ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

প্রিয় নবী (সা.)-এর বরকতময় নিমন্ত্রণে...

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৯
প্রিয় নবী (সা.)-এর বরকতময় নিমন্ত্রণে... আরবদের খাবারের ছবি। (প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত)

খন্দক যুদ্ধে পরিখা খননের কাজে রাসুলুল্লাহ (সা.) সশরীরে অংশ নিয়েছিলেন। সেই সময় সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর মধ্যে খাদ্যাভাব-অনটন লেগেই থাকতো। কোনো কোনো সময় পুরো দিন অনাহারে কাটাতে হতো। তা সত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরাম খুবই আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়ে পরিখা খনন কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

হাদিস ও ইতিহাসের গ্রন্থে বর্ণিত দৃশ্যটা তখন এমন ছিল—

মাটি তুলে তুলে তারা পরিখার কিনারাগুলোকে মজবুত করছেন আর কাজকে প্রাণময় করার জন্য রজয তথা বিশেষ ছন্দযুক্ত আরবি কবিতা আবৃত্তি করছেন। আবদুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (রা.)-এর সুন্দর ও সুমধুর কন্ঠে উচ্চস্বরে ভেসে আসছে, ‘হে আল্লাহ! তুমি যদি আমাদের হেদায়েত না দিতে, তাহলে আমরা দান-সদকাও করতাম না, নামাজও পড়তাম না।

কিছু কবিতা দীর্ঘ করে করে পড়ছিলেন। এতে সঙ্গীদের মধ্যে আবেগ-উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা আরো বেড়ে যায়। তারা পূর্ণোদ্যমে মাটি খনন করতে থাকেন।

হঠাৎ আরেকজন সাহাবি উচ্চস্বরে কবিতা আবৃত্তি করলে অন্যান্যরাও তার কন্ঠে কন্ঠ মেলাতে থাকেন। পরিখার আকাশ-বাতাস গুঞ্জরিত হয়, ‘আমরা তো সেই লোক যারা মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে এমর্মে বাইয়াত করেছি যে, যতক্ষণ পর্যন্ত দেহে প্রাণ আছে, ইসলামের উপর অটল থাকবো। ’

আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের জবাবে বলছেন, ‘হে আল্লাহ! আসল জীবন তো আখেরাতের জীবন। আনসার ও মুহাজিরদের আপনি ক্ষমা করে দিন। ’

সাহাবায়ে কেরাম তাদের ‘কমান্ডার ইন চিফ’ ও প্রিয় রাসুল (সা.)-এর পবিত্র মুখনিঃসৃত এসব বাক্য ও সুসংবাদবিশিষ্ট দোয়াসূচক কবিতা শুনে আরো উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত হতে থাকেন।

খননের সময় মাঝে-মধ্যে পাথর পাওয়া যেত। কারণ পুরো জমিনই ছিল পাথুরে। ছোট-খাটো শিলা হলে সাহাবায়ে কেরাম নিজেরাই ভেঙ্গে ফেলতেন। কিন্তু একদিন খননের সময় একটি ভারী পাথর বেরিয়ে আসে। সাহাবায়ে কেরাম সেটাকে ভাঙার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা কোনো মতেই ভাঙা যাচ্ছিল না। খননকাজ কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল। সাহাবায়ে কেরাম সবাই মিলে চেষ্টা করছেন। কিন্তু পাথরটি খুবই শক্ত ছিল।

পাঠকের জানা থাকার কথা, যুদ্ধের ময়দানে যখন কোনো সমস্যা বা অন্তরায় সৃষ্টি হলে তখন সর্বোচ্চ কমান্ডারের শরণাপন্ন হতে হয়। এখানে তো সর্বোচ্চ কমান্ডার ধারাবাহিকভাবে স্পটেই উপস্থিত রয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! অমুক জায়গায় একটি প্রকাণ্ড পাথর বেরিয়ে এসেছে, যা খননকাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। ’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সেটি ভাঙতে আমি নিজেই নিচে আসছি। ’

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারি (রা.) যিনি ওই ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি দেখছি ক্ষুধার কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পেটে পাথর বাঁধা রয়েছে। তিনদিন ধরে আমরাও কোনো কিছু খাইনি। আল্লাহর রাসুল (সা.) শাবল হাতে নিলেন। বিসমিল্লাহ পড়ে পাথরের উপর আঘাত করেন। সঙ্গে সঙ্গে তা ভেঙে বালির স্তুপে পরিণত হয়।

