ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

একটি অলৌকিক মেসেজ । উপল বড়ুয়া

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২০
একটি অলৌকিক মেসেজ । উপল বড়ুয়া

উপল বড়ুয়ার জন্ম ১৯৮৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর, কক্সবাজারের রামুতে। মূলত কবি। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি কথাসাহিত্যেও মনোনিবেশ করেছেন।

তার প্রকাশিত কবিতার বইগুলো হলো- কানা রাজার সুড়ঙ্গ, তুমুল সাইকেডেলিক দুপুরে।  

এ বছর বাংলা একাদেমি বইমেলায় ‘উড়কি’ প্রকাশন থেকে আসছে উপল বড়ুয়ার গল্পের বই- ডিনারের জন্য কয়েকটি কাটা আঙুল।

 

বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য প্রকাশিতব্য এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি থেকে একটি গল্প প্রকাশ করা হলো।  


একটি অলৌকিক মেসেজ

‘মৃত মানুষ কি ফেসবুকে মেসেজ দিতে পারে? আপনিই বলেন ভাইজান। আপনার যুক্তি কি বলে?’ এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলে জামিলুর আকন সাহেব আমার দিকে তাকালেন। তার উৎসুক দৃষ্টি উত্তর খোঁজার জন্য ব্যাকুল। আমি জবাবে কী বলব তাই ভেবে দিশেহারা। উপায় না পেয়ে উত্তর দিলাম, ‘ভাববার বিষয়। এই রকম কখনো শুনিনি আগে। ’ আকন সাহেব যেন আমার উত্তরের প্রতীক্ষায় ছিলেন। ঠোঁট থেকে কথাটা পড়তেই বললেন, ‘ঠিক এমনটাই আমার সঙ্গে ঘটেছে। ’

এবার আমার নড়েচড়ে ওঠার পালা। বলে কী লোকটা! এই রাত-বিরাতে আমাকে ভড়কে দেওয়ার জন্য কোনো গল্প ফাঁদেনি তো! আমার অবশ্য গল্পের সত্য-মিথ্যা বিচারের চেয়ে শুনতেই ভালো লাগে। এমনিতে এই ডিসেম্বরের শীতে গল্প করেও সময়টা কাটানো যায়। অন্তত জ্যামটা না ছাড়া পর্যন্ত। আমিও উৎসুক শ্রোতার মতো চোখ বড়-বড় করে তাকালাম আকন সাহেবের দিকে। আমি ভালো শ্রোতা। ছোটবেলায় দাদীর মুখে চেরাগের আলোয় গল্প শোনার সময় সেকেন্ডে সেকেন্ডে মাথা দুলিয়ে হুঁ-হুঁ করে যেতাম। অভ্যেসটা এখনো আছে। এই আবছায়া অন্ধকারেও আমার আগ্রহী চকচকে চোখ দেখে আকন সাহেব উৎসাহ পেলেন মনে হয়, বুকপকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালালেন। আমাকেও সাধলেন একটা। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে ফিরে গেলেন স্মৃতির দিকে, ‘বললে বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, তবুও বলা। আপনি অজানা লোক। ’ 

‘বিশ্বাস করবো না কেন! অবশ্যই করবো। আপনি বলেন। সমস্যা নাই। ’ 

‘সমস্যা আমারও নাই ভাইজান। হলো কি, আমার একটা স্বভাব আছে। টুকটাক লেখালেখি করি। তাও ফেসবুকে। পত্রিকার কারো সঙ্গে পরিচয় নাই। থাকলে অন্তত কয়েকটা কবিতা ছাপানোর ব্যবস্থা করতাম। আপনার কি কোনো চেনা-জানা আছে পত্রিকায়?’ 

‘না ভাই, আমি তো ঐ লাইনের লোক না। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি। পরিচয় বলতে এইটুকুই। ’ 

‘আচ্ছা যাক। বিষয়টা হচ্ছে কি, আমার খুব শখ ছিল ছোটবেলা থেকে, পত্রিকার পাতায় নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখবো। বহু চেষ্টা করেছি, হয় নাই। ’ 

‘ধৈর্য্য রাখেন, হবে। ’ 

‘আর ধৈর্য্য। সে যাক। ভাইজান বিরক্ত হচ্ছেন না তো?’ 

