ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

বহিরাগতরাই শেবাচিম হাসপাতালের ‘কর্মচারী’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৯
বহিরাগতরাই শেবাচিম হাসপাতালের ‘কর্মচারী’ শেবাচিম হাসপাতাল

ব‌রিশাল: দক্ষিণাঞ্চলের সর্বোচ্চ ও সর্ববৃহৎ চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে বর্তমানে প্রতিদিনই বেড সংখ্যার দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হচ্ছে। ফলে তাদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। কারণ হাজার শয্যার এ হাসপাতালটিতে রয়েছে বিপুল সংখ্যক জনবল সংকট।

আর এ সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে অবৈধভাবে কিছু বহিরাগত নারী-পুরুষ কর্মচারীর বেশে রোগীদের জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি ন্যূনতম ফির মাধ্যমে যেখানে হাসপাতালটিতে প্রতিদিন হাজারো রোগী চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন, সেখানে অবৈধ এসব বেশধারী কর্মচারী রোগীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অর্থ।

যদিও হাসপাতাল প্রশাসন এদের রুখতে প্রায়ই নানান পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে অধরাই থেকে যাচ্ছে বেশিরভাগ বেশধারী কর্মচারী।

সূত্রে জানা গেছে, শেবাচিম হাসপাতালের লেবার-গাইনি, মেডিসিন, সার্জানি, শিশু ওয়ার্ডগুলো সবচেয়ে ব্যস্ত এবং বেশি রোগী গড়ে ভর্তি হয়। তবে এসব ওয়ার্ডে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, রোগীর থাকার জায়গা নির্ধারণ করা, নানান প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে রোগী স্থানান্তরিত করার জন্য পর্যাপ্ত ক্লিনার, আয়া, ওয়ার্ডবয় কিছুই নেই।

আর যেসব ওয়ার্ডেও বা রয়েছে, তা দিয়ে রোস্টার ডিউটি বণ্টন করলে তিন শিফটে কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়ে সংশ্লিষ্টদের। এই সুযোগে সহায়তার নামে বিভিন্ন মাধ্যমে বহিরাগত ‘অবৈতনিক’ লোক (নারী-পুরুষ) সেবার নামে কাজ করছেন হাসপাতালটিতে।

যাদের কোনো ধরনের বেতন-ভাতা হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয় না। এরপরও দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। সুযোগ বুঝে রোগী ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে সেবার নামে তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা।

ওয়ার্ড ইনচার্জদের দায়িত্ব বণ্টনের হিসেব অনুযায়ী, শেবাচিম হাসপাতালে ইনডোর-আউটডোর মিলিয়ে প্রায় ৫০ টির মতো ওয়ার্ড রয়েছে। যেখানে আয়া-বুয়া কিংবা ওয়ার্ডবয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, যখন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ৫০০ বেডের ছিল তখন এমএলএসএস পদে ৪২৬ জনকে নিয়োগের কথা ছিল। হাসপাতালটি ১০০০ বেডে উন্নিত হলে সেই সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ ৮৫২ জনে দাঁড়ায়। কিন্তু বাস্তবতায় এই বিশাল জনবল নিয়োগের অনুকূলে মাত্র ৩০৯ জন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী রয়েছে সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত। বাকি ৫৪৩টি পদই শূন্য।

এদিকে দুইবছর আগে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ঠিকাদার কর্তৃক জনবল (ক্লিনার/সিকিউরিটি গার্ড) নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপর ঠিকাদার তার কার্যক্রম হাসপাতাল থেকে গুটিয়ে নেয়। তবে ওই ঠিকাদারসহ নানা সময় বিভিন্ন মাধ্যমে হাসপাতালের কাজে লিপ্ত হওয়া প্রায় ১২০ জন  চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী (চতুর্থ শ্রেণী) থেকে যান স্ব-স্ব স্থানে।

