ঢাকা: নব্বই শতাংশ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য চিকিৎসা বঞ্চিত। চিকিৎসার সুব্যবস্থাও তেমন নেই।
জুলাই বিপ্লব পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্যের সংকট ও পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) জাতীয় পর্যায়ের এক সেমিনারে এ প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মেন্টাল হেলথ ক্রাইসিস: ডিলিং উইথ পোস্ট জুলাই রেভ্যুলেশনারি অ্যাসপেক্টস শীর্ষক এ সেমিনারের আয়োজন করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম. মুজাহেরুল হক বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতরা ছাড়াও আহত এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যরাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তারা নানারকম হতাশায় ভুগছেন। তারা একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারছেন না। তাদের আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরিয়ে আনতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তারা যে মানসিক অবসাদে ভুগছেন, তা কাটিয়ে উঠতে তাদের যথাযথ চিকিৎসা নিতে উৎসাহী করতে হবে এবং তারা সঠিক চিকিৎসা যাতে পান, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চরকির সিইও রেদওয়ান রনি জানান, আন্দোলনের তথ্য চিত্র নির্মাণ করতে গিয়েও তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন আন্দোলনের ভয়াবহতায়। ফলে বর্তমান বাস্তবতায় আন্দোলনকারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব নিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতায় পরিকল্পনা থাকা উচিত।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চাইল্ড হেল্পলাইনের পরিচালক মো. মোহাইমিন চৌধুরী বলেন, আন্দোলনের সময় থেকে চাইল্ড হেল্পলাইনে কলের সংখ্যা বেড়ে যায়। যারা সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন এবং এ সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, তাদের অনেকেই এখনও খাওয়া দাওয়া করতে পারছেন না, ঘুমাতে পারছেন না। কারণ তারা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে এবং এ হতাশা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট হেল্পলাইন সহযোগিতা করবে।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। মনোবিজ্ঞানের এ অধ্যাপক সেমিনার আয়োজনের প্রেক্ষাপট, মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন রিসোর্স ও তার সীমাবদ্ধতা এবং ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কার ও সরকারের পদত্যাগের গণঅভ্যুত্থানে প্রায় এক হাজার ৪২৩ জনেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন, আহতদের সংখ্যা ২২ হাজারেরও বেশি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই ছাত্র-ছাত্রী, শিশু-কিশোর।
তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পায় মানসিক স্বাস্থ্যের অন্যতম ও জটিল একটি রোগ-পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, যেটাকে সংক্ষেপে ‘পিটিএসডি’ বলা হয়। তীব্র শোক বা মানসিক আঘাত থেকে এ সমস্যা দেখা দেয়। এ কারণে অনেক সময়ই তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, সামাজিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, কর্মক্ষেত্রে কাজের পারফরম্যান্স খারাপ হয়ে যায়, এমনকি চাকরি বা ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার মতো কাজও করে ফেলে নিজেকে প্রতিরক্ষার জন্য। এর মাঝে অনেকেই কারণ থাকুক বা না থাকুক বিষণ্নতা বা অবসাদে ভুগতে পারেন, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তা শুরু করতে পারেন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, এমন পরিস্থিতিতে মনোচিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী ও অন্যান্য প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী রয়েছেন তিন হাজারের নিচে। এ পেশাজীবীদের আশি শতাংশেরও বেশি শুধু ঢাকাতেই কাজ করছেন। অন্যদিকে মানসিক সমস্যা আছে এমন মানুষদের নব্বই শতাংশ চিকিৎসার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের কাছে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন না। একদিকে নানা কুসংস্কার বিশ্বাস, অন্যদিকে সবার পক্ষে ঢাকায় এসে বা বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয় না। এছাড়া দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য খাতে পুরো বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ আছে মাত্র .৫ শতাংশ।
স্বাগত বক্তব্য দেন আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আহতদের শতকরা ৭৫ ভাগ বিষণ্নতায় ভুগছেন। অনেকে শারীরিকভাবে আহত হননি, কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার এবং পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার হওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমরা। জুলাই বিপ্লবের পরে যে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং হবে সেটি মোকাবিলা করা, ১৮ কোটি মানুষের জন্য সার্বিক মানসিক স্বাস্থ্যের কর্ম কৌশল নির্ধারণে কাজ করতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, আমরা দেখেছি আন্দোলনের পর থেকে অনেক মা-বাবাও ট্রমাটাইজড। অনেক পরিবারের মেয়েরা আন্দোলনে ট্রমাটাইজড হয়ে লোক ভয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছেন না। তাদের ভয় যে যদি মানুষ জেনে যায়, তাহলে তাদের বিয়ে হতে সমস্যা হতে পারে।
উপদেষ্টা আরও বলেন, কেবিনেট মিটিংয়ে আহতদের ও শহীদদের পরিবারে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, গণঅভ্যুত্থানে আহতরা যে পক্ষের হোক তারা চিকিৎসা পাবেন। তবে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে আহতদের অর্ধেককে এখনো সহায়তার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে সব গুছিয়ে নিতে। তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও সার্বিক প্রয়োজনে সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে। যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক হবে।
অনুষ্ঠানে অনেকের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ নওশাদ জমির। এছাড়া প্যানেলিস্ট হিসেবে সেমিনারে আলোচনা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোরশেদ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. কামরুল হাসান ও চাইল্ড কেয়ার হেল্পলাইনের ব্যবস্থাপক মো. মোহাইমিন চৌধুরী।
সংকট উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণে সেমিনারে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। যার মধ্যে অন্যতম হলো- অভিজ্ঞ মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি টাস্ক ফোর্স তৈরি করা; গণঅভ্যুত্থানে যেসকল ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তাদের তালিকা তৈরি করে মানসিক সেবা দেওয়া। আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যকে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।
প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী এবং মনোবিজ্ঞানী/মনোচিকিৎসক এ দুইয়ের সমন্বয় করে সব জেলা-উপজেলার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে একটি মানসিক স্বাস্থ্য কর্নার তৈরি করা। প্রয়োজনে এলাকা ভিত্তিক শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ট্রেনিংয়ের আওতায় এনে দক্ষ জনবল তৈরি করা। স্কুল, কলেজ, আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়স সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য ট্রমা রিকভারির কর্মশালা, মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সচেতনতামূলক কার্যক্রমের আয়োজন করা। সরকারি উদ্যোগে একটি ‘হটলাইন সেবা’ চালু করা, যার মাধ্যমে সব অঞ্চলের ছাত্র-জনতা মনোবেদনা শেয়ার করতে পারেন। একটি গবেষণা সেল গঠন করা, যার মাধ্যমে সেবা দেওয়ার পরবর্তী পুরো সময়ের গবেষণা লব্ধ তথ্য জাতীয়ভাবে সংরক্ষণ করা যায়। মেন্টাল হেলথ অ্যাক্ট-২০১৮ এর ৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী সব জেলাতে মানসিক স্বাস্থ্য রিভিউ ও মনিটরিং কমিটি গঠন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্ম পরিকল্পনা ২০২০-৩০ এ বর্ণিত বিভিন্ন কার্যকলাপের দৃশ্যমান ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া।
সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন সাকিব প্রত্যয়। সেমিনারটিতে আঁচল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল গণমুক্তি মঞ্চ।
বাংলাদেশ সময়: ০০১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০২৪
এমআইএইচ/এসআই