ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

কাতারের প্রেসিডেন্ট মসজিদে বাংলাদেশি খতিব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৯
কাতারের প্রেসিডেন্ট মসজিদে বাংলাদেশি খতিব কাতারের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে বাংলাদেশি খতিব হাফেজ কারি সাইফুল ইসলাম। ছবি বাংলানিউজ

কাতারের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে প্রতি জুমায় খুতবা দেন একজন বাংলাদেশি খতিব। বাংলাদেশের জন্য এটি গৌরব ও আনন্দের বিষয়। একজন বাংলাদেশি হয়েও কীভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে যেতে পারলেন, তা নিয়ে পাঠকের কৌতূহল ভাঙাতে আমাদের আজকের আয়োজন।

গত বুধবার (০৯ জানুয়ারি) ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ সেন্টারে এসেছিলেন বাংলাদেশের গর্বিত এই সন্তান। মাগরিবের নামাজে সুমুধুর কণ্ঠে তিনি মিডিয়া হাউজের মুসুল্লিদের মন-মানস আপ্লুত করেন।

এরপর সন্ধ্যায় খানিক সময়ের মুগ্ধকর খোশগল্প পর্ব এবং বিভিন্ন বিষয়-আশয়ে আলোচনা।

কৃতি এই বাংলাদেশির নাম হাফেজ কারি সাইফুল ইসলাম। তার সাফল্যের শুরু ২০০৪ সালে। সে বছর ‘দুবাই হলি কোরআন এ্যাওয়ার্ড’-এ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি।

এরপর ২০১০ সালে আসে আরো বড় সাফল্য। জর্ডানে ৬০টি দেশের সম্মলিত তাফসিরুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অধিকার করে তিনি কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন। তখনও তিনি পড়াশোনা করছিলেন দেশের একটি স্বনামধন্য কওমি মাদরাসায়। এরপর দাওরা হাদিস (মাস্টার্স সমমান) সম্পন্ন করার পাশাপাশি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কাতার ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ লাভ করেন। সেখানে ২০১২ থেকে চার বছর মেয়াদে অনার্স সম্পন্ন করেন।

কীভাবে তিনি কাতার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে খুতবা প্রদানের সৌভাগ্য অর্জন করেন, সে প্রসঙ্গ খুবই চমকপ্রদ ও ঈর্ষণীয়। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৪ সাল থেকে কাতারের রাজপরিবারের সঙ্গে তার চমৎকার সম্পর্ক। সে বছর ‘দুবাই হলি কুরআন অ্যাওয়ার্ড’ জয়ের পর থেকে রাজপরিবারের সদস্য আবদুল আজিজ বিন খালেদ আবদুল্লাহ আল-থানি তাকে নিয়মিত কাতারে আমন্ত্রণ করতেন। প্রতি বছর আসা-যাওয়ার টিকিট ও আনুসাঙ্গিক খরচসহ দুইবার তাকে কাতার নিয়ে যাওয়া হতো। প্রথমবার যেতেন মাত্র এক সপ্তাহের আনন্দভ্রমণে। তখন মাদরাসায় অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা দিয়েই ছুটি কাটাতে ছুটে যেতেন কাতারের রাজধানী দোহায়।

দ্বিতীয়বার যেতেন রমজান-মৌসুমে। সেখানে রাজপরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের তিনি তারাবির নামাজে ইমামতি করতেন। তারপর তাদের সঙ্গে সৌদিতে গিয়ে ওমরা পালন করে ঈদের দিন দেশে ফিরে আসতেন। তার এমন দারুণ ও সুখময় আসা-যাওয়া ২০১২ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে খতিবের দায়িত্বে যেভাবে
হাফেজ মাওলানা সাইফুল ইসলাম জানান, কাতারের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে খতিবের দায়িত্ব তিনি রাজপরিবারে কিছু সদস্যের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে পাননি। বরং আল্লাহর মেহেরবানি ও করুণা এবং নিজের যোগ্যতায় পেয়েছেন।

জানা যায়, ২০১৫ সালে কাতার ইউনিভার্সিটিতে অনার্সের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় পার্শ্ববর্তী অভিজাত এলাকা দাফনাস্থ রমিলার সেনাবাহিনীর অফিসারদের ২০৭ নং মসজিদে খতিব হওয়ার সাধ জাগে তার মনে। কিন্তু বিষয়টি অতটা সহজ ছিল না। কারণ কাতারে ইমাম ও খতিবের নিয়োগ সরকারি পরীক্ষার মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু অনেক পরিশ্রম ও সাধনার পর কাতারের ধর্মমন্ত্রণালয়ের পরীক্ষাবোর্ডের সদস্যদের ‘কঠিন খুতবা’ পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন। এরপর থেকে উক্ত মসজিদে টানা এক বছর খতিবের দায়িত্ব পালন করার পর তাকে কাতারের আমিরের প্রাসাদ মসজিদে ট্রান্সফার করা হয়। বর্তমানে তিনি এ মসজিদে খতিবের দায়িত্বে রয়েছেন। পাশাপাশি স্থানীয় ‘শায়খ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল-উবাইদিলি’ মসজিদে ইমাম এবং তারাবির নামাজের দায়িত্বও পালন করছেন দীর্ঘদিন ধরে।

