শেষ হয়েও হচ্ছে না শেষ। আফগানিস্তানের ওপর আবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখ পড়েছে।
তার দাবি, চীন এখন বাগরাম নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রায় এক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ফিরে যেতে পারে বলে ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, চীনের বাড়তে থাকা প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাগরামে একটি ছোট বাহিনী রাখতে যাচ্ছে।
ট্রাম্পের কথা হলো, আফগানিস্তানের কারণে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র ঘাঁটিটি চীনের কারণে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। তার ব্যাখ্যা, বিমানঘাঁটিটি চীনের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর কাছে, মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে। এটিই তার কাছে স্থানটির প্রাথমিক কৌশলগত মূল্য।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের সমালোচনা তিনি বারবার করেছেন। তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আবার নির্বাচিত হলে তিনি বাগরাম বিমানঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ আবার নেবেন।
অবশ্য বাগরামের ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ট্রাম্পের দাবি জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে তালিবান। গোষ্ঠীটির মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ট্রাম্পের এমন দাবি আবেগের বহিঃপ্রকাশ এবং ভুল তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাগরাম এখনও তালিবানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং আফগানিস্তানে চীনা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি নেই।
মুজাহিদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্য দেওয়া বন্ধ করা উচিত। বাগরাম তালিবানের নিয়ন্ত্রণে, চীনের নয়। কোনো দেশের সঙ্গে তালিবানের এমন কোনো চুক্তি নেই বলে তিনি দাবি করেন। তিনি আফগানিস্তান সম্পর্কে ট্রাম্পের তথ্য সংশোধন করার জন্য ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের প্রতি আহ্বান জানান।
বাগরাম বিমানঘাঁটি
বাগরাম বিমানঘাঁটির কৌশলগত গুরুত্ব বেশ। কাবুল উপত্যকার উত্তর দিকে আফগানিস্তানের পারওয়ান প্রদেশের রাজধানী শহর চারিকর থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ওই ঘাঁটি আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই দশকের উপস্থিতির সময় বৃহত্তম মার্কিন সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
ট্রাম্প নিজেই এটিকে পৃথিবীর অন্যতম বড় বিমানঘাঁটি এবং সবচেয়ে শক্তিশালী রানওয়েগুলোর একটি হিসেবে বর্ণনা করেন। ১৯৫০-এর দশকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এটি নির্মাণ করে। ১৯৭৯ সালের সোভিয়েত–আফগান যুদ্ধ শুরুর পর এটি আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয়।
২০০১ সালে তালিবানদের উৎখাত করা এবং ওসামা বিন লাদেনকে ধরার চেষ্টার সময় যুক্তরাষ্ট্র বাগরাম দখল করে। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী সেখানে সংঘাতের সময় আটকদের রাখার জন্য একটি কারাগার প্রতিষ্ঠা করে। সেটি ‘আফগানিস্তানের গুয়ান্তানামো’ হিসেবে কুখ্যাতি পায়।
আল-কায়েদার সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিআইএ কারাগারটি ব্যবহার করত। যুক্তরাষ্ট্র ঘাঁটিটি প্রায় ৩০ বর্গমাইল পর্যন্ত পুনর্নির্মাণ এবং সম্প্রসারণ করে। সেখানে ১০ হাজার সৈন্যের থাকার ব্যবস্থা ছিল। ঘাঁটিটিতে সুইমিং পুল, সিনেমা হল, স্পা এবং বার্গার ও পিৎজার মতো ফাস্টফুডের আউটলেট ছিল।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প তালিবানদের সঙ্গে সৈন্য প্রত্যাহারের চুক্তি করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে তা বাস্তবায়িত হয়েছিল। সম্প্রতি ট্রাম্প আবারও বলেন, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার পরও তার প্রশাসন বাগরাম ঘাঁটি ধরে রাখার পরিকল্পনা করেছিল। এখন চীন তা নিয়ন্ত্রণ করছে।
৯/১১-এর পর দুই দশক ধরে সামরিক উপস্থিতির পর বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নেয়। এটি আফগানিস্তানে আশরাফ গনির সরকারের পতন ডেকে আনে। ফলে তালিবান গোষ্ঠী দ্রুত ক্ষমতা দখল করতে সফল হয়।
ন্যাটো-প্রশিক্ষিত আফগান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করা মাত্রই গনির সরকারের পতন ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে তালিবান দ্রুত দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। বাগরাম ঘাঁটিও তাদের দখলে যায়।
আফগানিস্তানে এখনো রয়ে গেছে মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম
ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তালিবানের মধ্যে বিরোধের আরেকটি কারণ হলো, সেনা প্রত্যাহারের পরও মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম আফগানিস্তানেই রয়ে গেছে। প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রতিবেদন অনুসারে, আফগান সরকারকে সরবরাহ করা প্রায় সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরেও দেশটিতে রয়ে গেছে।
ট্রাম্প এর সমালোচনা করে বলেন, আফগানিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিয়েছে, তবুও সেসব সামরিক সরঞ্জাম রেখে আসা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, তখন তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলে এমনটি ঘটত না।
ট্রাম্প আরও দাবি করেন, তালিবান এখন মার্কিন সরঞ্জাম বিক্রি করে দিচ্ছে। যার ফলে আফগানিস্তান সামরিক সরঞ্জামের অন্যতম বড় বিক্রেতা হয়ে উঠেছে। গোষ্ঠীটি সাত লাখ ৭৭ হাজার রাইফেল, ৭০ হাজার সাঁজোয়া ট্রাক ও ৭০ হাজার যানবাহন বিক্রি করছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রেরই ফেরত পাওয়া উচিত।
তবে তালিবান এসব সামরিক সরঞ্জামকে ‘যুদ্ধের লুণ্ঠন’ হিসেবে দেখে। তালিবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, তারা আফগানিস্তানকে রক্ষা করার জন্য অস্ত্রগুলো ব্যবহার করবে। পাশাপাশি তাদের দেশ হুমকির সম্মুখীন হলেও সেসব অস্ত্র ব্যবহার করবে।
সামরিক ব্যবহারের বাইরেও তালিবান যোদ্ধাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্রগুলোর প্রতীকী মূল্য রয়েছে। এসব অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করার তালিবানি বয়ানকে আরও শক্তিশালী করে। অস্ত্রগুলো তালিবানের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট-খোরাসানের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই করার ক্ষমতাকেও শক্তিশালী করে।
আফগানিস্তানে চীনের সম্প্রসারণ পদক্ষেপ
যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে আফগানিস্তানে একটি ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতা পূরণে আগ্রহী চীন। ২০২৩ সালে চীনা কোম্পানিগুলো তালিবান সরকারের সঙ্গে একাধিক ব্যবসায়িক চুক্তি সই করেছে। তবে চীন আফগানিস্তানে তাদের সামরিক উপস্থিতি অস্বীকার করে আসছে।
আফগানিস্তানে অবকাঠামো প্রকল্প এবং সম্পদ বিনিয়োগে চীন মন দিয়েছে। দেশটির এসব কার্যকলাপ বাড়তে থাকায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা আবার গড়ে উঠছে। চীনের সম্পৃক্ততা কৌশলের মধ্যে রয়েছে-
প্রথম বছরে ১৫ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের ২৫ বছরের তেল উত্তোলন চুক্তি। এটি তিন বছরে ৫৪ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
আফগানিস্তানের খনিজ খাত, বিশেষ করে লিথিয়াম মজুতকে লক্ষ্য করে চীন বিনিয়োগ বাড়াতে চায়। চীন তার উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এ আফগানিস্তানকে একীভূত করতে চায়।
তালিবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না দিলেও ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তালিবান-নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে চীন প্রথম স্বীকৃতি দেয়।
চীনের স্বার্থ অর্থনীতির বাইরে নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও রয়েছে। চীনের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের জন্য হুমকি হতে পারে, এমন সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হওয়া থেকে আফগানিস্তানকে প্রতিরোধ করার জন্য দেশটি তালিবান গোষ্ঠীর সহযোগিতা চায়। তালিবান-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যেন আশ্রয় না পান, চীন তাও নিশ্চিত করতে চায়।
তালিবানকে যেহেতু পশ্চিমারা দূরে ঠেলে দিয়েছে, তাই চীনের সম্পৃক্ততা তাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প। আফগানিস্তানে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আর উচ্চ বেকারত্ব যখন দুই কোটি ৩৭ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করছে, তখন অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত হওয়ার জন্য চীনের আগ্রহ তালিবানের অবস্থানকে শক্তিশালী করে।
চীন-তালিবান সম্পর্ক কি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি?
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থান তালিবানকে আরও চীনের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই ট্রাম্প হয়তো সাবধানী চাল দেবেন। তাইওয়ান ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে উত্তেজনা এখন বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে চীন-তালিবান ঐক্য ঠেকাতে ট্রাম্পকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে।
আফগানিস্তানে সরাসরি সামরিক সংঘাত শেষ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু দেশটিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য কৌশলগত যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। বাগরাম বিমানঘাঁটি সেই আঞ্চলিক আধিপত্যের অমীমাংসিত প্রতিযোগিতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০২৫
আরএইচ