ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

অতল | অপূর্ব সাহা

আবু তালহা, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৬
অতল | অপূর্ব সাহা

আবার সেই দিরাই। ১৫ বছর পর।


দিরাই অফিসটি আগের মতোই আছে। একতলা বিল্ডিং, উপরে টিনের চাল। কিছু রোনোভেশন হয়েছে। পুরনো পলেস্তারা খসিয়ে নতুন করে প্লাস্টার দেওয়া হয়েছে। রঙ করা হয়েছে।
অফিসের সামনের আঙ্গিনায় সেই ছাতিয়ান গাছটা আগের মতোই আছে। একটু মোটা আর দীঘল হয়েছে। আগে যেটুকু ছায়া দিত এখন তার চেয়ে অনেক বেশি জায়গা নিয়ে ছায়া দেয়। নতুন করে কিছু আমগাছ লাগানো হয়েছে। নাতিদীর্ঘ আমাগাছগুলোতে রাজ্যের বোল এসেছে।
আমি গাড়ির দরজা খুলে নিচে নামতেই হৈ হৈ করে দিরাই শাখার শাখা ব্যবস্থাপকরা এগিয়ে এলো, ভাই, কেমন আছেন? রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয় নাই তো?
আমি ঘাড় নেড়ে ওদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, আপনারা ভালো আছেন তো?
সবাই প্রায় একসঙ্গে উত্তর দিলো, জি ভাই।
আমাকে ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থাপকের ঘরে বসানো হলো। ব্যবস্থাপক সাহেব বললো, ভাই একটু চা খান। তারপর একটু রেস্ট নেন। গেস্টরূমটা রেডি করা আছে। আমাদের কাগজপত্র সব মোটামুটি রেডি আছে। চেক করতে আপনার খুব বেশি সময় লাগবে না।
আমি রাজি হলাম না। চা খাওয়া যেতে পারে। তবে রেস্ট নেওয়ার সময় নেই। বিকেলের মধ্যে রওনা না দিলে সিলেট পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে। রাতের ভ্রমণ আমার একদম পছন্দ নয়। তাই বললাম, চা খেতে খেতে কাজ করি। কোনো সমস্যা নেই। সিলেট অফিসের গেস্টরুমটা আমার খুব পছন্দ। নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছি। সিলেট থেকে দিরাই, এটুকুই তো রাস্তা।
চা এলো। সঙ্গে চানাচুর, বিস্কুট, আঙ্গুর, আপেল, কমলালেবু ও কলা। এক গ্লাস ট্যাং-ও আছে। আমার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো। বিস্ময় নিয়ে বললাম, এসব কী রে ভাই! আমি পথে নাস্তা করে এসেছি। শুধু চা খাবো।
ব্যবস্থাপক সাহেব বললো, আপনি আমাদের মেহমান ভাই। এটুকু না খেলে চলে কী করে।
আমি মনে মনে ভাবলাম, খাবারের বহর দেখে মনে হচ্ছে ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। এই সেই দিরাই শাখা। ১৯৭৩ সালে চালু হওয়ার পর দুই বছরের মাথায় স্থানীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপক দুর্নীতির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ১৫ বছর পর ১৯৯০ সালে ফের চালু করা হয়। ওই একই ধরনের দুর্নীতির কারণে দুই বছরের মাথায় ফের বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৫ সালে মাথার উপর বিশাল দায়িত্ব দিয়ে রংপুর থেকে বদলি করে আমাকে এখানে পাঠানো হয়। অনেক বড় চ্যালেঞ্জ, শাখাটাকে কলঙ্কমুক্ত করে পুরোপুরি অপারেশনাল করা।
