ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

মোবাইল টেকনোলজি: 3G, 4G এবং LTE

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩০ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৭
মোবাইল টেকনোলজি: 3G, 4G এবং LTE ফোর জি: চিত্র

মোবাইল ফোনের প্রতি মানুষের আসক্তি দিনদিন যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিটিআরসির তথ্যানুসারে, এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহক সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ কোটি। তাদের মাঝে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৬ কোটি ৩১ লক্ষ যা জানুয়ারির চেয়ে প্রায় ১ লক্ষ বেশি। গোটা পৃথিবী জুড়েই মোবাইল ফোনের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোবাইল অপারেটরদের সংস্থা GSMA এর এক জরিপ অনুসারে, মোবাইল ব্যবহারকারীদের সংখ্যা এই বছর শেষে ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি অতিক্রম করবে।

মোবাইল ফোনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই খাতে প্রযুক্তি উন্নততর হচ্ছে। গত ৪০ বছরেই মোবাইল প্রযুক্তি ৪ জেনারেশন অতিক্রম করে ফেলেছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন 4G বা চতুর্থ জেনারেশন মোবাইল প্রযুক্তি চলছে এবং 5G প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাজ চলছে। বাংলাদেশে 3G চালু হয় ২০১২ সালের আগস্ট মাস থেকে। অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বাংলাদেশে যত দ্রুত সম্ভব চতুর্থ জেনারেশন বা 4G প্রযুক্তি নিয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার এবং বিটিআরসি। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয় বিটিআরসির সাথে এক বৈঠকে দেশে  যত দ্রুত সম্ভব 4G চালু করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এই বছরের মধ্যেই দেশের বেশ কিছু মোবাইল অপারেটর কোম্পানি 4G সেবা দিতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।

3G এবং 4G নিয়ে মানুষের মাঝে কৌতুহল দেখা দিলেও 4G বলতে আসলে কি বোঝায় তা অনেকেই জানেন না। 3G এবং 4G প্রযুক্তির পার্থক্য কেমন এবং 4G প্রযুক্তি কিভাবে আমাদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দেবে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
চিত্র ২
প্রথমেই G দ্বারা কি বোঝায় তা উল্লেখ করে নেই। 3G বা 4G এর G দ্বারা Generation বা প্রজন্ম বোঝানো হয়। অর্থাৎ 4G দ্বারা চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তি বোঝায়। প্রথম জেনারেশন বা 1G দ্বারা অ্যানালগ সেলুলার ফোন এবং দ্বিতীয় জেনারেশন বা 2G দ্বারা ডিজিটাল সেলুলার ফোন সিস্টেম বোঝানো হয়। কিন্তু পরের প্রজন্মগুলো অ্যানালগ বা ডিজিটাল দ্বারা নয় বরং ডাটা ট্রান্সফার করার দক্ষতা দ্বারা ভাগ করা হয়। অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের ফোনের ডাটা ট্রান্সফার রেট সাধারণত বেশি হয়।

2G এর সময় থেকেই মোবাইল ফোনের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজে মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু করে। কিন্তু 2G এর ডাটা স্পিড মানুষের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। তাই বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি 2G এর বিকল্প খুঁজতে শুরু করে। ফলাফল হিসাবে আমাদের কাছে আসে মোবাইল ফোনের নতুন প্রজন্ম থ্রিজি। 2G এবং 3G এর মাঝে মূল টেকনোলজিকাল পার্থক্য হলো যে 3G তে ডাটা ট্রান্সফারের জন্য "সার্কিট সুইচিং" পদ্ধতির বদলে "প্যাকেট সুইচিং" পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। যার ফলে ইন্টারনেটে দ্রুত সংযোগ স্থাপন করা যায় এবং ডাটা ট্রান্সফার স্পিড বা ইন্টারনেট স্পিড বেশি হয়। থ্রিজি প্রযুক্তিকে "মোবাইল ব্রডব্যান্ড"ও বলা হয়। 3G প্রযুক্তি হতে হলে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (ITU) দ্বারা স্বীকৃত ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন-২০০০ (IMT-2000) এর নিয়মাবলী মেনে চলতে হয়। 3G প্রযুক্তির মাধ্যমে মোবাইলে কথা বলা ছাড়াও ওয়্যারলেস ইন্টারনেট ব্যবস্থা,  ভিডিও কল এবং মোবাইল টিভি উপভোগ করা যায়। থ্রিজি ইন্টারনেটে ডাটা ট্রান্সফার স্পিড ন্যুনতম ১৪৪ কিলোবিট পার সেকেন্ড থাকবে বলে আশা করা হয় এবং এই স্পিড সর্বোচ্চ কয়েক মেগাবিট পার সেকেন্ড পর্যন্ত হতে পারে।

২০০৯ সালের দিকে দেখা যায় যে, স্ট্রিমিং মিডিয়ার মত ব্যান্ডউইথ-ইন্টেন্সিভ অ্যাপ্লিকেশনগুলোর জন্য থ্রিজি ইন্টারনেট যথেষ্ট নয়। স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি পরবর্তী ধাপ বা ফোরজি টেকনোলজির লক্ষ্যে কাজ করতে থাকে। ফোরজি খ্যাতি নিয়ে সর্বপ্রথম যে দুটি প্রযুক্তি বাজারে আসে তারা হলো ওয়াইম্যাক্স স্ট্যান্ডার্ড (WiMAX) এবং লং টার্ম ইভালুয়েশন বা এলটিই স্ট্যান্ডার্ড (LTE)। একটি ফোরজি সিস্টেমে ITU স্বীকৃত IMT Advanced এর যোগ্যতা থাকতে হবে। আগের যে কোনো জেনারেশন থেকে ফোরজির প্রধান প্রযুক্তিগত পার্থক্য হচ্ছে এটি যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সার্কিট-সুইচ পদ্ধতি একেবারেই ব্যবহার করে না বরং "অল-ইন্টারনেট প্রটোকল" ভিত্তিক যোগাযোগ তৈরি করে।
চিত্র ৩

