ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ঢামেকে রাতে হুইলচেয়ার নিয়ে থাকেন দালালরা, লক্ষ্য রোগীকে জিম্মি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০২৪
ঢামেকে রাতে হুইলচেয়ার নিয়ে থাকেন দালালরা, লক্ষ্য রোগীকে জিম্মি শনিবার (২৬ অক্টোবর) ঢামেকের জরুরি বিভাগের সামনের চিত্র। ইনসেটে দালাল চম্পা

ঢাকা: প্রতিদিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য রোগী কম খরচে চিকিৎসা নিতে ছুটে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক)। কিন্তু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়েই দালালদের খপ্পরে পড়ে বিড়ম্বনার শিকার হন তারা।

মাত্র ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে চিকিৎসার আশায় আসা রোগী বা স্বজনদের ভুলভাল বুঝিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন দালালরা। এভাবেই দালালদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছেন রোগীরা।

এমনই এক ভুক্তভোগী ফরিদপুরের গোপালপুর থেকে অন্তঃসত্ত্বা ফারজানা ও তার স্বামী মেহেদী হাসান।

শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) রাত ১০টার দিকে অন্তঃসত্ত্বা ফারজানাকে নিয়ে ঢামেকের জরুরি বিভাগে পৌঁছালেই অন্তঃসত্ত্বাকে হুইলচেয়ারে বসান চম্পা নামের এক নারী দালাল।  

নিয়ম অনুযায়ী, রোগী ফারজানাকে হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি করা হলেও চিকিৎসকের দেওয়া পরীক্ষার নির্দেশনা অনুসরণ করতে গেলে ওই দালাল জানায়, ‘রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো পরীক্ষা হয় না, শুধু হাসপাতাল থেকে ১০ টাকা দিয়েই টিকিট পাবেন। ’ রোগীর অবস্থা খারাপ দেখে স্বজনরা যে কোনো উপায়ে চিকিৎসা করাতে চান, এই সুযোগে দালাল চম্পা রোগী ফারজানাকে হাসপাতালে নতুন ভবনের বিপরীতে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখানে অতিরিক্ত ৪ হাজার টাকা খরচ করে আল্ট্রাসনোগ্রাম ও রক্ত পরীক্ষাসহ রোগীর জরুরি কিছু পরীক্ষা করানো হয়।  

হাসপাতালের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, এই নারী দালালের সেই বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে একটি গোপন চুক্তি রয়েছে। একজন রোগীকে নিয়ে গেলে দালাল দুই হাজার টাকা পান।  

চম্পার মতো এমন অনেক দালাল ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে জরুরি বিভাগের সামনে মুক্ত-স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ান নিয়মিত। আর সুযোগ পেলেই জটিল পরিস্থিতিতে পড়া রোগীকে বোকা বানিয়ে নিয়ে যান বেসরকারি ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিকে।

হাসপাতালে দালালদের এই দৌরাত্ম্যের পেছনে অবশ্যই কোনো অভ্যন্তরীণ সহায়তা রয়েছে বলে দাবি অনেকের।

এ বিষয়ে হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আনসার সদস্য, পুলিশ ক্যাম্প থাকা সত্ত্বেও, দালালরা দিনের পর দিন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রবেশদ্বারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে। তাদের দাপটের বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিত্র পাল্টায়নি। সেই দালালরা ঢাকা মেডিকেলে হাসপাতালে বীরদর্পে তাদের দালালি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।  

সূত্র জানায়, চম্পাসহ বেশ কয়েকজন নারী দালাল হুইল চেয়ার নিয়ে রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের অবস্থান করে থাকে।

ঢামেকে দালাল চম্পা

এভাবে দালালদের দৌরাত্ম্য  ঢাকার বৃহত্তম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনদের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।  

সচেতনরা বলছেন, এই দালালচক্র ভাঙার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। নাহলে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী ঠকবে এবং দুর্ভোগে পড়বে।

চম্পা নামের সেই নারী দালালের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, রাতে হাসপাতালে কোনো পরীক্ষা হয় না, তাই অন্য হাসপাতালে নিয়ে এসেছি পরীক্ষার জন্য। এই বলেই লাইনটি কেটে দেন তিনি।

এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের বহির্বিভাগে আল্ট্রাসনোগ্রাম রুমের ইনচার্জ সিনিয়র স্টাফ নার্স ফারজানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই আমাদের আলট্রাসনোগ্রাম রুম খোলা থাকে। গতকাল শুক্রবার রাতেও খোলা ছিল। এর পাশাপাশি দিনের বেলায় জরুরি বিভাগের একটি নির্দিষ্ট সময় রোগীদের জন্য আলট্রাসনোগ্রাম করা হয়। এছাড়া নতুন ভবনের নিচতলায় আল্ট্রাসনোগ্রাম হয়ে থাকে।

এদিকে নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্যাথলজি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ২৪ ঘণ্টাই রোগীদের বিভিন্ন রকম পরীক্ষা এখানে করে থাকে, কোনো বন্ধ নাই এখানে।

ভুক্তভোগী রোগী ফারজানার স্বামী মেহেদী হাসান জানান, তার স্ত্রী ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ফরিদপুরের একটি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন পেটের বাচ্চার অবস্থা খুবই খারাপ। দ্রুত ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যেতে। অ্যাম্বুলেন্সযোগে শুক্রবার আনুমানিক রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন স্ত্রীকে।  

তিনি বলেন, ঢামেকে আসার পরপরই  চম্পা নামে নারী দালাল হুইলচেয়ারে আমার স্ত্রীকে বসিয়ে দশ টাকা দিয়ে একটি টিকিট কেনায়। আমি জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে আমাকে গাইনি ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়। পরে চম্পা হুইলচেয়ারে করে রোগীকে গাইনি ওয়ার্ডে নেওয়ার পর সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক দ্রুত আলট্রাসনোগ্রাম ও রক্ত পরীক্ষা করতে বলে। এরপরেই চম্পা বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে শুধু ১০ টাকা দিয়ে টিকিটই পাবেন কিন্তু রাতে কোনো পরীক্ষা হয় না। ’ এই কথা শোনার পর আমি আরো চিন্তায় পড়ে যাই। আমার স্ত্রীর অবস্থা খারাপ, তাছাড়া আমার প্রথম বাচ্চা। আমি তার কাছে জানতে চাই কি করা, তখনই আমাকে সেই নারী দালাল চম্পা হাসপাতালের নতুন ভবনের বাইরে বেসরকারি একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে আল্ট্রাসনোগ্রাম ও রক্ত পরীক্ষা করানো হয় আমার বিল দিতে হয় ৪ হাজার টাকা। তারপরে আবার চম্পার হুইলচেয়ার করে ঢাকা মেডিকেল গাইনি ওয়ার্ড ফিরে এলে আমার রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে কৌশলে জোর করে এক হাজার টাকা নিয়ে চম্পা নামে সেই নারী দালাল।  

মেহেদী হাসান বলেন, এখন বুঝতে পেরেছি আমি এক দালালের খপ্পরে পড়েছিলাম। জরুরি বিভাগে কর্মরত লোকজন, আনসার সদস্যদের সামনে চম্পা যেভাবে কথা বলছিলেন, দেখে মনে হচ্ছিল তিনি হাসপাতালের সরকারি কর্মকর্তা। অথচ এখন জানা গেল তিনি একজন দালাল, বহিরাগত।

তিনি বলেন, তবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে, গাইনি ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা খুব যত্ন করে রোগীর চিকিৎসা করেছেন। ভোরে আমার স্ত্রী সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়েছে। সন্তান ও মা এখন পর্যন্ত সুস্থ আছে।

শনিবার (২৬ অক্টোবর) সকালে এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আশরাফুল আলম সঙ্গে সরাসরি দেখা করে বিষয়টি জানালে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। রাতে হুইলচেয়ার নিয়ে কারা অবস্থান করেন জানতে হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জকে জিজ্ঞেস করেন। নারী দালাল চম্পাকে দ্রুত খুঁজে বের করে আটক করতে জরুরি বিভাগের লোকজনকে ডেকে কড়া নির্দেশনা দেন।  

তিনি বলেন, রাতে বেসরকারিভাবে হুইলচেয়ার নিয়ে কেউ যদি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অবস্থান করে তাহলে ওই রাতে জরুরি বিভাগের দায়িত্বে যারা থাকবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০২৪
এজেডএস/এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।