যেদিন আমি এখানে এসে জয়েন করি, একজন কর্মচারি শুধু এখানে ছিলো, পাহারাদার। নাম গনেশ মাঝি। শুনলাম ৭৩ সাল থেকে গনেশ মাঝি এ অফিসে কাজ করছে। মাঝখানে যতোবছর অফিস বন্ধ থেকেছে, এই গনেশ মাঝিই অফিস ঝেড়ে-মুছে চকচকে করে রেখেছে। আগলে রেখেছে।
তো এই সেই দিরাই অফিস, যার গায়ে দুর্নীতির দগদগে ক্ষত রয়েছে। এদের যত্নের বহর দেখে আমার সন্দেহ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু গনেশ মাঝির কথা মনে হতেই আমার কী যেনো একটা হয়ে গেলো। আমি আনমনা হয়ে পড়লাম। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আমি এখানে ছিলাম। গনেশ মাঝির সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। ২০০০ সালে আমাকে প্রধান কার্যালয়ের অডিট শাখায় বদলি করার পর পনের বছর কেটে গেছে। ওই সময় গনেশের বয়স পয়ষট্টির কাছাকাছি ছিলো। গনেশ কি আজও বেঁচে আছে? থাকলে চাকরি করার মতো শক্তি-সামর্থ্য হয়তো নেই। বেঁচে থাকলে কোথায় আছে সে? যতোদূর মনে পড়ছে তিনকূলে ওর কেউ ছিলো না। দূরের গাঁয়ে একটা কুঁড়েঘর ছিলো। তাও বেদখল হয়ে যায়। এই অফিসটাই ছিলো ওর বাড়ি, ওর আপনার জায়গা।
আমি একটু দ্বিধা নিয়ে ব্যবস্থাপক সাহেবকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা আপনি এখানে কতোদিন হলো পোস্টিং পেয়েছেন?
এই বছর তিনেক হল। কেন ভাই?
না, একটা ব্যাপার আছে। আচ্ছা আপনি কি গনেশ মাঝি নামে কারও কথা শুনেছেন, এই অফিসেই পাহারাদারের চাকরি করতো?
নাতো ভাই।
এই অফিসে এ মুহূর্তে সবচেয়ে পুরনো স্টাফ কে আছেন?
একটু ভেবে ব্যবস্থাপক সাহেব উত্তর দিলেন, অ্যাকাউন্টসের জগদীশ দা। ২০০৫ সাল থেকে আছেন।
জগদীশদা এলেন। সালাম দিলেন। আমি বললাম, দাদা বসেন।
দাদা বসলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যখন এখানে জয়েন করেন, তখন কি গনেশ মাঝি নামে কেউ এখানে ছিলো?
উনি একগাল হেসে বললেন, গনেশ দা? ছিলো তো। অমায়িক মানুষ ভাই। এইরকম পরার্থপর মানুষ আমি জীবনে দ্বিতীয়জন দেখি নাই।
আমি জানি। পাঁচ বছর এখানে ছিলাম। আমার জীবন ছিলো গনেশময়।
সবাই হেসে উঠলাম আমরা। তারপরই দাদার কথায় নিভে গেলাম।
২০০৯ সালের দিকে মারা গেছেন গনেশ দা। বললেন উনি।
কীভাবে? মানে কীভাবে মারা গেলেন? আমি উদ্বেগের সঙ্গে প্রশ্ন করলাম।
সঠিক কারণ ঠিক জানা যায় নাই। একদিন সকালে পাশের নদীতে উনার লাশ ভাসতে দেখা গেলো। ব্যস এটুকুই। মাঝি ছিলো। চমৎকার সাঁতার জানতো। পঁচাত্তরের কাছাকাছি বয়স, তবু শরীর ছিলো শক্তপোক্ত। পঁচাত্তর মনেই হতো না। মনে হতো ষাটের নিচে। সেই মানুষ কী করে যে নদীতে ডুবে মারা যেতে পারে, আমাদের মাথায় ঢোকে না।
আমি সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করলাম, কেউ খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়নি তো?
দাদা উত্তর দিলেন, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে তো সেরকম কিছু আসে নাই। জলে ডুবে মরার কথাই বলা হয়েছে।
একটা নাতিদীর্ঘ কষ্টশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার মুখ দিয়ে, ও!


