ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা!

সানজিদা সামরিন, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৪, ২০১৫
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা!

ঢাকা: সকালের মিঠে রোদ গালে পড়তেই অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। মৃদু বাতাসে জানালার পর্দা উড়ছে।

পর্দার আড়াল থেকে আকাশটা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। ছুটে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে দূর দিগন্তে। এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে দৌড়ে বারান্দায় গেল হিয়া। খানিক বাদে মায়ের ডাকে চমকে উঠলো সে।

‘বারান্দায় কী করছো হিয়া! তোমাকে না বলেছি, যখন-তখন বারান্দায় যাবে না। এখন বড় হয়েছ তুমি। ’

মায়ের কথায় মনটাই খারাপ হয়ে গেল হিয়ার। মাঝে মাঝে মাকে সে ঠিক বুঝতে পারে না। এইতো কাল রাতেই মা বললেন, ‘তুমি এখনো অনেক ছোট, সব ব্যাপারে তোমার না জানলেও চলবে। ’

আবার এখন বলছেন, ‘বড় হয়ে গেছ’। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিয়া নিজেই দ্বিধান্বিত। সে কী বড়, নাকি ছোট! কেমন আচরণ করা উচিৎ তার!

মা এখন আর আগের মতো সব জায়গায় যেতে দেন না হিয়াকে। এমনকি কোনো অতিথির সামনেও যেতে বারণ করেন আজকাল। বলেন, দূরত্ব রেখে চলতে। শুধু স্কুল আর বাড়ি। খেলার পুতুলগুলোর সঙ্গও আর ভালো লাগে না। ওরা  শুধু এখন ঘর সাজানোর উপকরণ মাত্র। হিয়ার ইদানিং অযথাই মন খারাপ হয়ে যায়। সব বিষণ্ণ লাগে।

কেন এমন হয়
বয়ঃসন্ধিকাল জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। এসময় ছেলেমেয়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। একই সঙ্গে এই দুইয়ের পরিবর্তন তাদের ভেতর এক নতুন অনুভূতির সঞ্চার হয়। যার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নানারকম প্রশ্ন, বিষণ্ণতা, চাপা কষ্ট, অসহায়বোধ ও শূন্যতাবোধ সৃষ্টি হয়।

অনেকে আবার আগের তুলনায় বেশি চঞ্চল হয়ে ওঠে।   শারীরিক ও মানসিক নতুন অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে প্রকাশ করতে মন খুঁজতে থাকে নিরাপদ আশ্রয়। এসময় বাবা-মাকে অনেক ক্ষেত্রে ভিলেন মনে হতে পারে। মনে হতে পারে, পরিবারের কেউ বুঝি তাকে আর ভালোবাসে না। পারিবারিক শাসনের নতুন মাত্রা ও নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অনেক সময় মানসিক অবসাদ ও হতাশার স্বীকার হয় তারা।

বাঁধ ভাঙা মন
বয়ঃসন্ধিকালকে অনেক সময় ক্রান্তিকালও বলা হয়। কারণ, এ বয়সে মানবিক বিচারের মানদণ্ডে বাস্তবতার চাইতে আবেগের পাল্লাটা থাকে বেশী ভারি। উচ্ছল, দুর্বার মন ডানা মেলে আকাশে মেঘের সঙ্গী হয়ে ভেসে বেড়াতে চায়। জয় করতে চায় পুরো বিশ্ব। পরতে চায় প্রশংসার সোনার মুকুট। এ বয়সে ছেলেমেয়েরা বিচার করে আবেগ ও আদর্শ দিয়ে। এসব কারণে অনেক সময় পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তবুও বাঁধ ভাঙা মন উজাড় করে দিতে চায় সবটুকু ভালোবাসা। হৃদয়ের বদ্ধ দ্বারের আড়ালে রয়েছে এমনই শক্তি, যা সূর্যকেও হার মানায়। এ শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে ভালো কোনো কাজে।

এ সময়টাতে ছেলেমেয়েদের মনে অস্থিরতা ও উত্তেজনা কাজ করে। অনেকেই এ অস্থিরতা রাগের মাধ্যমে প্রকাশ করে।   ফলে অনেকসময় তারা ভুল সিদ্ধান্তে জড়িয়ে পড়ে। চিন্তাধারা আদর্শভিত্তিক হওয়ায় যখন তারা নিজের ভুল বুঝতে পারে, তখন নিজের মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি হয়। তাই অনেকেই অনুশোচনাবোধ থেকে নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। ফলে বিষণ্ণতায় ভোগে। তবে এসময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরিবারের সহায়তা। কারণ তাদের জমে থাকা এই আবেগ, নেতিবাচক ধারণা ও কষ্টগুলো ভবিষ্যত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভোগান্তি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

