ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

লোক ঐতিহ্যের দিক দিগন্ত-২

সানজিদা সামরিন, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৫
লোক ঐতিহ্যের দিক দিগন্ত-২

ঢাকা: বাংলাদেশের ঐতিহ্যের শেকড় হলো গ্রাম। গ্রামীণ জীবণপ্রণালী, শস্য উৎপাদন, যানবাহন, যন্ত্রপাতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, ধর্মীয় বিশ্বাস, চিত্তবিনোদন ইত্যাদির সরল, প্রাণবন্ত ও প্রাকৃতিক রূপ আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের মৌলিক বৈশিষ্ট্য।



তবে সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসায়, কর্ম পরিসর, পোশাক-পরিচ্ছদ, আহার, উৎসব ও  যাতায়াতের মাধ্যমগুলোর দিক থেকে হয়ে উঠছে আরও আধুনিক ও উন্নত। এটা অবশ্যই ভালো দিক। তবে নগরায়নের ফলে আমাদের স্বকীয় লোক সংস্কৃতিও প্রভাবিত হচ্ছে নগর সংস্কৃতির আলোক ছটায়।

এই বিচিত্র, গতিশীল ও ঝাঁ চকচকে নগরায়নের প্রভাবে কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিনির্ভর বাংলার প্রাচীন সব লোক ঐতিহ্য। সেসব মণি-মাণিক্য নিয়েই এবারের আয়োজন।

আলপনা ও পিঁড়িচিত্র

আলপনা, পিঁড়িচিত্র, দেওয়ালচিত্র, অঙ্গচিত্র প্রভৃতি আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের অপরিহার্য অংশ। পূজা, অন্নপ্রাশন, বিয়ে ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উঠান, দেওয়াল, কুলা, ডালা ইত্যাদিতে  আলপনা করা হয়। পিঁড়িচিত্রও থাকে এসময়। ব্রতপূজা উপলক্ষে ব্রতের আলপনা দেওয়ার রীতি রয়েছে। আলপনা বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব ধারা।

পটচিত্র

পটচিত্র বাঙালির ধর্মীয় আবেগ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। পটচিত্রের মধ্যে কালীঘাটের পট উল্লেখযোগ্য। প্রাথমিক পর্যায়ে পটচিত্রের বিষয় ছিল পৌরাণিক ও ধর্মীয় কাহিনী। কারণ, কালীঘাটে তীর্থযাত্রীরা যাত্রার প্রতীক হিসেবে এটি নিয়ে যেতেন।

নকশি পিঠা

বাঙালির লোক ইতিহাস-ঐতিহ্যে পিঠা-পুলির গুরুত্ব অনেক। এটি লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই একটি অংশ।

মিষ্টি

বাঙালি বরাবরই ভোজন রসিক। আয়েশি ভোজনের পর মিষ্টিমুখ করা বাঙালির এক অপরিহার্য অংশ। এসব প্রসিদ্ধ মিষ্টির মধ্যে পোড়াবাড়ির চমচম, মুক্তাগাছার মন্ডা, কুমিল্লার রসমালাই, ফরিদপুরের মালাইকারি, নাটোরের কাঁচাগোল্লা,  রাজশাহীর রসকদম্ব, বগুড়ার দই, সাভারের রসগোল্লা, ঢাকার জিলিপি ও প্রাণহরা অনেক জনপ্রিয়।

লোককাহিনী, লোকনাট্য ও পালাগান

গ্রামের মানুষ মুখে মুখে কল্পকাহিনী বানায় এবং বংশ পরম্পরায় তা মানুষের মনে গেঁথে থাকে। ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি, ঠানদিদির থলে ইত্যাদি ছাড়াও ধাঁধা এবং নীতিকথামূলক গল্পও এর অন্তর্গত। এসব লোককথা,  রূপকথা, ব্রতকথা, কিংবদন্তি ও লোকপুরাণ মিলে লোককাহিনীর বিশাল ভান্ডার থেকেই তৈরি হয় লোকনাট্য। যাতে স্থান পায় বৈষয়িক ও জাগতিক উন্মুক্ত ভাবনা।

লোককাহিনীর মতোই পালাগানে ধরা পড়ে সমাজের বাস্তব চিত্র। প্রেম ছাড়াও এসব পালাগানের মূল বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে বীরত্ব, ন্যায়নীতি ও কাল্পনিক নানা চরিত্র।

পুতুল নাচ

গ্রামবাংলার অন্যতম বিনোদনের আকর্ষণ ছিল পুতুল নাচ। সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বা পৌরানিক কাহিনী অবলম্বনে পুতুল নাচ হতো। তবে বর্তমানে বাঙালি ঐতিহ্যের এ অন্যতম দাবিদার প্রায় বিলুপ্তির পথে।

লোকসংগীত

অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশত লোকসঙ্গীতের ধারা প্রচলন রয়েছে। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া,  মুর্শিদি, মারফতি, বাউল, গম্ভীরা, কীর্তন, ঘাটু, ঝুমুর, বোলান, আলকাপ, লেটো, গাজন, বারমাসি, ধামালি,  পটুয়া, সাপুড়ে, খেমটা প্রভৃতি। এছাড়াও মেয়েলি গীত, সহেলি গীত, হুদমা গীত প্রভৃতি গানগুলোতে বাংলার অন্তর্নিহিত নারীসমাজের সুপ্ত চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে।

খনার বচন

খনার বচন যুগ যুগান্ত ধরে গ্রাম বাংলার জন জীবনের সঙ্গে মিশে রয়েছে। খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্বভিত্তিক ছড়া। আনুমানিক ৮ম থেকে ১২শ’ শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছে খনার বচন। যেমন- ‘তার অর্ধেক তুলা, তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান’। ‘আগে খাবে মায়ে, তবে খাবে পোয়ে’। ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন ও ধাঁধা

কোনো কাজে উৎসাহ বাড়াতে ও চিত্তবিনোদনের জন্য অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে মুখে মুখে ছড়া তৈরি হতো।   এছাড়াও বাইস্কোপ দেখানোর সময় ছড়া কেটে দেওয়া হতো ছবির বর্ণনা। ছড়ার পাশাপাশি এদেশের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো প্রবাদ-প্রবচন। প্রবাদ-প্রবচন লোকপরম্পরাগত বিশেষ উক্তি বা কথন। যেখানে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটে। যেমন- ‘অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’, ‘জোর যার মুলুক তার’ ইত্যাদি।

এছাড়া রয়েছে বাঙালির অতিপ্রিয় ধাঁধা। এসব ধাঁধাও বংশপরম্পরায় মানুষ মনে রাখে। বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদ,  চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ও শিবমঙ্গল কাব্যে এবং নাথসাহিত্যে  গোপীচন্দ্রে গান, গোরক্ষবিজয়, বাউল গান ও কবিগানে বহু সাহিত্যিক ধাঁধার সন্ধান পাওয়া যায়।

ঐতিহ্যবাহী খেলা

আমাদের দেশে বেশ কিছু লোকক্রীড়া রয়েছে। হাডুডু, নৌকা বাইচ, বউছি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, নুনতা, চিক্কা, ডাংগুলি, ষোলোঘুঁটি, মোগল-পাঠান, এক্কাদোক্কা, বউরানি, কড়িখেলা, ঘুঁটিখেলা, কানামছি, ঘুড়ি ওড়ানো, কবুতর ওড়ানো, মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই ইত্যাদি।

বাংলাদেশ সময়: ০২৪১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৫
এসএস

** লোক ঐতিহ্যের দিক দিগন্ত-১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।