বিকেলের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারলাম না। ব্যাপক ঘাপলার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সমস্ত কর্মসূচির ব্যবস্থাপকরা এক স্বরে কথা বলছে। আমার মনে হলো, আরও আধাবেলা অন্তত কাজ করা দরকার। দিরাই শাখা কোন অভিশাপে জানি না তার কালিমালিপ্ত ঐতিহ্য থেকে বের হতে পারছে না।
দুপুরের পর ঘণ্টা দু’য়েকের জন্য টানা বৃষ্টি হয়েছে। আকাশ মেঘলা। আরও বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আজ আর সিলেটে ফিরবো না। রাতটা দিরাই শাখার গেস্টরুমেই কাটিয়ে দেবো।
দুপুরের পর থেকে স্মৃতিকাতরতা গ্রাস করলো আমাকে। গনেশ মাঝির স্মৃতি। পাঁচ বছর লম্বা সময়। এই সময়ে গনেশদার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি তৈরি হয়েছিলো। উল্কাখণ্ডের মতো খণ্ড খণ্ড স্মৃতি আছড়ে পড়তে লাগলো মনভূমিতে।
গনেশদা একজন জংলি ধরনের মানুষ ছিলো। মুখ ভরতি দাড়ি, কালে-ভদ্রে শেভ করতো, তবে স্নান করতো নিয়মিত নদীতে গিয়ে। গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করে ভুস করে ডুব দিতো জলে।
ধর্মপ্রাণ মানুষটা মাছ-মাংস তরি-তরকারি প্রায় না ধুয়েই রেঁধে ফেলতো আর হাত না ধুয়েই সেই খাবার গপ্ গপ্ করে খেয়ে ফেলতো।
আমি একদিন বললাম, গনেশদা মাছ-মাংস তরি-তরকারি না ধুয়ে রান্না করাটা ঠিক?
গনেশদা হেসে উত্তর দিলো, ও বাবু ধুয়েও রেন্দে দেখিছি, না ধুয়েও দেখিছি। কোনো লাভ নাই। না ধুলেও আমি গনেশ মাঝি, ধুলেও আমি গনেশ মাঝি। বাবু তো আর হচ্ছি না।
আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি তোমাকে আজ থেকে গনেশবাবু বলে ডাকবো।
হে হে করে হেসে উঠে গনেশদা বললো, কয়লা ধুলে কী আর ময়লা যায় বাবু!
দু’টো লুঙ্গি ছিলো তার, আর একটা শার্ট। এই পরতো। পাঁচ বছরে অন্য কিছু দেখিনি। পেটানো শরীর ছিলো তার। পরতে পরতে ক্লিশে হয়ে যাওয়া শার্টের নীচে কিলবিল করতো তার পেশল শরীর।
এরকম একটা শরীরের মালিক। বিয়ে করোনি কেন গনেশদা?
বিয়ে করতে শরীল লাগে নাকি বাবু?
লাগে না? তাহলে কী লাগে?
মন লাগে।
তোমার কি মন নাই?
গনেশদা উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কী হলো উত্তর দাও না কেন? আমি আলতো ধমকের সুরে বললাম।
আছে।
তয় বিয়ে করোনি কেন? আমি নাছোড়বান্দা। তখন রাত প্রায় ৯টা। সবাই একে একে অফিস ত্যাগ করেছে। আমি শেষবারের মতো দিনের হিসাব মিলিয়ে নিচ্ছিলাম আর গনেশদার সঙ্গে কথা বলছিলাম।
গনেশদার মুখ ঈষৎ বিবর্ণ হয়ে গেলো। চোখ ছলছল করে উঠলো। বললো, ইচ্ছে হয় নাই।
আমি বললাম, কোনদিন ইচ্ছে হয় নাই?
হইছিলো, একবার। ওই একবারই বাবু।
গল্পটা আমি শুনতে চাই।
এখন ভালো লাগছে না বাবু। অন্য একদিন কবো।
আমি জোর করলাম না। শুধু বুঝলাম, ভালোবাসা এই মানুষটার জীবনেও এসেছিলো। এই ছন্নছাড়া, ছিন্নমূল, আত্মীয়-পরিজনহীন মানুষটার জীবনেও এসেছিলো নারীর প্রতি ভালোবাসা। কেমন ছিলো সেই ভালোবাসার চেহারা? প্রচণ্ড জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু জানতে হলে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। জবরদস্তি আমি পছন্দ করি না। তাছাড়া এই আলাভোলা মানুষটাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি।