‘না, না, ভাই। আপনি বলেন। ’ 

এই যে আমি কারো কোনো কিছু নিয়ে আপত্তি করি না, তার জন্য ব্যক্তিগত জীবনে আমাকে ভুগতে হয় খুব। এই যে, এখন লোকটা, কোত্থেকে কি বলছে। শুরু করছে ফেসবুকের মেসেজ নিয়ে আর এখন বলছে কী সব হাবিজাবি লেখালেখি। ভাত আছে এসবের! কিছুক্ষণ পর না আবার কবিতা শুনিয়ে বসে। আমার জীবনে এই রকম যে হয়নি তা নয়। কবি-লেখকদের আমার ভালো চেনা আছে। এই তো বছর তিনেক আগের শুক্রবারের এক ঘটনা, একলা ভালো লাগছিল না বিধায় গেছি বইমেলায়। জানতামও না যে বাংলা একাডেমির দিকে লিটল ম্যাগাজিন নামের আলাদা একটা মেলা বসে। সে যাক, সময় কাটানোর জন্য বাংলা একাডেমির পুকুর পাড়ে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর দেখি এক লোক আমার পাশে এসে বসল। হাত মিলিয়ে পরিচিত হলো ভালো কথা, কিন্তু কয়েক মিনিট না যেতেই কথাবার্তাহীন কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে কবিতা বলতে লাগলো। কি সব আবুল লোক, হাবলা মার্কা কবিতা লিখেছে। এক পর্যায়ে আমি উঠে যেতে বাধ্য হলাম। এও না সে রকম কিছু করে, আল্লাহ মালুম। আমিও এবার হাবভাবে বুঝিয়ে দিলাম গল্প শুনতে আমি এখন আর অত আগ্রহী নই। আমার আগ্রহের খেতা পুড়ে আকন সাহেব দ্বিতীয় সিগারেট ঠোঁটে আবার শুরু করলেন।

‘বুঝলেন ভাইজান, জগৎ বড় বিচিত্র। কখন যে কী হয়। এই সেদিন আমার পাশের গ্রামের এক লোক, সম্পর্কে আমার চাচা লাগে। দুই বেলা খেতে পাইতো না। আর এখন দেখেন গিয়ে, বাড়ি করছে দুই তলা। তিন মেয়ে ছিল। দুইটারে বিয়ে দিছে ঢাকায়। বড় মেয়েটা খুব সুন্দর আবার। পরীর মতো। আপনি কখনো মাদারীপুরে গেলে দেখাবো। ’ 

‘আচ্ছা। দেখাইয়েন। ’ 

এতক্ষণে বুঝলাম আকন সাহেবের মাথার স্ক্রু কয়েকটা ঢিলা। হয়তো বয়সের দোষ। হয়তো বয়সে বড় না হলে কবে উঠে চলে যেতাম। মানুষ যেহেতু হয়েছি কিছুটা রেস্পেক্ট তো অন্যজনকেও দেখাতে হবে নাকি। আমার ভদ্রতার সুনাম আছে পরিচিত মহলে। সামনাসামনি কেউ না বললেও আমি তা জানি। কানে আসে। এবার নিজ থেকে বললাম আকন সাহেবকে, ‘ফেসবুক নিয়ে কি যেন বলতেছিলেন?’

‘জ্বি, জ্বি। বলতেছি। গাড়ি যে আর কতক্ষণ আটকে থাকে কে জানে। ফেরিতে উঠলেই কেল্লা ফতে। তারপর একটানে ঢাকা পৌঁছে যাব। আপনি কি জন্য আসছিলেন এই দিকে?’ 

