ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

হজে যেসব স্থানে দোয়া কবুল হয়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১৯
হজে যেসব স্থানে দোয়া কবুল হয় পবিত্র কাবা শরিফের নান্দনিক ও আধ্যাত্মিক আবহপুর্ণ দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

যেকোনো প্রাণী ও জীবের কথা মহান আল্লাহ তাআলা শোনেন। পৃথিবীর যে জায়গা থেকেই মানুষ দোয়া করুক—তিনি তা শুনতে পান। মানুষ যখন কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, তখন তিনি কবুল করেন। তবে কিছু বিশেষ স্থানে দোয়া কবুল হওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সে জন্য সেসব স্থানে মনোযোগ সহকারে, বিনম্রচিত্তে অশ্রুসজল নয়নে দোয়া করা দরকার।

স্বাভাবিকত হজের সফর দোয়া কবুলের অপূর্ব সুযোগ। হজ বা ওমরাহর জন্য ইহরামের নিয়ত করা থেকে দোয়া কবুল হওয়া শুরু হয়।

হজের সফরে এমন কিছু সময় ও স্থান রয়েছে, যে সময় ও স্থানে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, যে স্থানগুলোতে নবী-রাসুলদের দোয়া কবুল হয়েছিল বলে বর্ণিত আছে। সেসব জায়গায় দোয়া করা বাঞ্ছনীয়। মক্কা শরিফের সব স্থানে দোয়া কবুল হয়। দোয়া কবুলের প্রসিদ্ধ কিছু স্থান উল্লেখ করা হলো।

প্রসঙ্গত দোয়া আরবিতেই তরতে হবে এটা জরুরি নয়। আপনি আপনার ভাষায় যত চাওয়া-পাওয়া আছে সব আল্লাহর কাছে তুলে ধরবেন, চোখের পানি ফেলবেন- এ সুযোগ আপনার জীবনে আর নাও আসতে পারে।

বায়তুল্লাহ দৃষ্টিগোচর হলে
আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ দেখে দোয়া করা। বায়তুল্লাহ শরিফ দেখামাত্র দোয়া করা। বর্ণিত আছে, বায়তুল্লাহ শরিফ প্রথম নজরে আসার পরে যে দোয়া করা হবে তা কবুল হবে।

হারাম শরিফ ও মসজিদুল হারাম
হারাম শরিফের সীমানা বায়তুল্লাহর পশ্চিমে জেদ্দার পথে শুআইদিয়া পর্যন্ত ১০ মাইল, পূর্বে জেরুজালেমের পথে ৯ মাইল, দক্ষিণে তায়েফের পথে ৭ মাইল এবং উত্তরে মদিনা শরিফের পথে ৫ মাইল। আর মসজিদুল হারাম হলো কাবা শরিফের চারদিকের বৃত্তাকার মসজিদ।

হাতিমের ভেতরে
কাবা ঘরসংলগ্ন উত্তর দিকে অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালঘেরা স্থানটা ‘হাতিম’। এই স্থানটুকু আগে কাবাঘরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। নবী করিম (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তির কিছুদিন আগে কাবাঘরের সংস্কার করা হয়। এ সময় হালাল অর্থের অভাবে পূর্ণ কাবা নির্মাণ সম্ভব হয়নি বিধায় হাতিম অংশ বাদ রেখে নির্মাণ করা হয়েছে।

মুলতাজাম ও মিজাবে রহমত
দোয়া কবুলের অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান মুলতাজাম। হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) থেকে কাবা শরিফের দরজা পর্যন্ত জায়গাটুকুকে মুলতাজাম বলে।

কাবাঘরের ছাদের পানি পড়ার জন্য উত্তর পাশে হাতিমের ভেতরে মাঝখান বরাবর সোনার পরনালা হচ্ছে মিজাবে রহমত।

কাবা শরিফের রুকন
কাবাঘরের প্রত্যেক কোণকে রুকন বলা হয়। কাবাঘরের উত্তর-পূর্ব কোণকে বলা হয় রুকনে ইরাকি, উত্তর-পশ্চিম কোণকে বলা হয় রুকনে শামি এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোণকে বলা হয় রুকনে ইয়ামানি।

