ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

অসমাপ্ত ভ্রমণ

সাদিকুল নিয়োগী পন্নী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০২০
অসমাপ্ত ভ্রমণ প্রতীকী ছবি।

এক.
কয়েক যুগ আগে রাঙামাটিতে এসেছিলো বাপ্পার পরিবার। বর্তমানে তাদের বাসা শহরের বনরূপা এলাকায়।

বাপ্পার জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাঙামাটিতে। শহরের স্কুল-কলেজে পড়ালেখার সময় তার অনেক বন্ধু-বান্ধবী জুটেছে। এদের মধ্যে বাঙালি-পাহাড়ি সবাই আছে।  

এলিস চাকমা, জেসী চাকমা ও সুজলা তঞ্চঙ্গ্যাঁর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব বেশ ঘনিষ্ঠ। ছুটির দিনে বাপ্পা তাদের সঙ্গে কখনও পাহাড় থেকে পাহাড়ে, আবার কখনও সুবলং ঝর্ণায় ছুটে বেড়ায়। হাতে কিছু টাকা এলেই বনরূপা মার্কেটে পাহাড়ি হোটেলে পেট ভরে খাবার খায়।  

বাপ্পা একাদশ শ্রেণি পাশ করার পর ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়। এলিস, জেসী ও সুজলা রাঙামাটি থেকে যায়। তারা শহরের স্থানীয় একটা ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়। বাপ্পা ঢাকা চলে গেলেও বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়মিত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয়।

দুই.
একদিন বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনের ক্লাসের বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলো বাপ্পা। তাদের মধ্যে অনিক বললো, অনেকদিন ধরে ঢাকার বাইরে যাওয়া হয় না। চলো-সবাই মিলে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসি।

আফরিন বললো, বাপ্পাদের বাড়ি গেলে কেমন হয়? আমি কখনও রাঙামাটি যাইনি।  

আমার কোন আপত্তি নাই। তোরা যেতে চাইলে প্ল্যান কর। আমি নিজেও অনেকদিন ধরে বাড়ি যাই না। এই সুযোগে বাড়ি থেকেও ঘুরে আসা হবে-বললো বাপ্পা।

রাকিব বললো, আমরা এ বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে রওনা দিতে চাই। তারপর শনিবার রাতে ফিরে আসবো। বাপ্পা, দশ পনেরজন থাকার মতো একটা জায়গার ব্যবস্থা করতে পারবি?

বাপ্পা বললো, আগে যাওয়ার বিষয়টা ঠিক কর। থাকা খাওয়ার ব্যাপার আমি দেখবো। আরেকটা কথা বলি, তোরা যারা প্রেমিকাসহ যাবি তাদের কিন্তু বাড়তি চার্জ দিতে হবে।  

আফরিন বললো, এই ব্যাটা তোকে প্রেম করতে মানা করছে কে? দুই বছর পার করে দিলে একটা প্রেম করতে পারলি না। আবার অন্যদের ব্যাপারে নাক গলাতে আসিস।  

রাকিব বললো, ক্যাম্পাসে তোর ছোট বোনের অভাব নাই। চারদিকে কেবল ভাইয়া-ভাইয়া জয়ধ্বনি। তুই তো ক্যাম্পাসের ছোট বোনদের আদরের ভাইয়া। এমন গণভাইয়া হলে প্রেমিকার প্রয়োজন হয় না।

আফরিন বললো, পারলে তুইও আদরের বোনদের সঙ্গে নিয়ে নে। তাতে কোনো আপত্তি নেই। তবে আমাদের যদি কোন প্রকার বিরক্ত করিস তাহলে তোর বাড়িতেই তোকে পিটিয়ে আসবো।  

বাপ্পা বুঝতে পারলো আফরিন-রাখিব জুটির সঙ্গে লাগতে গেলে ইজ্জতহানি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই সে কথা না বাড়িয়ে বললো, ঠিক আছে ভাই। আমি হার মানলাম। তোরা রাতেই সবার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে নে। মোট কতজন হলো সেটা আমাকে জানালে আমি পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।  
আড্ডা শেষ করে সবাই নিজ নিজ বাসায় ফিরে গেল। রাকিব রাতে বাপ্পাকে ফোন করে জানালো, মোট দশজন যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দলে আফরিন ছাড়াও রিমা নামে আরেকজন যুক্ত হয়েছে।

তিন.
বৃহস্পতিবার রাতে বাপ্পাসহ দশজনের একটি দল বাসে চড়ে ঢাকা থেকে রাঙামাটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। ভোরে এসে তারা পৌঁছালো রাঙামাটি শহরে। তাদের জন্য বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলো এলিস চাকমা। বাপ্পা বাস থেকে নামতেই এলিস দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ঢাকায় গিয়ে আমাদের ভুলে গেলি। এতোদিন পর আসতে মন চাইলো?