কাতারের প্রেসিডেন্ট মসজিদে বাংলাদেশি খতিব কারি সাইফুল ইসলাম।  ছবি : বাংলানিউজ

প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে খুতবা দেওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ
তিনি জানান, সেনাবাহিনীর মসজিদটিতে প্রদানকৃত তার খুতবাগুলো রাষ্ট্রের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিদের মন ছুঁয়ে যায় বেশ। এরপর ২০১৭ সালের রমজানে হঠাৎ ফোন করে তাকে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে জুমার খুতবা দিতে হবে। সেখানে কাতারের প্রেসিডেন্ট ও রাজপরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত থাকবেন।

এমন গুরুভার-দায়িত্ব সম্পর্কে ফোন পাওয়ার পর বেশ চিন্তায় পড়ে যান তিনি। মনে দ্বিধাদ্বন্ধ ও অজানা শঙ্কার ডালপালা গজাতে শুরু করে। কিন্তু জুমার দিন আগেভাগে কর্তৃপক্ষ গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার পরে তার মনে আশার সঞ্চার হয়। আল্লাহর কাছে দোয়া-প্রার্থনা করা হয়।

এরপর ২০১৭ সালের ২৯ জুলাই প্রথমবারের মতো খুতবা দিয়ে রাজপরিবারের মুসল্লি ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের মন জয় করেন। তখন থেকে তার এ গুরুদায়িত্ব এখনো বলবৎ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের সুনাম কুড়ানোর পাশাপাশি তিনি দায়িত্বে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে যাচ্ছেন।

হাফেজ সাইফুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া সদরের নয়নপুর পৌরসভা এলাকায়। তার বাবার নাম ডা. ওয়ালিউর রহমান। স্কুলে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তিনি মাদরাসায় ভর্তি হন। দেশের খ্যাতিমান কোরআনের হাফেজ মাওলানা আবদুল হকের কাছে হিফজ করেন। এরপর ২০১১ সালে দাওরা হাদিস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দারুল আরকাম মাদরাসা থেকে। ২০১২ সালে দেন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। এরপর স্কলারশিপ নিয়ে কাতার ইউনিভার্সিটিতে গমন করেন। ২০১৭ সালে সেখান থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স সম্পন্ন করেন।

দীর্ঘ আলোচনায় জানা যায়, আরবি বক্তৃতার প্রতি তার ছোটকাল থেকেই আলাদা টান ছিল। আরবদের স্টাইলে কথা বলতে চাইতেন। তাদের বাচনভঙ্গি অনুসরণ করতেন। এতে করে তার বক্তৃতাশৈলি সুন্দর হয়ে ওঠে।

দেশ-বিদেশে সাফল্য ও অর্জন
হাফেজ কারি সাইফুল ইসলামের দেশ-বিদেশে অনেক সাফল্য রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তিনি অনেকগুলো পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।  তন্মধ্যে ২০০৪ সালে দুবাই আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ২য় স্থান, ২০১০ সালে জর্ডানে আন্তর্জাতিক তাফসিরুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান, ২০০৪ সালে সৌদি আরবে আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ৪র্থ স্থান, ২০০৯ সালে ইরান আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ৪র্থ স্থান, ২০০৫ সালে আবারও জর্ডানে আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অর্জন করে বিদেশে দেশের মান উজ্জ্বল করেন।

বিদেশে থেকেও দেশ ও দশের সেবা
ধর্মীয় শিক্ষায় বৃহৎ পরিসরে কাজ করার মানসে তিনি ঢাকার শনিরআখড়া ও ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় আন্তর্জাতিক মানের কওমি ও হিফজুল কোরআন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত ‘মারকাজুত তানজিল আল-ইসলামিয়া ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসা’ বিশ্বব্যাপী দ্বীনি সেবার পাশাপাশি দেশের মানও উজ্জ্বল করবে বলে তিনি স্বপ্ন দেখেন। মাদরাসাটির মানগত পরিচর্যা ও কাঠামোত উন্নয়নে তিনি সার্বিক অর্থ-শ্রম ব্যয় করছেন বলেও জানান।

কাতারের প্রেসিডেন্ট মসজিদে বাংলাদেশি খতিব কারি সাইফুল ইসলাম দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাহফিলে বক্তব্য রাখছেন।  ছবি : বাংলানিউজ

দ্বীন ও ধর্মীয় জ্ঞানভিত্তিক কাজের জন্য বসুন্ধরা রিভারভিউতে জায়গা কিনে রেখেছেন তিনি।  এতে নিজস্ব জায়গায় স্থায়ী ও আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস গড়ে তুলবেন বলে জানান তিনি।

অল্প কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে দেশে এলেও তিনি কিন্তু বসে নেই। কোরআনের আলো ও জ্ঞান নিয়ে ছুটে চলছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ধর্মের চিন্তা ও মানুষের খোরাক বিতরণ করছেন বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিলে।

দীর্ঘ পরিসরে নিজ এলাকা ও দেশের মানুষের সেবা করার লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন বলে আমাদের জানান।  

কোনো প্রয়োজনে কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে কিংবা কিছু জানার আগ্রহ থাকলে তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বরে (01670905168) আলাপ করার অনুমতি রয়েছে।

ইসলাম বিভাগে লিখতে পারেন আপনিও।  লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৯
এমএমইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।