ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

রম্য গল্প

ফাটাফাটি ভালোবাসা | ইমরুল ইউসুফ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭
ফাটাফাটি ভালোবাসা | ইমরুল ইউসুফ রম্য গল্প

রোমানার চেহারাখানা খাসা। নাকটা একটু বসা। তাতে কী। রাসেল নাকি রোমানার নাক দেখেই তার প্রেমে পড়েছে। এ কথা যখন রাসেলের বন্ধুবান্ধবরা জানতে পারে, তখন তারা হেসে লাউয়ের মতো গড়াগড়ি খায়। আর হাসতে হাসতে দাঁতের ময়লা, মুখের দুর্গন্ধে অজ্ঞান করে ফেলার মতো অবস্থা করে। বলে সাবাই খোঁজে ‘বাঁশির’ মতো নাক। আর তুই খুঁজে খুঁজে ‘খাসির’ মতো নাকওয়ালা একটি মেয়ের প্রেমে পড়লি?

এই কথা শুনে রাসেল বললো, তাতে তোদের কী? রোমানা আমার জীবন। আমার বুকের ধুকধুক।

আমার রক্তের প্লাটিলেট। তখন তার বন্ধুরা বললো, থাম থাম আর বলিস না। ফালতু কথায় তোর মুখ ফুলে যাবে। আর এমন উদ্ভট কথা শুনতে শুনতে আমাদের গর্দান শূলে যাবে। এখনও সময় আছে পারলে ওকে ভুলে যা। প্রেম জলে ভাসিয়ে তুই কূলে যা!

অসম্ভব আমি পৃথিবীর সবকিছু ভুলতে পারব। সম্পর্কের সবচেয়ে জটিল তালাটাও খুলতে পারব। কিন্তু রোমানাকে ভুলতে পারব না। আমি তাকে যে নাকচাবি উপহার দিয়েছি তা খুলতে পারব না। আমি গেলাম। আমার ডেটিং আছে। সেইসঙ্গে ইটিং আছে। দেরি করলে কপালে সান্টিং আছে।

হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে ফনফন করে ঘুরে বেরিয়ে গেল রাসেল। মাথায় হরেক চিন্তা। এখন কোনটা রেখে যে কোনটা করবে ভেবে পায় না। তবে প্রথম কাজ শাহবাগ মোড়ে যাওয়া। বেছে বেছে লাল টকটকে দুটি গোলাপ ফুল কেনা। তারপর সোজা নিউমার্কেটের ওভার ব্রিজ। সেখানে রোমানা আসবে। বিকাল ঠিক ৫টায়। সময়ের একচুল এদিক ওদিক হলে খবর আছে। একটু সময় নড়লেই রোমানাও নড়ে যায়। এমন ভাব করে যে, এখনই রাসেলকে ছেড়ে যায়। মাঝে মধ্যে রোমানা তো বলেই ফেলে, আগামী দিন দেরি করলে খবর আছে। নিউমার্কেটের পাশেই আজিমপুর- কবর আছে!

এতকিছু বলার পরও রাসেল রোমানাকে ছাড়ে না। পাগলের মতো ভালোবাসে। রোমানার পিছনে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে। কোনো আবদার করলেই হয়েছে। কে কী বলছে, কে কী দেখছে, কে কী শুনছে, মাথাব্যথা নেই। ব্যস, আবদার পূরণ করার জন্য পাগলা ঘোড়ার মতো ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটছে।

কিন্তু রাসেল এখন কোনো গাড়িতেই উঠতে পারছে না। রিকশায় যে উঠবে তারও কোনো উপায় নেই। শাহবাগের রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ। কপাল আমার ষোলো আনা মন্দ। নীলক্ষেত ঘুরে গেলে অনেকটা সময় লেগে যাবে। সেই অজুহাতে রোমানা হয়ত ভেগে যাবে। তাছাড়া টাকাও লাগবে বেশি। এখন কী হবে! ৫টা বাজতে আর মাত্র ১৫ মিনিট বাকি। এই সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে না পারলেই ঝাড়ি। ডেটিং করা বাদ দিয়ে যাবে চলে বাড়ি। আমার সাথে দিবে সারাজীবনের আড়ি! সেইসঙ্গে আরও বলে দিয়েছে আজ এক মিনিট দেরি করলে ওভারব্রিজ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়তে হবে। এটাই নাকি শাস্তি। তখন চুলোয় যাবে মাস্তি! পৃথিবীর কোনো প্রেমিকা তার প্রেমিককে এমন কঠিন শাস্তি দিতে পারে? ভাবে রাসেল।

ভাবতে ভাবতে আরও মিনিট তিনেক চলে যায়। আর মাত্র ১২ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে পৌঁছাতেই হবে। তা না হলে... ভাবতেই বুকের মধ্যে হাডু-ডু খেলা শুরু হয়ে যায় রাসেলের। বুকে তিনবার থুতু দিয়ে গোলাপ দুটি শার্টের পকেটে গুঁজে দেয়। ওই বাসটি ধরতে হবে। নয় আজ ওভারব্রিজ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে মরতে হবে। ঝুলে ঝুলে হলেও তাই সেখানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌঁছানোর কাজটি করতে হবে।

