ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ভারত

একটি গ্রামের বিবর্তনের রূপ কলকাতার শিয়ালদহ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০২১
একটি গ্রামের বিবর্তনের রূপ কলকাতার শিয়ালদহ

কলকাতা: সরকারি নাম শিয়ালদহ। তবে লোকমুখে পরিচিত শিয়ালদা নামে।

এশিয়া মহাদেশের ব্যস্ত রেলস্টেশনগুলোর মধ্যে অন্যতম, উত্তর কলকাতার শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন। কিন্তু কিভাবে শিয়ালদহ নামের উৎপত্তি হলো সে বিষয়ে কোনো নথি নেই।    
 
শহরের ইতিহাসবিদ পি থাঙ্কপ্পন নায়ারের মতে, কলকাতা যখন ছিল প্রায় জনমানবহীন তখন এসব অঞ্চল ছিল বিশাল জলাভূমি, যারমধ্যে ছিল কিছু দ্বীপের মত জমি। শিয়ালদহর সম্ভবত পূর্ববর্তী নাম ছিল শিয়ালডিহি। পুরনো অভিধান অনুযায়ী ‘শিয়াল’ শিয়রে বা পূর্বদিক এবং ডিহি কথাটার অর্থ গ্রাম।

সুতানটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা এ তিন অঞ্চল মিলে কলকাতার পত্তনের পর সেই শিয়ালডিহি কালক্রমে হয়েছে শিয়ালদা। যার সরকারি নাম শিয়ালদহ।
উনিশ শতকে স্যার হ্যারি কটন’এর লেখা ‘ক্যালকাটা ওল্ড অ্যান্ড নিউ’ বইটিতে বলা হয়েছে, ১৬৯০ সালের দিকে সুতানুটি দখল করেন ব্রিটিশরা। সুতানুটির প্রকৃতি, পরিবেশ অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক এতটাই মোহিত করে যে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাকাপাকি বসতি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।

এর পাশাপাশি কটন সাহেব লিখছেন, এক বহুল প্রচারিত কাহিনী, যেখানে বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে কীভাবে কলকাতার পরিকল্পনা আসে চার্নকের মস্তিষ্কে। একটি বিশাল আয়তনে অশ্বত্থ গাছের তলায় বসে নিয়ম করে হুকোয় টান দিতেন চার্নক সাহেব। যেখানে এ গাছ ছিল সেইস্থান বর্তমানে শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরের মধ্যে পড়ে। হুকো সেবন এবং সেই বিখ্যাত গাছ বর্ণনা ১৭৯৪ সালে স্যার ‘এ আপজন’ সাহেব তথা কলকাতা মানচিত্র রূপকার এবং তার বিবরণেও পাওয়া যায়। তবে শহরের ক্রমবর্ধমান আয়তনের সঙ্গে তাল রাখতে ওই গাছপালা কাটা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলেই।

স্যার হ্যারি কটন আরও লিখেছেন, ১৭৫৭ সালে শিয়ালদহকে বলা হতো একটি ‘উঁচু জমি, যা পূবদিক থেকে আসছে’।  কটন যখন ভারতে ছিলেন তখন শিয়ালদহ ছিল ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়’এর শেষ স্টেশন। এ রেলওয়ের প্রথমদিকে কাজ ছিল সহজে পৌঁছানো যায় দার্জিলিং এবং অধুনা পূর্ব বাংলায় পাট ও তামাক উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোয়।  

এছাড়া এ রেলপথ কাজে লাগাতো বেশ কিছু সরকারি সংস্থায়। অর্থাৎ সরকারি এবং ব্যবসায়িক বিষয় ছাড়া সাধারণের জন্য এ রেলপথ ছিল ব্রাত্য। ১৮৬৯ সালে শিয়ালদহ রেল চালু হয় সর্বসাধারণের জন্যে। বর্তমানে শিয়ালদহে স্টেশন তিনটি টার্মিনাল রয়েছে। শিয়ালদহ উত্তর, শিয়ালদহ মেইন এবং শিয়ালদহ সাউথ। একসময় এ রেলপথ ছিল পূর্ব বাংলার রেল বিভাগের আওতায়।
দেশভাগের আগে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা করে রাণাঘাট হয়ে গেদে পেরিয়ে দর্শনার পথ ধরে বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে শিলিগুড়ি যাওয়া যেতো। ৪৭ এ  দেশভাগের পরও পূর্ব বাংলার রেলওয়ের অর্থাৎ শিয়ালদহ বিভাগের পূর্বরেল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত ছিল।

