ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

পীর-আউলিয়াদের পূণ্যভূমি রাজশাহী

শরীফ সুমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৮ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৫
পীর-আউলিয়াদের পূণ্যভূমি রাজশাহী ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বহু পীর সাধকের পূণ্যভূমি রাজশাহী। এক সময় এই জনপদের মানুষ কুসংস্কার আর নানা কুসংস্কারের অতলে ডুবে ছিল।

এক সময় রাজশাহীতে দেব-দেবির নামে নরবলি দেওয়া হতো, সমাজে প্রকট ছিল- মানুষে-মানুষের ভেদাভেদের চিত্র। তখন থেকে এ অঞ্চলে পীর-সাধকের আগমন ঘটতে থাকে।

সুদূর মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের আগমন ঘটে। তারা এখানকার অবোধ মানুষের মাঝে জ্ঞানের দ্বীপ্ত শিখা জ্বালানোর উদ্দেশে জীবনের সবটুকু সময় ব্যয় করেন। এ জন্য তাদের ডিঙ্গাতে হয় নানা প্রতিকূলতার দেয়াল। যুদ্ধ এমনকি প্রাণও বিসর্জন দিতে হয় কাউকে কাউকে। তাদেরই একজন পদ্মার পাড়ে চির শায়িত আছেন। নাম হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.)। যার নামে এখনও পরিচিত হয় রাজশাহী।

রাজশাহী মহানগরের পদ্মার তীর ঘেষে গড়ে ওঠা শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.)-এর মাজার বা দরগা শরিফের কারণে ওই এলাকার নামই এখন দরগাপাড়া। দরগা মসজিদে প্রতিদিন ওয়াক্তিয়া নামাজে প্রচুর লোকের সমাগম ঘটে। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে ওরসসহ নানা ইসলামি আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এদিন দরগায় তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না।

শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.)-এর উসিলা ধরে আল্লাহতায়ালার অপার সন্তুষ্টি লাভের আশায় এখানে এসে ধর্মপ্রাণ মানুষ নফল নামাজ আদায়সহ নানা বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগি করে থাকেন। অনেকে আবার শুধু মাজার জিয়ারত করেই চলে যান। এ মাজার দর্শনে শুধু মুসলমান নয়, প্রচুর ভিন্ন ধর্মের মানুষও এসে থাকে। তারা তাদের নিজ নিজ বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা থেকে শিরনি বিতরণ।

হজরত শাহ মখদুম (রহ.) দরগার তিন গম্বুজ মসজিদটি নবাব আমলে তৈরি হয় বলে জনশ্রুতি আছে। আর এটা সম্পর্কে রয়েছে নানা কাহিনি। যতদূর জানা যায়, জনৈক মুসলিম সওদাগর নদীপথে বিপদাপন্ন অবস্থায় হজরত শাহ মখদুম (রহ.)-এর উসিলা ধরে আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন। পরে ওই ব্যবসায়ী বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ ৪০ ফুট, প্রস্থ ১৬ ফুট। ভিতরের পরিসরের দৈর্ঘ ৩৪ ফুট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ফুট ১০ ইঞ্চি। তিনটি মেহরাবের মধ্যে মাঝেরটি অপক্ষোকৃত বড়।

উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে দুইটি করে চারটি তাক ও একটি করে দুইটি জানালা রয়েছে। পূর্ব দেয়ালে সমপরিমাপের তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। এর কপাটগুলো পরে নির্মাণ করা হয়। ২০ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে পরপর দুইটি বারান্দা ও মিনার নির্মাণ করা হয়।

বিভিন্ন গ্রন্থে জানা যায়, হজরত শাহ মখদুম (রহ.) ছিলেন বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর পৌত্র এবং আজাল্লাহ শাহর দ্বিতীয় পুত্র। তিনি ৬১৫ হিজরির ২ রজব তারিখে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। রূপোশ তার উপাধি। আর শব্দটি ফারসি। যার অর্থ মুখ আবরণকারী। তার উপাধি থেকে বোঝা যায় যে, সাধারণ মানব বৈশিষ্ট্য ছাড়াও তার মধ্যে অসাধারণ কিছু ক্ষমতা লুকায়িত ছিল। হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.)-এর রাজশাহী আগমনের অন্তরালে পাওয়া গেছে বিস্তৃত ইতিহাস।

১২৫৯ খ্রিস্টাব্দে হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করলে বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর বংশধররা বাগদাদ থেকে কাবুল, কান্দাহার, পারস্য ও পাক ভারতের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.)-এর পিতা আজাল্লা শাহ দিল্লিতে আশ্রয়গ্রহণ করেন। উন্নত চরিত্র ও গুণাবলীর প্রতি মুগ্ধ হয়ে দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তার কাছে বায়েত হন।

পিতার সহচার্যে তিন পুত্র সৈয়দ মুনির উদ্দীন আহমদ (রহ.), হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) ও সৈয়দ আহমদ তম্বরী (রহ.) আধ্যাত্মিক সাধনায় সমৃদ্ধ লাভ করেন। হালাকু খানের মৃত্যুর পর শাহ আজাল্লা বাগদাদে ফিরে যান। তার পুত্ররা ইসলামের বাণী প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে হেদায়েতের উদ্দেশে অনুচরবর্গসহ বাংলায় আগমন করেন। তখন রাজশাহী মহানগরের নাম ছিল মহাকাল গড়।

এখানে মহকাল দেবের বিখ্যাত মন্দিরে নরবলি দেওয়া হতো। তার স্মৃতি এখনও হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) দরগা শরিফে রক্ষিত আছে। মহাকাল গড়ে সেময় বহু রকমের দেব-দেবতার প্রতিমূর্তি ও মঠ-মন্দিরে পূর্ণ ছিল। হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.)-এর সমাধি সৌধের প্রবেশদ্বারের উপরিভাগে জনৈক আলীকুলী বেগ কর্তৃক রচিত ফারসি ভাষায়া চার লাইনের একটি শিলালিপি আছে। এই লিপিতে শাহ দরবেশের মাজারের ওপর গম্বুজ নির্মাণের কথা উল্লেখ আছে। (১০৪৫ হিজরী বা ১৬৩৫ খ্রি.) শিলালিপির সারমর্ম অনুযায়ী আলীকুলী বেগ বারো ইমাম মতাবলম্বি গোঁড়া শিয়া মুসলমান এবং পারস্যের শাহ আব্বাসের একজন ভক্ত ছিলেন।

তিনি এ দেশের নবাগত হিসেবে স্থানীয় মুসলমানদের সহানুভূতি লাভের আশায় হজরত শাহ মখদুম (রহ.)-এর সমাধি নির্মাণ করেছিলেন।

হজরত শাহ মখদুম দরগা মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ধর্মীয় কুসংস্কারের জায়গা থেকে এখনও মাজারকে ঘিরে নানা কাজকর্ম হয়ে থাকে যা শরিয়তসম্মত নয়। শিরক থেকে দূরে থাকার জন্য বিভিন্ন সময় তিনি জুম্মার বিশাল জমায়েতে বয়ান করে মানুষকে সচেতন করে থাকেন। এর পরও এক শ্রেণির মানুষ জায়েজ নয় এমন কাজ করে থাকেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৮ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৫
এসএস/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।