বাপ্পা বললো, সুযোগ পাইনি। জেসী-সুজলা কেমন আছে?

সবাই ভালো আছে। এই আমি তো বকবক করেই যাচ্ছি। তোর বন্ধুরা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চল আগে রেস্ট হাউজে।

বাপ্পা তার বন্ধুদের সঙ্গে এলিসকে পরিচয় করিয়ে দিলো। এরপর দু’টো ইজিবাইক ভাড়া করে তারা জেলা পরিষদের রেস্ট হাউজে পৌঁছে গেল।

এলিস সবাইকে রুম দেখিয়ে দিলো। তারপর সে বাপ্পাকে নিয়ে একটা রুমে ঢুকলো।  

বাপ্পা রুমে ঢুকে দেখে-দুটি বড় টিফিন বক্স।

কিরে এলিস এগুলোতে কি?

হাঁসের মাংস আর চালের রুটি।  

তুই এটা কি করলি! এতো টাকা নষ্ট করতে গেলি কেন?

তোদের পাই কই বল তো? আর এতো সকালে বাইরে তেমন কিছু পাবি না।  

তোর পাগলামি আর গেল নারে এলিস-বললো বাপ্পা।

এলিস বললো, আর কথা বাড়াতে হবে না। লং জার্নি করে এসেছিস। ফ্রেশ হয়ে নে।

বাপ্পা ফ্রেশ হয়ে সবাইকে ডেকে তার রুমে নিয়ে আসলো। বেশ মজা করে সবাই সকালের নাস্তা করলো।

বাপ্পা বললো, তোরা রুমে গিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হবি। তোদের নিয়ে আমাদের বাসায় যাবো। তারপর ঘুরাফেরা।  

আফরিন বললো, জ্বি জনাব। এখন তো আপনার এলাকা। আপনার অবাধ্য হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

রিমা বললো, আফরিন তো ব্যাগ টানার লোক নিয়ে এসেছে। আমার কি হবে বাপ্পা। তুই যদি...।

দিব একটা। এই বলে তেড়ে গেল বাপ্পা।

এক হাস্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হলো বন্ধুদের দুষ্টুমিতে।  

মিনিট দশেক পর সবাই রেডি হয়ে বের হলো। রেস্ট হাউজ থেকে বের হবার পর দেখা হলো জেসী চাকমা ও সুজলার তঞ্চঙ্গ্যাঁর সঙ্গে।  

তাদের দেখে বাপ্পা অবাক হয়ে বললো, কিরে তোরা খবর পেলি কেমন করে?

জেসী বললো, এলিস আমাদের আগেই জানিয়েছিলো। আজ সকালে তোরা আসার পর ফোনও দিয়েছে।

তুই তো দেখি সব কিছুতে ফার্স্ট। এই বলে এলিসের দিকে তাকিয়ে হাসলো বাপ্পা।  

বাপ্পা তার বন্ধুদের সঙ্গে জেসী ও সুজলাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, তাড়াতাড়ি চল-বাসা থেকে দেখা করে আসি। বাবা সকাল থেকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে।

তারপর সবাই হাঁটতে হাঁটতে বাপ্পাদের বাসায় গেল।  

সবাইকে দেখে বাপ্পার মা-বাবা বেশ খুশি হলো। বাপ্পা তাদের একমাত্র সন্তান। তিনি নাশতা আনতে চাইলে বাপ্পা বললো, এলিস আর সে সুযোগ রাখেনি।

বাপ্পার মা তখন বললেন, এই ছেলেটার সাথে আর পেরে ওঠা গেল না। নিজে কিছু খেতে চাইবে না। কিন্তু অন্যকে জোর করে হলেও খাওয়াবে।
এলিস লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখলো।

বাপ্পার মা বললেন, এখন তাহলে চা খাও। আর রাতে সবাই আমাদের বাসায় খাবে। এলিস, জেসী ও সুজলা তোমরাও কোনভাবে মিস করবে না।
মুচকি হাসি দিয়ে সবাই জানিয়ে দিলো, তা-ই হবে আন্টি।

বাপ্পাদের বাসা থেকে চা খেয়ে সবাই বের হলো। এলিস সবাইকে প্রথমে উপজাতীয় জাদুঘরে নিয়ে গেল। জাদুঘরের বিভিন্ন নিদর্শন দেখে সবাই বেশ মুগ্ধ হলো। সেখান থেকে ইজিবাইকে করে সবাই চলে গেল ঝুলন্ত ব্রীজে।  

দুপুরের দিকে বাপ্পা বললো, আমাদের বাসায় চল। দুপুরের খাবার খেয়ে সুবলং ঝর্ণা দেখতে যাবো।