রোকনে ইয়ামানি ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যস্থল: তাওয়াফের প্রতি চক্করে এই স্থানে পড়তে হয়, ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাছানা, ওয়া ফিল আখিরাতি হাছানা; ওয়া কি না আজাবান নার। ’  (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২০১)।

হাজরে আসওয়াদ ও কাবার দরজা
কাবাঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দেয়ালে লাগানো জান্নাতি পাথর হলো হজরে আসওয়াদ। আর কাবাঘরের দরজা সবার কাছে স্পষ্ট।

মাকামে ইব্রাহিম ও তাওয়াফের স্থান
কাবা শরিফের পূর্ব দিকে মাতাফ বা তাওয়াফের স্থানে যে পাথরখণ্ড সংরক্ষিত আছে, সেটিকে মাকামে ইব্রাহিম বলা হয়। এর ওপর দাঁড়িয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘরের প্রাচীর গাঁথতেন। আর মাতাফ বা তাওয়াফের স্থানে হলো- কাবা শরিফের চতুর্দিকে তাওয়াফের জন্য উন্মুক্ত স্থান।

সাফা-মারওয়া পাহাড় ও সাইর মধ্যবর্তী স্থান
সাফা ও মারওয়া পাহাড় আল্লাহর নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ দুই পাহাড়ের মাঝে সাঈ করা হাজিদের জন্য ওয়াজিব। উভয় পাহাড়ই দোয়া করা ও দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম স্থান। সাফা কাবা শরিফের পূর্ব পাশের নিকটতম পাহাড়, যেখান থেকে সাঈ শুরু করতে হয়। আর মারওয়া পাহাড় সাফা থেকে থেকে ৪৫০ মিটার দূরত্বে অবস্থিত; এখানে সাঈ শেষ হয়। সাফা ও মারওয়া এই দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সাঈর স্থান, যেটা ‘মাসআ’ নামে পরিচিত; সেখানে দোয়া করলেও কবুল হয়।

সাঈর পথে ‘আখদারাইন’
এছাড়া সাঈ করার সময় সাফা পাহাড় থেকে মারওয়া পাহাড়ের দিকে ৫০ গজ গেলে দেয়ালে সবুজ বর্ণের বাতি দিয়ে চিহ্নিত প্রায় ৪০ হাত স্থান নির্ধারিত রয়েছে। এ জায়গায় সাঈকারীরা হাজেরা (আ.) এর অনুসরণে কিছুটা দৌঁড়ান। এ স্থানে দোয়া করলেও দোয়া কবুল হয়।

আরাফাতের ময়দান
হজরত আদম (আ.)-এর সঙ্গে হজরত হাওয়া (আ.)-এর পুনর্মিলন হয় আরাফাত ময়দানে। এখানেই তাঁদের তওবা কবুল হয়। আরাফার মাঠে আরাফার দিবসের মূল অবস্থান ও আমলই দোয়া। এ দিন দোয়া-মোনাজাতের গুরুত্ব অপরিসীম। জোহর ও আসরের নামাজকে জোহরের প্রথম ওয়াক্তের মধ্যে একত্রে আদায় করে নিবেন। কোনো সুন্নত বা নফল নামাজ আদায় না করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সময় দোয়া-মোনাজাত ও কান্না-কাটিতে ব্যস্ত থাকবে। দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন।  

হজরত আদম (আ.)-এর সঙ্গে হজরত হাওয়া (আ.) এই দোয়াটি পড়েছিলেন, ‘রাব্বানা জালামনা আনফুছানা, ওয়া ইন লাম তাগফির লানা ওয়া তারহামনা; লানাকুনান্না মিনাল খছিরিন। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ২৩)

হাদিসে এসেছে, উত্তম দোয়া হলো আরাফার দিবসের দোয়া এবং উত্তম কথা হলো যা আমি এবং আমার আগের নবীরা বলেছেন। ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোনো শরিক নেই, রাজত্ব তারই, প্রশংসাও তার, তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। ’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩৫৮৫)

জাবালে রহমত ও মসজিদে নামিরা
বাংলায় বলা হয় দয়ার পাহাড়। এই পাহাড় আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত। আর মসজিদে নামিরা থেকে আরাফাতের দিন হজের ভাষণ দেওয়া হয়।