এদিকে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) মনে মনে একটি চমৎকার পরিকল্পনা করছিলেন। প্রসঙ্গত, খন্দকে অংশ নেওয়া সাহাবায়ে কেরামের জন্য বাড়ি যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কারো যদি কঠিন কোনো অপারগতা চলে আসে, তখন তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হতেন এবং নিজের প্রয়োজন কিংবা অপারগতা তুলে ধরতেন। তখনই তাকে অনুমতি দেয়া হত।

জাবের (রা.)-ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! একটি জরুরি কাজে আমার একটু ঘরে যেতে হই। অনুমতি চাচ্ছি। ’

রাসুলুল্লাহ (সা.) অনুমতি দিলে জাবের (রা.) তার ঘরে যান।  স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যে অবস্থা দেখেছি, তা আমি সহ্য করতে পারছি না। জানি না, কত দিন ধরে তিনি কিছু খাননি। ক্ষুধার জ্বালায় পেটে পাথর বাঁধা হয়েছে। প্রিয় সহধর্মিণী! বলো, ঘরে কি কিছু আছে খাওয়ার উপযোগী?

স্ত্রী বলেন, ‘হ্যাঁ। ঘরে সামান্য যব আর একটি ছাগলছানা আছে। ছাগলছানাটি যবেহ করে তার গোশত রান্না করা যেতে পারে। ’

জাবের (রা.) ছাগলছানাটি জবাই করেন। তার স্ত্রী যবগুলো দ্রুত ঢেঁকিতে পিষা আরম্ভ করেন। আটা তৈরি হয়ে গেলে তা মাখা শুরু করেন। জাবের (রা.) ও তার স্ত্রী গোশত পরিস্কার করে হাঁড়িতে ঢালেন। চুলায় আগুন জ্বালিয়ে গোস্তগুলো সিদ্ধ হবার জন্য রেখে দিলেন।

আটা মাখা শেষ। তবে এখনো রুটি বানানো শুরু করেননি। ভাবলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন তাশরিফ আনবেন, তখন গরম গরম রুটি বানিয়ে পরিবেশন করবেন। জাবের (রা.)-এর স্ত্রী খুবই আন্তরিকতা ও যত্ন সহকারে খাবার তৈরি করছেন। তিনি আজ দারুণ খুশি। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের ঘরে তাশরিফ আনবেন- এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে! তার জন্য ঘর-দুয়ার পরিস্কার করা হচ্ছে।

জাবের (রা.) খন্দকে ফিরে গেলেন। মূল জায়াগায় পৌঁছার পর আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হন। নিচু স্বরে আরজ করেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! ঘরে সামান্য খাবার তৈরি করিয়েছি। দুইজন সঙ্গী নিয়ে নিন। আমাদের ঘরকে আপনার চরণধুলি দিয়ে ধন্য করুন। ’

রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করেন, ‘খাবার কি পরিমাণ?’ আমি বলার পর ইরশাদ করেন, ‘অনেক, উত্তম। ’

প্রিয় পাঠক! রাসুলুল্লাহ (সা.) এর উন্নত চরিত্র লক্ষ্য করুন, তিনি সেই দাওয়াতকে একা গ্রহণ করেননি। কেবলমাত্র কয়েকজন সঙ্গীকেও সাথে নেননি; বরং পরিখা খননের কাজে উপস্থিত সবার জন্য ঘোষণা করা হয়, ‘উঠো। জাবেরের ঘরে চলো। সে তোমাদের দাওয়াত করেছে। ’ ‘হে খন্দকবাসী! জাবের ইবনু আবদুল্লাহ তোমাদের জন্য খাবার রান্না করেছে। এসো সবাই তার ঘরে যাই। ’

জাবের (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুখে দাওয়াতের ঘোষণা শুনে আমি বেকায়দায় পড়ে গেলাম। ঘরের খাবার তো তিন-চারজন লোকের সমপরিমাণ। কিন্তু খন্দকবাসীদের সংখ্যা তো এক হাজার। হায়, হায়, কী হবে?!