মানুষে ঠাসা বাসটির রড ধরে ঝুলতে থাকে রাসেল। শুধু চারহাত-পা বাসে ছোঁয়ানো। মন ও মনোযোগসহ বাকি সব বাইরে। তার এখন মনে হচ্ছে সে হয়ে গেছে টারজান। হয়ে গেছে স্পাইডারম্যান। নায়ক হয়ে গেছে থ্রিলার কোনো সিনেমার। বাদুড় ঝোলার সময় সে একটি রিকশার হুডের সঙ্গে ধাক্কা খেলো। কিন্তু পড়ল না। নতুন কেনা শার্টটির পিছন দিক কেবল ফস্ করে ছিঁড়ে গেল এই যা। রাগে দুঃখে গা জ্বলতে লাগল রাসেলের। মনে হচ্ছে শার্ট না, তার ইজ্জত ছিঁড়ে গেছে! কী আর করা! ডেটিং তো আর মিস করা যাবে না। তাহলে তো প্রেম শেষ। বন্ধুরা বলবে বেশ বেশ! তারচেয়ে উত্তম- শার্টটির ছেঁড়া অংশ কোনো রকমে মেরামত করে নেওয়া। নতুন শার্ট কেনার তো আর সময়ও নেই, পয়সাও নেই।
দেখতে দেখতে বাস সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে পৌঁছে গেল। বাস থেকে নেমে খুঁজতে লাগল জুতসই কোনো টেইলারের দোকান। খুঁজতে খুঁজতে সে একটি দোকান খুঁজে পেল। বলল, ভাইজান আমার শার্টের ছেঁড়া এই অংশটি একটু সেলাই করে দেওয়া যাবে? উত্তরে বলল, হ্যাঁ দেওয়া যাবে- তবে ১৫ দিন পর। আর এখনই এডভান্স ৫০ টাকা দিয়ে যেতে হবে। টেইলার মাস্টারের এই কথা শুনে রাসেলের গায়ে যেন আগুন ধরে যায়। আরে বেটা নতুন শার্ট বানাতেও তো ১৫ দিন লাগে না! আর শার্ট খুলে রেখে গেলে আমি তো অর্ধ দিগম্বর হয়ে যাব। এই অবস্থায় কি প্রেমিকার সামনে যাওয়া যাবে? মন বলছে, তোর শার্টটা খুলে তোকে দিগম্বর করে পালিয়ে যাই। বেটা রামছাগল কোথাকার!

৫টা বাজতে আর মাত্র এক মিনিট বাকি। এখন উপায়? হঠাৎ তার মনে হলো একটি স্কচ টেপই পারে তার ইজ্জত কিছুটা হলেও রক্ষা করতে। এই ভেবে সে একটি স্টেশনারির দোকানে গেল। বলল, ভাই একটু স্কচ টেপ দেওয়া যাবে? ভীষণ জরুরি। দোকানদার মিষ্টি হেসে একপ্রস্থ টেপ দিয়ে দেয়। রাসেল দোকানের একটু আড়ালে গিয়ে দ্রুত শার্টটি খুলে উল্টো করে ছেঁড়া জায়গায় টেপ লাগায়। যেন আপাতত বোঝা না যায় যে, শার্টটি ছিঁড়ে গেছে।

শার্টটি মেরামত করে দৌড়াতে দৌড়াতে রাসেল যখন নিউমার্কেটের ওভারব্রিজের ওপর পৌঁছাল তখন ঘড়ির কাঁটায় ৫টা বেজে ১৫ মিনিট। দেখলো মুখটা বেলুনের মতো ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোমানা। আজ সে পার করেছে ধৈর্যের সীমানা। ধীর পায়ে রোমানার দিকে এগিয়ে গেল রাসেল। বলল, একটু দেরি হয়ে গেল সোনা। তুমি প্লিজ রাগ কোরো না। আজকের মতো ক্ষমা করো আমার রক্তের প্লাটিলেট। আমার টিয়া পাখি। আমার তোতা পাখি। এই নাও তোমার প্রিয় লাল গোলাপ।
দরকার নেই আমার লাল গোলাপ। এই বলে ফুল দুটি ব্রিজের ওপর থেকে নিচে ফেলে দেয় রোমানা। বলে, তুমি প্রতিদিন একই কথা বলো। আজ আর ক্ষমা নেই। ওঠো ওই রেলিঙের ওপর। তারপর নিচে লাফিয়ে পড়ো। এই কথা শুনে রাসেল একবার রোমানার মুখের দিকে তাকায়। আরেক বার তাকায় ব্রিজের নিচের রাস্তার দিকে। রোমানা বলল, কোনো লাভ নেই। আমাকে পেতে হলে তোমাকে আজ প্রেমের পরীক্ষার জাম্পিং কোর্সে পাস করতেই হবে। ভাঙামনে রাসেল মুখটা প্যাঁচার মতো করে ওভারব্রিজের রেলিঙের ওপরে ওঠে। লাফ দিতে যাবে এমন সময় রোমানা বলে, খুব হয়েছে আমার ডেইলি লেট মুহাম্মদ। এই বলে রোমানা শার্ট ধরে নিচের দিকে টান দিতেই শার্টটির উল্টো দিকে লাগানো টেপ খুলে যায়। শার্টের এমন অবস্থা দেখে রোমানা হেসে ফেলে। বলে, আর প্রেমের পরীক্ষা দিতে হবে না জানেমান। তুমি প্রেমের পরীক্ষায় পাস করেছ। তুমিই আমার চিরচেনা লাল-নীল ভালোবাসা। এখন চলো যাই বলাকা সিনেমা হলে। দর্শক আসছে সদলবলে। তোমায় নিয়ে ‘ফাটাফাটি ভালোবাসা’ সিনেমাটা দেখে আসি।

যোগাযোগ বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