পরিবারের করণীয়
বয়ঃসন্ধিকালের এমন হাজার রঙের অনুভূতিগুলোকে সামলে নিতে প্রয়োজন একটি নির্ভরযোগ্য কাঁধ। তা হতে পারে বাবা, মা, ভাই-বোন বা পরিবারের যেকোনো সদস্য। তাই বাবা-মার উচিত ছেলেমেয়েদের প্রতি বাড়তি যত্নশীল হওয়া ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। তাদের চাওয়া-পাওয়ার দিকগুলোকে বুঝে যথাযোগ্য মূল্যায়ন করাই শ্রেয়। কারণ এটা তো সত্যি যে, তাদের সব চাওয়াই অমূলক নয়। এতে তারাও পরিবারকে মূল্যায়ন করতে শিখবে।

পরিবারের বড়দের একটা কথা মনে রাখা উচিত, সন্দেহ বা কড়া নজর আপনার সন্তানকে সঠিক পথ নাও দেখাতে পারে। বরং এতে সে আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারে। এরচেয়ে তাদের মধ্যে সঠিক বোধ তৈরি করে দিন। ভালো-খারাপের মধ্যে পার্থক্য জ্ঞানই তাদের সত্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাদের আশ্বাস দিতে হবে যে, সব সঙ্কটকালে পরিবার তার পাশে থাকবে। একইসঙ্গে তাদের ভুলগুলোর কারণ ও ফলাফল তুলে ধরে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে হবে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

যেকোনো বিষয় তাদের ওপর চাপিয়ে না দিয়ে সেগুলোর ভালো ও খারাপ দিকগুলো দেখিয়ে দিতে হবে। এতে করে তারা নিজেরাই বুঝতে পারবে আসলেই কোনটি তার জন্য ঠিক। অন্যদিকে, কোনোকিছু বলার জন্য তাদের উপর চাপ সৃষ্টি না করে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করুন। দেখবেন, আপনার বিশ্বাস আপনার সন্তানকে আপনা আপনিই আপনার কাছে নিয়ে আসবে।

ভুল পথে পা বাড়িও না
জীবনের এই নতুন বাঁকে এসে অনেকেই লক্ষভ্রষ্ট ও ভুল পথে অগ্রসর হতে পারে। অনেক সময় নেশা ও মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে তারা। হারিয়ে যেতে থাকে অন্ধকারের জগতে। তাই বাবা-মাকে আরও বেশী সচেতন হতে হবে। খোঁজখবর নিতে হবে সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে। অন্যদিকে, ছেলেমেয়েদেরকেও পারিবারিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

স্বপ্নের রঙিন ডানা
কুঁড়ির পরে ফুলটি যখন পাঁপড়ি মেলতে শুরু করেছে, তখনই রঙিন চশমা চোখে দিয়ে বিশ্বকে দেখতে চাইছে মন। দিবাস্বপ্নের উত্তাল ঢেউয়ে মাতাল ডিঙা বইতে শুরু করেছে। বন্ধুরা স্বপ্ন দেখো। সে স্বপ্ন হোক আকাশছোঁয়া। মন কি বলে! রকস্টার নাকি পাবলো পিকাসো হয়ে তুলির আঁচড়ে রাঙিয়ে দেবে গোটা বিশ্ব! যাই হোক, কোনো কিছু শুরু করার আগে মনের কথা শোনো, দেখো সে কী বলতে চায়। আর সঙ্গে রেখো নিজের মস্তিষ্ককেও। কারণ, মন যেমন আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু, তেমনি মস্তিষ্কও আমাদের সবচেয়ে বড় অভিভাবক। মনে রেখো, যে যাই করুক, তোমার মস্তিষ্ক কখনও তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।

চলো আরেকবার উড়ি
বন্ধুরা, প্রকৃতির সব রঙ গায়ে মেখে অন্ধকার ঘরে চুপটি করে বসে রইলে চলবে! জলদি ওঠো আর লেগে পড়ো কাজে। কী করতে ভালো লাগে তোমার? না হয় আজকে নিজের ঘরটাকেই সাজিয়ে নিলে মনের মতো করে। ফুল, স্টিকার, প্রিয় তারকার পোস্টার আর নিজের বানানো ঝাড়বাতিতে সাজিয়ে নাও তোমার ঘর। আর ভালোবাসো নিজেকে। নিজেই খুঁজে নাও নিজেকে ভালোবাসার হাজারটা কারণ।

বাংলাদেশ সময়: ০২২৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।