তবে এখানে যে নেতার নেতৃত্বে খননকাজ চলছে, তিনি তো অন্যদের খাওয়ানোর মানুষ। এখানে লোকজনের পেটে পাথর বাঁধা থাকলে, মহান নেতার পেটেও বাঁধা রয়েছে।

সাহাবায়ে কেরাম দাওয়াতের পয়গাম শুনে সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। সারিবদ্ধ হয়ে জাবের (রা.)-এর ঘরের দিকে রওয়ানা হয়ে যান।

আরও পড়ুন: খাবার গ্রহণে রাসুল (সা.) এর সুন্নত

এদিকে জাবের (রা.) অনেকটা দৌড়ে মুসলিম বাহিনীর আগে ঘরে পৌঁছে যান। তার স্ত্রী আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। স্ত্রীকে বলেন, ‘আমি তো আল্লাহর রাসুল (সা.) এবং তার কয়েকজন সঙ্গীকে দাওয়াত করেছিলাম। কিন্তু আল্লাহর রাসুল (সা.) তো গোটা বাহিনীকে দাওয়াত দিয়ে ফেলেছেন। জাবের (রা.)-এর স্ত্রী অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত মহিলা ছিলেন। তিনি বললেন, ‘তাহলে আপনি কি জন্য পেরেশান হচ্ছেন?’

এধরনের অবস্থায় আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-ই ভালো জানেন, কী করা উচিৎ। অর্থাৎ পুরো বাহিনীকে তো দাওয়াত তিনিই দিয়েছেন।

এদিকে রাসুলুল্লাহ (সা.) মূল বাহিনী আসার পূর্বেই জাবের (রা.)-এর ঘরের দিকে রওয়ানা হয়ে যান। জাবের (রা.)-কে আগেই এই নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়ে দেন যে, তুমি তোমার স্ত্রীকে বলবে, ‘আমি না আসা পর্যন্ত চুলার উপর থেকে যেন হাঁড়ি না নামায় এবং রুটিও যেন তন্দুর থেকে বের না করে। ’

আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন তাশরিফ আনেন তখন গোশতের হাঁড়ি প্রস্তুত। তিনি বিসমিল্লাহ পড়েন এবং লোকজনকে বলেন, ‘হে লোকজন! ভেতরে প্রবেশ করো, ধাক্কাধাক্কি করো না। ’

নবী করিম (সা.) রুটি তুলে তার মধ্যে গোশত রেখে রেখে লোকজনকে দিচ্ছেন। জাবের (রা.)-কে বললেন, ‘দশজন দশজন করে লোক পাঠাও। তারা এসে খাবার নিয়ে যাক। ’

আরও পড়ুন: প্রিয়নবী (সা.) যেসব খাবার পছন্দ করতেন

হাঁড়ি ও তন্দুর থেকে কিছু নেয়ার পর আবার ঢেকে দিতেন। দলে দলে মানুষ আসতে থাকে। খাবার গ্রহণ করতে থাকে। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের মাঝে খাবার বন্টন করে চলেছেন। লোকজন পরিতৃপ্ত হয়ে খাচ্ছেন। পরিশেষে পুরো বাহিনী যখন তৃপ্তিভরে খাবার খেয়ে নেয়, তখনই তিনি খেয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চারিত্রিক মাহাত্ম্য ও মাধুর্য দেখুন!

বাহিনীর একহাজার লোক পেট ভরে যখন খেয়ে নিলেন, তখন রাসুল (সা.) সাহাবি জাবের (রা.)-কে বললেন, ‘এখন মদিনাবাসীরাই অবশিষ্ট রয়েছে। ’ তোমরা খেয়ে নিলে, অবশিষ্ট খাবারগুলো তোমার প্রতিবেশী ও অন্যান্য মদিনাবাসীর মাঝে বন্টন করে দিও।

জাবের (রা.) বলেন, ‘আমরা গোশত ও রুটি আমাদের প্রতিবেশী ও মদিনাবাসীদের মাঝেও বন্টন করেছি। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম! রাত পর্যন্ত মদিনার কোনো ঘরই বাকি ছিল না, যেখানে এই গোশত ও যবের তৈরি রুটির অংশ পৌঁছেনি। ’

সিঃসন্দেহে এটা আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর মুজিজা বা অলৌকিকতা। তবে এই ঘটনা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উন্নত চরিত্রের দীপ্ত নিদর্শনও। নিজের সঙ্গীদের তিনি কত মুহব্বত করতেন! কত ভালোবাসতেন! তাদের কষ্ট কী গভীরভাবে অনুভব করতেন! এই ঘটনা থেকে তা সহজেই অনুমেয়।

লেখক: কর্মকর্তা, বাংলাদেশ দূতাবাস, রিয়াদ, সৌদি আরব

ইসলাম বিভাগে লিখতে পারেন আপনিও। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৯
এমএমইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।