অনিক বললো, বন্ধু রাতের নিমন্ত্রণ দুপুরে গেলে ঠকতে হবে। দেখা গেল আইটেম কম।  

এ কথা শুনে সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।

এলিস বললো, দুপুরে আমরা পাহাড়ি হোটেলে খাবো।  

রাকিব বললো, এটাই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি।  

দুপুরে বনরূপা মার্কেটে একটা পাহাড়ি হোটেলে খেয়ে সবাই কাপ্তাহ হ্রদ দেখতে চলে গেল। সেখান থেকে একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে তারা রওনা দিলো সুবলং ঝরনা দেখতে।  

সারাদিন বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে সন্ধ্যায় সবাই ক্লান্ত হয়ে রেস্ট হাউজে ফিরলো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাতে সবাই গেল বাপ্পাদের বাসায়।  

কাপ্তাই হৃদের মাছসহ নানান আইটেমের খাবার খেয়ে সবাই সন্তুষ্টি প্রকাশ করলো। তারা বাপ্পার মা-বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলো রেস্ট হাউজের দিকে। বাপ্পাকে তার মা-বাবা বাসায় রেখে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু বন্ধুদের আবদারের জন্য তাকেও আসতে হলো।

চার.
রেস্ট হাউজে যখন তারা পৌঁছালো তখন রাত প্রায় ৯টা।  

অনিক বললো, রুমে পরে যাই। রেস্ট হাউজের সামনের জায়গাটায় কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়া যাক।

সবাই তাতে রাজি হলো।

সুজলা বললো, অনেক রাত হয়ে গেছে। আমি জেসীকে নিয়ে চললাম। এলিস থাকুক আপনাদের সঙ্গে।

সুজলা ও জেমী যখন বিদায় নিয়ে যেতে চাইলো তখন আফরিন বললো, আমি একটু দোকানে যাবো। ভুলে টুথব্রাশ ফেলে এসেছি। রিমা তুইও চল আমার সঙ্গে।

ঠিক আছে চলো-বললো সুজলা।

রেস্ট হাউজ থেকে একটা ছোট রাস্তা পার হয়ে মূল সড়কে যেতে হবে। এ পথটুকু অনেকটা নির্জন। সুজলা, জেসী, আফরিন ও রিমা রেস্ট হাউজের সীমানা পার হয়ে ওই রাস্তায় যেতেই বিদ্যুৎ চলে গেলো।  

এমন সময় হঠাৎ চিৎকারের শব্দ ভেসে আসলো। বাপ্পা উদ্বেগের সাথে বললো, মনে হয় কোনো ঝামেলা হয়ছে। চলো সবাই।  

তখন সবাই নিজ নিজ মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দৌড় দিলো।  

গলির রাস্তাটাতে যাওয়ার পর তারা দেখতে পেল জেসী, সুজলা, আফরিন ও রিমার সঙ্গে চারজন ছেলের হাতাহাতি হচ্ছে। বাপ্পাদের গ্রুপের সবাই চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেললো। এমন সময় বিদ্যুৎ চলে এলো। জেসী, সুজলা, আফরিন, রীমা রাগ ও ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।  

আফরিন বললো, অন্ধকারে বখাটেগুলো আমাদের পথরোধ করে। আমাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে চেয়েছিল।  

বাপ্পাসহ সবাই বখাটেদের গণধোলাই দিলো। তারপর তাদের শার্ট খুলে পিছমোড়া দিয়ে বাঁধলো। বাপ্পা থানায় ফোন দিয়ে বিষয়টি জানালো।  

রিমা তেড়ে এসে এক বখাটের গালে থাপ্পড় দিয়ে বললো, মেয়ে মানুষ দেখলেই হুঁশ থাকে না। ভেবেছিস কোনো প্রতিবাদ করবো না। ইচ্ছে হচ্ছে গলা টিপে মেরে ফেলি।

আফরিন, রীমা, সুজলা ও জেসি ওয়াক থু বলে বখাটেদের মুখে থুথু ছিটিয়ে দিলো।

রাকিব বললো, তোদের ভাগ্য ভালো যে আমরা বেড়াতে এসেছি। না হয় পিটিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতাম। তোদের মতো হাতেগোণা কয়েকটা অসভ্যদের জন্য আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।  

এমন সময় পুলিশের একটা পিকআপ ভ্যান এসে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো। পুলিশ একে একে সব বখাটেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল।

বাপ্পা বললো, চলো সবাই মিলে জেসী ও সুজলাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।  

হ্যাঁ, বললো সবাই।  

তারপর সবাই মিলে জেসী ও সুজলাকে বাসায় পৌঁছে দিল। রাস্তায় বিদায় নিলো এলিসও।

এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর বাপ্পার বন্ধুরা আর রাঙামাটি থাকতে চায়নি। ফলে ভ্রমণ অসমাপ্ত রেখেই পরদিন সকালে তারা বাসে চড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০২০
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