মুজদালিফায় দোয়া করা
মুজদালিফায় অবস্থানকালে দোয়া করা গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা যখন আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন করবে, মাশআরুল হারামের কাছে পৌঁছে আল্লাহকে স্মরণ করবে। (সুরা আল বাকারা, আয়াত: ১৯৮)

রাসুলুল্লাহ (সা.) মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায়ের পর ‘কুজা’ পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে উপস্থিত হতেন এবং সেখানে তিনি অবস্থান করতেন। এ স্থানটি বর্তমানে মাশআরুল হারাম মসজিদের সম্মুখভাগে অবস্থিত। একেবারে আকাশ পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত দোয়া ও মোনাজাতে মশগুল থাকতে হয়। মূলত এটিই হলো মুজদালিফার মৌলিক আমল।

মিনা প্রান্তরে ও মসজিদে খায়েফ
আল্লাহ তাআলার আদেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) স্বীয় তরুণ পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে যে স্থানে কোরবানির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়া মসজিদে খায়েফ মিনা প্রান্তরে অবস্থিত। এখানে আদিকাল থেকে আখেরি নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত ৭০ জন পয়গম্বর (আ.) আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করেছেন।

‘জামারাত’ বা কঙ্কর নিক্ষেপের পর
দোয়া কবুলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও সময় হচ্ছে, জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করে দোয়া করা। কঙ্কর নিক্ষেপের পর জামারার স্থান থেকে সামান্য সরে গিয়ে প্রাণ খুলে দোয়া করা।

মিনাতেই তিনটি ‘জুমরা’ (স্তম্ভ) অবস্থিত, এগুলোকে একত্রে ‘জামারাত’ বলে। এগুলো ছোট শয়তান (জুমরায়ে উলা), মেজ শয়তান (জুমরায়ে উস্তা), বড় শয়তান (জুমরায়ে আকাবা) নামে পরিচিত। হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানির পথে এই স্থানে শয়তান বাধা সৃষ্টি করলে তিনি পাথর ছুঁড়ে তাকে বিতাড়িত করেন।

বিদায়ী তাওয়াফ শেষে
হজের সব কর্ম পালন শেষ করে দেশে ফেরার আগে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হবে। তাওয়াফ শেষে আপনি মুলতাজামের কাছে চলে যাবেন। মুলতাজামে চেহারা, বুক, দুই বাহু ও দুই হাত রেখে দোয়া করবেন। এটিই আপনার শেষ সুযোগ। একে কাজে লাগান। আল্লাহর কাছে যা খুশি আপনি চাইতে পারেন।

জমজমের পানি পান করার সময়
জমজমের পানি পান করার সময় আপনার যা খুশি আল্লাহর কাছে চাইবেন। এখানে আপনি যা দোয়া করবেন, আল্লাহতায়ালা তাই কবুল করবেন।

এছাড়াও হজ-ওমরাহ সম্পন্ন করে বাড়িতে ফিরে আসার পরও ৪০ দিন পর্যন্ত হাজিদের দোয়া কবুল হতে থাকে বলে মত রয়েছে। উপরন্তু হাজি যত দিন পর্যন্ত ইচ্ছাকৃত কোনো কবিরা গুনাহে লিপ্ত হবেন না, তত দিন পর্যন্ত তার দোয়া কবুল হতে থাকবে।

দোয়ার সময় বেশি বেশি কান্নাকাটি করার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহর দিকে মনোযোগী হয়ে দোয়া করতে হবে। কারণ, অন্যমনস্ক হয়ে দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করেন না।

দোয়ায় আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রেখে দোয়া করা খুবই জরুরি। দোয়ার সময় এ বিশ্বাস মনে পোষণ করা চাই, আল্লাহ অবশ্যই আমার কথা শুনছেন এবং আমার দোয়া কবুল করছেন।

এছাড়া কাবাঘরের ভেতরে, মাকামে ইবরাহিমের পেছনে, মিনার মসজিদে খায়েফে মিজাবে রহমতের নিচে- যেখানে বায়তুল্লাহর ছাদের পানি পড়ে, মাকামে ইবরাহিমের পেছনে বেশি বেশি দোয়া করবেন।

ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৭ ঘণ্টা, আগস্ট ০৮, ২০১৯
এমএমইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।