এছাড়া বিগত সময়ে হাসপাতালে অনুপ্রবেশ করা আরো বেশকিছু বহিরাগতও সেবার নামে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন গোটা হাসপাতালে। সবমিলিয়ে অবৈধ এ জনবলের সংখ্যা প্রায় ১৫০ জন। তবে তারা সুকৌশলী হয়ে রোস্টার অনুযায়ী, তিন শিফটে হাসপাতালে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের কাজ করায় সহসা চোখে পরছে না কারো।

সর্বশেষ ঠিকাদারের প্রতিনিধি তাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, দুইবছর আগে হাসপাতাল প্রশাসনের নির্দেশ মোতাবেক ঠিকাদার জনবল সরবরাহের কাজ গুটিয়ে নেন। ওইসময় ঠিকাদারের অধীনে থাকা ১২০ জন স্টাফের পাওনা বুঝিয়ে তাদের বিদায় করা হয়। এরপরে কেউ যদি হাসপাতালের কোনো ওয়ার্ডে কাজ এখনও করেন, তবে সে বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন ওয়ার্ড সংশ্লিষ্ট সরকারি স্টাফরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালের কেবিন, পথ্য বিভাগ, মেডিসিন, সার্জারি, শিশু, নবজাতক, সিসিইউ, গাইরি ওয়ার্ডে রাশিদা, হাসি, রেহেনা, ফয়সাল, খালেদা, আসমা, নিপা, কোহিনূর, মরিয়ম, এ্যানি, সালমা, হাসিনা (১), হাসিনা (২), মার্থা, হাসান, রাসেল, মমতাজসহ প্রায় ৩৫ জনের মতো কাজ অবৈধ জনবল কাজ করছে,।

একইভাবে হাসপাতালের বাকি ওয়ার্ডগুলোতে বহিরাগত কেউ না কেউ কাজ করছেন অবৈধভাবে; যারা নিজেদের এক্সট্রা লোক হিসেবে পরিচয় দেন।

সর্বোশেষ গত ২১ আগস্ট লেবার ওয়ার্ডের যে আয়াকে টাকা না দেওয়ায় প্রসূতি মাকে অপারেশন থিয়েটারে নিতে বিলম্ব হয়েছে এবং যে কারণে নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে বলে স্বজনেরা দাবি করছেন, সেই হালিমা বেগমও হাসপাতালের অবৈধ স্টাফ। যাকে হাসপাতাল প্রশাসনেই ‍পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে।

বিভিন্ন ওয়ার্ডের ইনচার্জরা জানান, বহিরাগত এই জনবলের কারণে তাদের মধ্যেও আতঙ্কে বিরাজ করে। কারণ সরকারি কোনো মালামাল খোয়া গেলে তার দায় ভার তারা নেবে না। কিন্তু যেভাবে ওয়ার্ড দাপিয়ে বেড়ায় তারা তাতে বোঝার উপায়-ই নেই যে তারা হাসপাতালের কিংবা সরকারি কর্মচারী নন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্টাফ জানান, বহিরাগতদের হটানোর জন্য অভিযোগ দিলেও লাভ হয় না। জনবল সংকটের কারণে কর্মচারীরা ছুটিতে গেলে বা কাজ ঠিকভাবে না করলে এরা ছাড়া উপায়ও থাকে না।  

যদিও শিগগিরই হাসপাতালটি এদশা থেকে মুক্তি পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমরা বহিরাগতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছি। এজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি নিজেও মাঝে মাঝে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যাই কে সরকারি কর্মচারী আর কে বহিরাগত। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে ধরে পুলিশের হাতে সোর্পদও করেছি।

ডা. বাকির হোসেন বলেন, ১৫১ জন জনবল নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি পেয়েছি। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি মিললেই হয়। নতুন করে লোক নিলে আশা করি বহিরাগতদের দৌরাত্ম রোধ করা যাবে।  

বাংলা‌দেশ সময়: ০৯২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৯
এমএস/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।