ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

আগামী পৃথিবীর খাদ্য সামুদ্রিক শৈবাল

আতিফ আতাউর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৫
আগামী পৃথিবীর খাদ্য সামুদ্রিক শৈবাল

দিন দিন ফুরিয়ে আসছে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠভাগের খাদ্য ভাণ্ডার। এজন্য মস্ত মস্ত কৃষিবিজ্ঞানীদের তো বটেই, জিন গবেষকদেরও চিন্তার শেষ নেই।

কৃষিবিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছে, পৃথিবীর ভূমি থেকে উৎপাদিত শস্যের পুরোটা ব্যবহার করতে। আর জিন বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছে, কী করে আরো উন্নতমানের শস্য ও প্রাণীর জাত উন্মোচন করা যায়। উভয় পক্ষের এমন প্রচেষ্টার মাঝখানে খানিকটা স্বস্তি গুঁজে দিচ্ছে শৈবাল বিজ্ঞানীরা। তারা জানিয়েছে, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয় সমুদ্র-তলদেশের খাদ্য সম্ভার।

আপনি হয়ত ভাবছেন, বাপরে! তা কী করে হয়? সমুদ্রে তো শুধু পানি আর পানি। সে পানিতে থাকে নানা প্রজাতির মাছ, তিমি, হাঙ্গর, অক্টোপাস প্রভৃতি। এর বাইরে আর কী-ই বা আছে সেখানে!

শৈবাল বিজ্ঞানীরা জানিয়েছে, সমুদ্রের তলদেশে নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী ছাড়াও আছে এক প্রকার আগাছা। যাকে তারা বলছে—শৈবাল। ‘শৈবাল’ শব্দটি কি কঠিন মনে হচ্ছে? আমাদের এদিকে এর অধিক প্রচলিত নাম হলো শ্যাওলা। তবে স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল ও মাটিতে যে শ্যাওলা বা শৈবাল  জন্মে, তা কিন্তু সমুদ্রের পানির নিচের শৈবালের মতো নয়। পরিবেশ ও প্রকৃতিভেদে শৈবালের বিভিন্ন রকমফের আছে। যাই হোক, এই শ্যাওলাকেই বিজ্ঞানীরা দেখছে বর্তমানের তো বটেই, আগামীদিনেরও, খাদ্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার হিসেবে।

শৈবালের ইংরেজি হচ্ছে অ্যালগি (algae)। লাইকেন (lichen) বা মস (moss)  হিসেবেও এগুলো পরিচিত। কিন্তু এত যে অফুরন্ত শৈবালের সম্ভার—কিভাবে জন্মে এই শৈবাল? প্রাকৃতিকভাবেই সমুদ্রে নানা ধরনের শৈবাল জন্মে। এসব শৈবালের বর্ণিল রূপও কিন্তু দেখার মতো! নানা রঙের সামুদ্রিক শৈবাল পুরো সমুদ্রজগতকেই করে তুলেছে রহস্যময় এক আশ্চর্য সুন্দর!

এই শৈবাল মানুষের খাদ্য হিসেবে পৃথিবীজুড়ে সমাদৃত। কোনো কোনো দেশে শৈবালকে সামুদ্রিক সবজি হিসেবে অভিহিত করা হয়। এর কারণও আছে। কেননা শৈবালের খাদ্যগুণ বা পুষ্টিমান পৃথিবীতে প্রাপ্ত যে কোনো উদ্ভিদের চেয়ে কোনো অংশে কম তো নয়ই বরং অনেকাংশেই বেশি। আমরা জানি, একমাত্র সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত লবণেই আমরা আয়োডিন পেয়ে থাকি। সমুদ্রের শৈবালেও রয়েছে পর্যাপ্ত আয়োডিন। খাদ্য হিসেবে শৈবালের ব্যবহার ডায়াবেটিস ও গলগণ্ডের মতো রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বাদামী ও লাল বর্ণের শৈবালে থাকে ক্যারোটিন নামক পদার্থ যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। শৈবালে বিদ্যমান ক্যারাজিনান মানবদেহের উচ্চরক্ত চাপ কমাতে সহায়তা করে। স্পিরুলিনা নামক শৈবাল দেহের হজম শক্তি বৃদ্ধি, রোগ জীবাণু থেকে রক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শৈবালের পুষ্টি উপাদানগুলো মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—প্রোটিন, ভিটামিন, লৌহ, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, বিটা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিংক, ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৬, ভিটামিন কে এবং ভিটামিন ডি। বয়স্ক ও ডায়াবেটিসের রোগীদের আদর্শ খাবার এই সামুদ্রিক শৈবাল। কেননা দেখা গেছে, অন্যান্য খাবারের তুলনায় শৈবাল খেলে তারা অনেক বেশি সুস্থ বোধ করে। শৈবালবিজ্ঞানী ও পুষ্টিবিদেরা জানিয়েছে, শিশুদের যদি শুরু থেকেই শৈবাল খাওয়ানোর অভ্যাস করানো যায় তাহলে তারা সুষম ও পরিপূর্ণ শারীরিক বৃদ্ধি ও প্রখর বুদ্ধির অধিকারী হয়ে ওঠে।

অনেক শৈবাল রান্নার পাশাপাশি সরাসরি সালাদ বানিয়ে খাওয়া যায়। এছাড়া মাছ, মাংস বা ডিমের সাথেও সবজি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সিঙারা, সমুচা, রোল, বার্গার ও নুডুলসের সঙ্গেও শৈবালের ব্যবহার জনপ্রিয়। অনেক শিশুখাদ্যে, যেমন গম, ভুট্টা, চাল, ডাল ও গুঁড়া দুধেও শৈবাল ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই শৈবাল ও শৈবালজাত খাদ্য সবচেয়ে দামি খাদ্য হিসেবে সমাদৃত। পাশাপাশি হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য, জৈব সার ও জ্বালানি তৈরি হয় শৈবাল থেকে। অনেক দেশে গবাদিপশুকে শৈবাল খাওয়ানো হয়। এতে করে গাভীর দুধ বাড়ে। আবার, ভেষজ, প্রসাধনী ও ঔষধি গুণাগুণের কারণে বিশ্বের অনেক দেশে শৈবালকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বলে অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন রোগের প্রতিকার-ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় শৈবাল ওষুধশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালও বটে।

শৈবালের এমন সব গুণাগুণের জন্যই ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব সম্মেলনে স্পিরুলিনা নামক অতি ক্ষুদ্র নীলাভ শৈবালকে আগামী দিনের সেরা খাদ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন খাদ্যের বিকল্প হিসেবে সামুদ্রিক শৈবালকে স্বীকৃতি দেয়।

১৬৭০ সালে টোকিও উপসাগরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রথম সামুদ্রিক শৈবাল চাষ শুরু হওয়ার পর বর্তমানে চীন, জাপান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চিলি, তানজানিয়া, থাইল্যান্ড, ফিজি, কানাডাসহ বেশ কিছু দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ হচ্ছে। প্রতি মণ শুকনা শৈবাল দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে বাংলাদেশে শৈবাল মূলত পশুখাদ্য ও জমির সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শৈবালের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার কারণেই এমনটি ঘটে বলে মনে করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৫
এএফএ/টিকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।