সন্ধ্যার একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো। আমি কাজ শেষ করে ফাইলপত্র বন্ধ করে উঠে পড়লাম। গেস্টরুমে ঢুকে পোশাক পাল্টে নিলাম। ট্রাউজার আর টি-শার্ট। বের হয়ে এলাম অফিস থেকে।
এক ব্যবস্থাপক বললো, ভাই কি বাজারের দিকে যাচ্ছেন?
আমি বললাম, না। নদীর দিকে যাচ্ছি।
আমি কি আসবো আপনার সাথে?
না, তার দরকার হবে না। আসলে যখন এই ব্রাঞ্চে ছিলাম, রোজ একবার নদীর পাড়ে যেতাম। একাই যেতাম। নদীর পাড়ে একা একাই ভালো লাগে।
অফিস অঙ্গনের পর একটা শালবন। তারপরই নদী। খুব চওড়া নয়, তবে স্রোত আছে। নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই সন্ধ্যা নামলো। নদীটা একদম আগের মতোই আছে। ছোট ছোট নৌকো দেখা যাচ্ছে; এপার থেকে ওপার  যাচ্ছে, কোনোটা আবার দক্ষিণ দিকে বাজারের ঘাটের দিকে যাচ্ছে। সবই আছে, আগের মতো, শুধু গনেশদা নেই, যে একসময় এ নদীতেই নৌকার মাঝি ছিলো।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করলো। আমি একটা হিজল গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। সন্ধ্যার কারো রঙ বৃষ্টির সঙ্গে মিশে গিয়ে টুপটাপ ঝরে পড়ছে নদীর উপর।
১৯৯৭ অথবা ৯৮ সালে এরকমই এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম নদীর পাড়ে। টুপ টুপ করে বৃষ্টি ঝরছিলো। আমি ভিজছিলাম, ভিজতে ভালো লাগছিলো বলে। হঠাৎ পেছন থেকে গনেশদার গলা পেলাম। কী হলো বাবুসাব, বিষ্টিতে ভিজতিছেন যে। ঠাণ্ডা লাগবে তো...
আমি বললাম, রাখো তোমার তোমার ঠাণ্ডা। আসো ভিজি। ভিজতে ভিজতে গল্প করি।
গনেশদা কাছে সরে এলো। নদীর দিকে তাকালো। তারপর বললো, হায়রে নদী!
নদীর উপরে দার্ঘশ্বাস ছাড়লে কেন? নদী তোমার কী ক্ষতি করেছে?
গনেশদা আনমনে বললো, অতলে চলে গেলো সব। অতল...
আজ অনেক বছর পর সেই নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছি। মনে মনে আবৃত্তি করলাম, অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে।

১৯৭১ সালের জুলাই অথবা আগস্ট হবে। পুরোদমে যুদ্ধ চলছে। গনেশদার বিবরণ থেকে এরকমই মনে হয়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো। নদীতে প্রবল স্রোত। গনেশ মাঝি তখন এই নদীতে নৌকো চালায়। বয়স তিরিশের মতো হবে। ‘আমারে দেখতে খুব ভালো ছিলো। সবাই বলতো শিব ঠাকুরের মতো। ’ নিজের সম্পর্কে গনেশদার অভিমত।



গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির দুপুর। নিস্তব্ধ। কোথাও কোনো গোলাগুলির শব্দ নেই। হঠাৎ ওপারের গ্রাম থেকে তিন-চারজন পাকসেনা আর গোটাচারেক রাজাকার দু’টো মেয়েকে ধরে এনে গনেশ মাঝির নৌকায় তুললো। গনেশ অসীম বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েদের দিকে। এদের সে চেনে। যদিও কখনও কথা হয়নি। ধূপপুর গ্রামের নরেন পালের মেয়ে। হৃদি আর দোলা।   এদের নিয়ে পাকহানাদার আর রাজাকাররা কোথায় যাচ্ছে?
কোনো কথা নেই, মেয়ে দু’টি নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে শুধু।



কোথায় যাবেন বাবু?
ওপারমে ক্যাম্পে। একজন পাক আর্মি বললো।
গনেশ মাঝি বুঝতে পারছে এদের গতি-প্রকৃতি সুবিধের নয়। মেয়ে দু’টোকে অত্যাচার করবে বলে নিয়ে যাচ্ছে। তখনই একটা সদ্ধান্ত নিলো সে। মাঝনদীতে নিয়ে নৌকা ডুবিয়ে দেবে। পাক আর্মি কিংবা রাজাকাররা সাঁতার কাটতে পারে কিনা জানে না সে। তবে একটা হইচই বাঁধিয়ে দেবে। নদীপাড়ের গ্রামের মেয়ে হৃদি আর দোলা। তারা যে সাঁতার কাটতে জানবে এটা স্বাভাবিক। তাদের ইজ্জত রক্ষা হলেও হতে পারে। এভাবে সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চায়। নিজের জান গেলে যাবে।
মাঝনদীতে গিয়ে নৌকায় একটা দোল দিলো গনেশ মাঝি। রাজাকাররা গনেশের মোটিভ টের পেয়ে গেলো। একজন প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বললো, শালা মালাউনের বাচ্চা, নৌকা ডুবানোর তালে আছো! ছাল তুলে লবণ লাগিয়ে দেবো। একজন পাক আর্মি তো বন্দুকের বাট দিয়ে গনেশের কাঁধে দিলো এক বাড়ি। কাঁধের একপাশ অবশ হয়ে গেলো।
ঠিক করে নৌকা চালা শুয়োরের বাচ্চা। বললো, আরেক রাজাকার।
বিপদ টের পেয়ে চেপে গেলো গনেশ। জীবনে এতোটা অসহায় আর কখনও লাগেনি তার। যখন ওলাওঠা রোগে তার পরিবারের সবাই দুই দিনের ব্যবধানে মারা যায় তখনও এতোটা অসহায় লাগেনি তার। আহারে একটা যদি বন্দুক থাকতো তার!
ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলো ওদের। প্রাইমারি স্কুলে ক্যাম্প করা হয়েছে। একটা ঘরের মধ্যে তিনজনকে বসানো হলো। হৃদি, দোলা আর গনেশ। প্রথমে দোলাকে নিয়ে যাওয়া হলো অন্য একটা ঘরে। এক ঘণ্টা পর ফিরিয়ে আনা হলো। দুলছে দোলা, কাকাতাড়ুয়ার মতো। তার সালোয়ার-কামিজ শতছিন্ন। চোখে কোনো ভাষা নেই, বোবা দৃষ্টি। এবার দোলাকে বসিয়ে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো হৃদিকে। দোলা বসে বসেই দুলতে লাগলো। ঘণ্টাখানেক পর হৃদি এলো। চোখদু’টো জ্বলছে তার হায়েনার মতো। পৃথিবীর সবটুকু জিঘাংসা সেখানে। গনেশ তার দিকে এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো। তারপর গনেশকে আদেশ করা হলো, ওদের দু’জনকে নৌকা করে ধূপপুর পৌঁছে দিতে। গনেশের প্রথম উপলব্ধি হলো সেদিন, এই শরীরের আসলে কোনো শক্তি নেই, শক্তির উৎস অন্য কোনখানে। কোথায়? হৃদির চোখে একটা শক্তি দেখেছে সে। কিন্তু সেতো কোনো প্রতিরোধ করতে পারেনি, তাহলে ওই শক্তির অর্থ কী? নিজেকে অসম্ভব ছোট লাগতে থাকে গনেশ মাঝির।
নৌকো চলছে। হৃদি আর দোলা তার নৌকায় বসে আছে চুপচাপ। যাওয়ার সময় কোনো কথা ছিলো না, এখনও কোনো কথা নেই। ছপ ছপ করে বৈঠা মারছে গনেশ মাঝি আর আড় চোখে দেখছে হৃদিকে। আবছা অন্ধকার নামছে নদীর উপর। সেই অন্ধকারে তার চোখ আরও বিষমভাবে জ্বলছে। গনেশ মাঝির বুকের ভেতর যেনো কেমন করতে শুরু করলো। বড় উচাটন। বড় অদ্ভুত সেই অনুভূতি।
মাঝনদীতে নৌকা। হৃদি হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীতে। ঝপাৎ করে একটা শব্দ হলো। গনেশ মাঝিও ঝাঁপিয়ে পড়লো।
 
