ জাকারিয়া ব্রাডফোর্ড (বালিকা মাদরাসা)। চার. মাদরাসা মিসবাহুল উলুম ব্রার্ডফোর্ড। পাঁচ. মারকাজুল উলুম ব্ল্যাকবার্ন (বালক-বালিকা মাদ্রাসা)। ছয়. মাদরাসা আল-ইমাম মুহাম্মদ জাকারিয়া বল্টন। সাত. মাদরাসা আল-ইমাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, প্রেসটন। আট. আজহার একাডেমি লন্ডন। নয়. আল-মারকাজুল ইলমি, ডেওসবারি (বালিকা মাদরাসা)। দশ. জাকারিয়া জামে মসজিদ, বোল্টন (বালক-বালিকা)।

ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা ও প্রশ্ন পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৯
এমএমইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।