ফলে শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশনের ইতিহাসের সঙ্গে এক বর্ণময় জীবনগাঁথা রয়েছে বাংলাদেশেরও। সেদিন ছিল, আজও আছে, আগামীতেও থাকবে। এখনও রেলপথে বনগা হয়ে কলকাতায় আসতে সেই শিয়ালদহ ধরেই আসতে হয়। অবশ্য মেট্রো হওয়াতে দমদম হয়ে রেলপথে পরিবর্তন করেন অনেকে।

এ শহরের প্রবীণদের তথ্যানুযায়ী, এ রেলপথ ধরেই কলকাতার সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগসহ শিল্প-সাহিত্যের আদান-প্রদান করতেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানবাসী। তারা থাকতেন শিয়ালদহ স্টেশনের আশপাশে। এর আশপাশেই ছিল আজকের বাংলাদেশের জেলার নামে তৈরি একাধিক হোটেল এবং রেস্তোরাঁ।  

এ স্টেশন লাগোয়া একসময় সস্তা এবং জনপ্রিয় হোটেল ছিল ‘গাইবান্ধা হোটেল’। আরও ছিল, ঢাকা, বিক্রমপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, যশোর ইত্যাদি জেলার নামেও। জেলার আদপ কায়দায় এসব হোটেলে এক কিংবা দুইরাত কাটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন ব্যবসায়ীরা। কলকাতা থেকে কেনাকাটা করে ফিরে যেতেন যে যার জেলায়।

প্রবীণদের মতে, দেশভাগের অনেক পর অব্দীও অস্তিত্ব ছিল গাইবান্ধা হেটেলের। এখন আর কোনো হোটেলের অস্তিত্ব নেই। তবে শহরের সস্তা হোটেলের সম্ভার এখনও শিয়ালদহজুড়েই। শহরজুড়ে আজও ছড়িয়ে আছে ঢাকাই মিষ্টান্ন ভান্ডারের মতো প্রতিষ্ঠান।

তবে সেদিনের শিয়ালদহ একটা স্টেশন মধ্যে আবদ্ধ থাকলেও, আজ কিন্তু গোটা এলাকার নাম শিয়ালদহ বলে পরিচিত। এ পথে যাদের যাতায়াত তারা সর্বদাই ব্যস্ত। কেউ ছুটছেন স্টেশন দিকে ট্রেন ধরবেন বলে, কেউ ট্রেন থেকে নেমে ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে ছুটছেন শহরের দিকে।

সেসময় আরও একটা কারনে এ শহরে পা রাখতেন অবিভক্ত বাংলাভাষী। এখানেই আছে প্রায় ১৫০ বছর পুরানো নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল (এনআরএস)। ১৮৭৩ সালে গরিবদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রিটিশরা। ইতিহাস বলছে, হাসপাতাল তৈরির পেছনেও ছিল সামাজিক চাপ। প্রথম নাম ছিল পুওর হসপিটাল। এরপর হয়ে যায় ক্যাম্পবেল হসপিটাল অ্যান্ড মেডিক্যাল স্কুল। সেসময় এখানে পক্সের রোগীরাই আসতেন।

পরে গবেষক-চিকিৎসক তথা রাজনৈতিকবিদ নীলরতন সরকার সহযোগিতায় পাল্টে যেতে থাকে হাসপাতাল পরিকাঠামো। পুওর অর্থাৎ গরিবদের চিকিৎসার ভরসার কেন্দ্র হয়ে ওঠে এ হাসপাতাল। এখনও অনেক বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্য আসেন এ হাসপাতালে।

৭০ দশকে নির্মিত শিয়ালদা ফ্লাইওভার থেকে নজর ঘোরালে দেখা যায় আধুনিকীকরণের ঢেউ বাঁচিয়ে আজও এ এলাকায় ইতিউতি দাঁড়িয়ে রয়েছে পুরোনো কলকাতার স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ কিছু বাড়ি। অতীত, আধুনিক যা কিছুই গড়ে উঠছে সব শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশনকে কেন্দ্র করে। তবে শিয়ালদহ মানেই আজ শুধু রেল নয়। জড়িয়ে আছে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্য, চিকিৎসাসহ বাঙালির আবেগ। কারণ এ অঞ্চলে থেকে খুব বেশি দূরে নয় শহরের বইপাড়া থেকে স্মৃতিবিজড়িত কফি হাউস।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০২১
ভিএস/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।