ফোরজির বেশ কিছু প্রযুক্তি বাজারে রয়েছে - যেমন HSPA+ 21/42, WiMAX এবং LTE। তবে অনেকে এদের মাঝে শুধু LTE কেই প্রকৃত ফোরজি বলেন। কারণ অন্য যেকোন প্রযুক্তির চেয়ে LTE এর স্পিড বেশি। 4G LTE এর স্পিড সাধারণত ৫ মেগাবিট পার সেকেন্ড থেকে ১৫ মেগাবিট পার সেকেন্ডে থাকে এবং পিক স্পিড প্রায় ৫০ মেগাবিট পার সেকেন্ড হয়।

এখন কিছু বাস্তব উদাহরণ দেখা যাক। উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ফোরজি সার্ভিসে বেশ কিছু পার্থক্য দেখা যায়। ফোরজি নেটওয়ার্ক কতটা উন্নত তা পরীক্ষা করার জন্য মূলত দুটি ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করা হয় – নেটওয়ার্ক কভারেজ কত বেশি (4G Availability) এবং ইন্টারনেটের ডাউনলোড স্পিড কত। এই দুই ক্ষেত্র বিবেচনায় বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ভাল ফোরজি নেটওয়ার্ক রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরে। লন্ডনভিত্তিক কোম্পানি ওপেন সিগনালের রিপোর্ট অনুযায়ী 4G Availability এর সূচকে দক্ষিণ কোরিয়া পৃথিবীতে প্রথম এবং ফোরজি স্পিডের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার 4G Availability প্রায় ৯৬.৩৮% এবং দ্বিতীয় স্থানে থাকা জাপানের 4G Availability ৯৩.৪৮% পাওয়া গেছে। এখানে 4G Availability বলতে দেশের সকল স্থান থেকে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় কিনা তা বোঝানো হয়নি বরং প্রতিটি ব্যবহারকারী কোন নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কে কতক্ষণ ধরে ফোরজি কানেকশন নিয়ে থাকতে পারবেন তা বোঝানো হয়েছে।

ফোরজি স্পিডের তালিকায় গড়ে ৪৫.৬২ মেগাবিট পার সেকেন্ড স্পিড নিয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর। দ্বিতীয় স্থানে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার গড় স্পিড ৪৩.৪৬ মেগাবিট পার সেকেন্ড। হাঙ্গেরি (৪২.৬১ এমবিপিএস), নরওয়ে (৪১.৩৬ এমবিপিএস) এবং নেদারল্যান্ডস (৩৮.৩৬ এমবিপিএস) যথাক্রমে তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে।
আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কায় ফোরজি নেটওয়ার্ক চালু হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কার ফোরজি সার্ভিস ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে, তবে ভারতের ফোরজি স্পিড বড় ধাক্কা খেয়েছে। ভারতের মত বিপুল জনসংখ্যার দেশে প্রচুর ফোরজি ব্যবহারকারী থাকলেও সেখানকার নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা যথেস্ট উন্নত না হওয়ায় গড় স্পিড কমে মাত্র ৫.১৪ এমবিপিএসে দাঁড়িয়েছে। ওপেন সিগনালের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত এবং কোস্টারিকার ফোরজি স্পিড পৃথিবীর সর্বনিম্ন (৫.১৪ এমবিপিএস)। শ্রীলঙ্কার গড় স্পিড ১০.৪২ এমবিপিএস এবং পাকিস্তানের গড় স্পিড ১১.৭১ এমবিপিএস। 4G Availability এর দিক থেকে শ্রীলঙ্কার অবস্থান পৃথিবীর মাঝে সর্বনিম্ন (৪০.১২%)। তবে এই সূচকে ভারত যথেষ্ট শক্তিশালী (৮১.৫৬%)। পাকিস্তানের 4G Availability শ্রীলঙ্কা থেকে ভাল (৫৩.৪৯%)।

বাংলাদেশের 3G Availability প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় ভাল অবস্থানে রয়েছে বলে ওপেন সিগনালের এক রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়েছে। ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ 3G Availability সূচকে এগিয়ে রয়েছে। গত বছরের আগস্টে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী শ্রীলংকার 3G Availability ৭৮.৪২% এবং বাংলাদেশের 3G Availability ৬৮.৭১%। ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তানের 3G Availability যথাক্রমে ৫৬.১০%, ৫৯.৫০% এবং ৬৩.৪৭%। এই সূচকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া (৯৮.৫৪%) এবং তালিকায় সবার শেষে রয়েছে গুয়ানা (৩৬.৫০%)।

থ্রিজিতে বাংলাদেশের গড় স্পিড ৩.৭৫ এমবিপিএস যা পাকিস্তান (৩.৩৩ এমবিপিএস) এবং নেপাল (৩.৭৫ এমবিপিএস) থেকে বেশি। ভারতে থ্রিজি স্পিড ৫.৩০ এমবিপিএস। এই সূচকেও সবার উপরে দক্ষিণ কোরিয়া (৪১.৩৪ এমবিপিএস) এবং তালিকায় সবার নিচে আফগানিস্তান (২.১৭ এমবিপিএস)।

ড. সাজ্জাদ হোসেন প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন: ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ। সহযোগিতায়: মোঃ শাকিফ ফেরদৌস ও খায়রুন নাহার।


বাংলাদেশ সময়: ১৭২৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।