গনেশ বললো, তারপর সমস্ত নদী তোলপাড় করে খুঁজলাম। কোত্থাও পাইলাম না তারে। কোন অতলে যে তলায় গেলো, ভগবান জানে...পরে নৌকায় আইসে দোলারে পৌঁছায়া দিলাম তার বাড়িতে।
গনেশ আরও বললো, হৃদির আত্মা এই নদীতেই আছে।
তুমি জানলে কীভাবে গনেশদা? আমি প্রশ্ন করলাম।
জানব না ক্যান? বর্ষাকাল আসলেই তো কোনো কোনো রাতে আমি তার বৈঠার শব্দ শুনি।
ওই বৈঠার শব্দ যে হৃদির, তুমি বোঝো কীভাবে?
ওই শব্দ একদম আলাদা। একটানা শব্দ। বৈঠার শব্দ একটানা হবে ক্যান? নৌকা তো দূরে চলে যাবে। শব্দ এই জাগা দিয়েই ঘুরতি থাকে। আমি মাঝে মাঝে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি, একটা ডিঙির পরে বসে সেই মাইয়া বৈঠা মারে...
অন্ধকারে দেখো কীভাবে?
চোখদু’টো দেখে বুঝি। হায়নার মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলে...
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, তুমি কি ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলে গনেশদা?
গনেশ মাঝি মাথা নাড়লো। বললো, যখন জলে লাফ দিলো, তখন বুঝলাম, ওই মেয়ের জনম আমার জন্যি। ওই চোখের আগুন আমি কোনোদিন ভুলবো না বাবু।
আমি মনে মনে বললাম, তাই তো ওই আগুন তুমি বার বার দেখো। আমৃত্যু দেখতে থাকবে।

ঘন সন্ধ্যায় হিজল গাছের নিচে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি এইসব পুরনো কথা ভাবছি।
গনেশদা আজ নেই। কোনোদিন ফিরে আসবে না। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। সামনে মাঝ নদী দিয়ে একটা নৌকা যাচ্ছে। বৈঠা মারার ছপ ছপ শব্দ হচ্ছে। সন্ধ্যার আঁধারে নৌকার একটা অস্পষ্ট চলমান অবয়ব।
নৌকায় দু’জন মানুষ। একজন বৈঠা মারছে, অন্যজন উল্টোদিকের গলুইয়ে। একজন পুরুষ, অন্যজন নারী।
মুহূর্তের বিভ্রম। আমার মনে হলো, একজন গনেশদা, অন্যজন হৃদি। ভেসে যাচ্ছে, গন্তব্যহীন, অনন্তের দিকে। যাক।
আমার পায়ের কাছে কিছু বুনোফুল ফুটে ছিলো। আমি কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে নদীতে ভাসিয়ে দিলাম।   
 


বাংলাদেশ সময়: ১৪১২ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