‘খুলনায় আমাকে বছরে দুয়েকবার আসতে হয় অফিসের কাজে। ’ 

‘আচ্ছা। আমি আসছিলাম বোনের বিয়েতে। আপন না আবার। তবে আপনের চেয়ে বেশি। ’  

‘আচ্ছা, আচ্ছা। ’

‘এখন চাকরি করি একটা হোটেলে। খাবার হোটেল না। আবাসিক হোটেল। আইসেন একদিন। আমার কার্ডটা রাখেন। ’ 

আকন সাহেব মানিব্যাগ থেকে কার্ড বের করতে দেরি করলেন না। আমি অন্ধকারে চোখ না বুলিয়ে কার্ডটা হাতে ধরে রইলাম। উটকো ঝামেলা থেকে মুক্তির আশার চেয়ে কথা চালিয়ে যাওয়াটাই ভালো ভেবে আমিও জুড়ে দিলাম খাজুরা আলাপ। ‘আসবো, আসবো। নিশ্চয় আসবো। ’

‘ভাইজান, আপনার কি ফেসবুক আইডি আছে? থাকলে আমার নাম লিখে সার্চ দিয়েন। বাংলায় লিখবেন “জামিলুর আকন”। আকাশের দিকে মুখ করা আমার ছবি দেখবেন। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাইয়েন। ’ 

‘জ্বি, আচ্ছা। ’ 

‘ফেসবুক একটা বিরাট আবিষ্কার। বুঝছেন ভাই। দুনিয়ার সেরা আবিষ্কারের একটা। কত দেশের মানুষের সঙ্গে যে পরিচয় ঘটে! তারা আবার হারিয়েও যায়। আমার অনেক স্কুল ফ্রেন্ডকেও খুঁজে পাইছি ফেসবুকে। বিশ বছর আগেও বন্ধুরা কে কোথায় ছিল তা জানতাম না। আর এখন তো সবার খোঁজ-খবর জানি। ’

‘আচ্ছা। ’ 

‘শুনেন, আপনারেই বলি গোপন কথাটা। ’ 

‘জ্বি, বলেন। ’  

গোপন কথার বাক্স খুলতে গিয়ে আকন সাহেব কিছুটা থামলেন। এই প্রথম শুনতে পেলাম আমরা যেখানে বসে তার সামান্য দূরে এক রাতপাখি ডেকে যাচ্ছে। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। হয়তো আকন সাহেবের অনর্গল কথার ভারে সেই ডাক চাপা পড়েছিল। ‘ভাইসাহেব, সিগারেট জ্বালাবেন নাকি একটা? আকন সাহেবের নরম কণ্ঠস্বরে আমার ধ্যান ভেঙে গেল পুনরায়। আমি কিছুটা বিরক্ত মেশানো স্বরে ‘না’ করে দিলাম। আমার ভাবের তোয়াজ না করেই তিনি ঢুকে পড়লেন কথায়, ‘বুলু নামে আমার এক স্কুলবন্ধু ছিল। খুব কাছের বন্ধু আর কি। দুইজনে এক সঙ্গে কতো কী করেছি! বলতে গেলে স্কুল লাইফ জুড়ে বুলুই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু। কিন্তু সেই প্রাণপ্রিয় বন্ধুর সঙ্গে আমার আর যোগাযোগটুকু থাকলো না একসময়। ’

‘কেন!’ 

‘কলেজে উঠার সময় আমার বাপটা মারা যায়। এরপর ঢাকায় চলে আসছি চাকরি নিয়ে। আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না তো ভাই?’

‘না, না, বলেন। ’

‘ঢাকায় এসে প্রথমদিকে বুলুকে দুয়েকটা চিঠি লিখেছিলাম। তখন তো অতো মোবাইল-ফেসবুক ছিল না। বুঝছেনই তো। এই করতে করতে জীবন কাটতে লাগলো। শহুরে বন্ধু জুটলো। আমিও ধীরে ধীরে ছোটবেলার বন্ধুটিকে ভুলে গেলাম। পরে শুনেছি বুলু দুবাই চলে গিয়েছিল। ’  

‘আচ্ছা। ’  

‘শুনেন। সেই বন্ধুরে আমি খুঁজে পেলাম বিশ বছর পর। কোথায় জানেন? ফেসবুকে। তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে কি যে আনন্দ পেয়েছিলাম ভাই। ’  

আকন সাহেব থামলেন একটু। তারপর আবার খুলে ধরলেন কথার ডালা, ‘আমার আরেকটি গোপন কথা আছে। বলব?’

‘বলবেন না কেন? বলেন। ’

‘ফেসবুক বন্ধুদের যখন কেউ মারা যায় তখন আপনি কী করেন?’

‘কিছুই না। ’  

‘আমি আবার একটা কাজ করি। যে মারা যায় তাকে ফেসবুকে একটা মেসেজ করি। ছোট একটা কথা লিখে রাখি, ‘ওপারে ভাল থাকবেন। ’ কয়দিন আগে যে কবি অনন্ত মারুফ সুইসাইড করলেন, উনাকেও দিয়েছি। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড ছিলেন তো। এই রকম অসংখ্য মানুষকে মেসেজ করেছি। জানি, কোনো দিন তারা ইনবক্স চেক করবে না। উত্তরও দিবে না। ’ 

‘সেটাই তো স্বাভাবিক। ’

‘স্বাভাবিক নয় ভাই। বুলু কিন্তু উত্তর দিয়েছে। ’ 

আমি একটু উৎসুক হয়ে উঠলাম। গলাটা কিঞ্চিৎ চিকন করে, তার দিকে ঝুঁকে জানতে চাইলাম, ‘কোন বুলু? আপনার হারিয়ে যাওয়া বন্ধু?’

‘হুঁ। একদিন শুনি বুলু দুবাইতে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। খবরটা পেয়েছিলাম আমার আরেক বন্ধুর থেকে। দেশে যখন তার ডেডবডি এলো, তখন শত কাজ ফেলে দেখতে গেলাম গ্রামে। বন্ধুর নিথর দেহটা দেখে ফিরে এলাম ঢাকায়। পরে তাকে ফেসবুক ইনবক্সে লিখেছি, “ভাল থাকিস বন্ধু ওপারে। দেখা হবে। ”

‘ও! তারপর?’  

‘তারপর এভাবেই সময় কাটতে লাগলো। পরশু ঘুম থেকে উঠে দেখি একটা মেসেজ। আগ্রহ নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখি বুলু। লিখেছে, ‘ভাল আছি বন্ধু। তোর সঙ্গে আগামী রোববারে দেখা হবে। ’

‘অবিশ্বাস্য! আপনি গল্প বানাচ্ছেন। ’

‘তার আগে বলুন আজ কী বার? ’

‘শুক্রবার। স্যরি। বারোটা পার হয়ে গেছে। কিন্তু এটা অসম্ভব। ’

‘না ভাই, বিশ্বাস-অবিশ্বাস আপনার ব্যাপার। এই যে মেসেজটা দেখুন। ’

আকন সাহেব অবিশ্বাস দূর করার জন্য আমার দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দিলেন। মেসেজ ঠিকই আছে। তবে মোবাইলের আলোতে আমি তার মুখের ডানপাশটাও একবার দেখে নিলাম। সেই সামান্য দেখাতেই বুঝলাম, কেতাদূরস্ত মানুষটি শান্তিতে নেই।  

‘এমনও হতে পারে যে, মেসেজটি অন্য কেউ লিখেছে। হয়তো আপনার বন্ধুর আইডি নাম্বার ও পাসওয়ার্ড অন্য কেউ জানে। বিজ্ঞানের এই যুগে কত কী সম্ভব। ’

‘তা জানি না। অতোকিছু ভাবি না। দুনিয়া বিচিত্র। কিন্তু পরশু থেকে কেবল বুলুর সঙ্গে কাটানো দিনগুলোই মনে পড়ছে। ’

‘চলুন আকন সাহেব। যাওয়া যাক। দেখে আসি জ্যামের কী অবস্থা। ’

এই বলে আমরা আমাদের গাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। পথে কেউ কারও দিকে তাকাইনি। কথা হয়নি একটিও। এমনকি তা বজায় ছিল পুরো যাত্রাপথে। সকালে ঢাকায় ফিরে আমি এতো ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে, আকন সাহেবের খবর ভুলেই গিয়েছিলাম। কেন জানি আজ মনে পড়লো। ফোন করবো ভেবে মানিব্যাগে তার কার্ডটা খুঁজেছি অনেকবার। পাইনি। হয়তো সেদিন ভুলে তা রাখা হয়নি পকেটে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২০
এইচজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