ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

বিজ্ঞানী নিজেই যখন গিনিপিগ

আতাউর রহমান রাইহান, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৫
বিজ্ঞানী নিজেই যখন গিনিপিগ

বিজ্ঞানী সবার চেয়ে একটু আলাদা। তিনি ভিন্ন কিছু করবেন, করেন এটাই স্বাভাবিক।

কোনোকিছুর সত্য জানতে ব্যক্তিগত সুখ-শান্তিও ছাড়তে পারেন তারা।

যেমন, চোখ কীভাবে রং অনুভব করে- এই তত্ত্ব আবিষ্কার করতে আইজ্যাক নিউটন নিজের চোখের কোটরে একটি রিফু করার সুই বসিয়েছিলেন। রঙের চক্রগুলো দেখতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এই পরীক্ষা চালান।

জার্মানিতে নোবেলজয়ী ওয়ার্নার ফরসম্যান নিজের হৃদযন্ত্রে সরু নলের ক্যাথেটারের পরীক্ষা করেন। তাদের মতো এখনকার বিজ্ঞানীরাও নতুন কিছু আবিষ্কারে নিজেদের গিনিপিগ বানিয়েছেন।

চলুন জেনে নেওয়া যাক এমন কয়েকজন বিজ্ঞানীর সাত সতের।

পেটভর্তি ব্যাকটেরিয়া
আশির দশকের কথা। বেরি মার্শাল নামে এক তরুণ চিকিৎসকের মনে হলো আলসারের জন্য কেবল মানসিক চাপ আর মসলা জাতীয় খাবারই নয়; ব্যাকটেরিয়াও দায়ী।

বিষয়টির প্রমাণ তুলে ধরতে তিনি মারাত্মক একটি কাজ করেন। অস্ট্রেলীয় এই চিকিৎসক নিজেই মাছ, মাংস ধোয়া এক কাপ পচা ঘোলা পানি পান করেন। যাতে হ্যালিকাব্যাকটার ফাইলোরিয়া জীবাণু ছিল। এই ব্যাকটেরিয়া থেকেই পাকস্থলীতে আলসার হয়।

এরপর সপ্তাহ খানেক তিনি কেবল বমি করে গেলেন। পরীক্ষায় দেখা গেছে, তার পাকস্থলির রেখায় প্রদাহ হয়েছে, অর্থাৎ আলসারের লক্ষণ ধরা পড়েছে। এরপর অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পর তার এই সংক্রমণ ভালো হয়।

এখন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে প্রতিনিয়ত আলসারের চিকিৎসা চলছে। মনোবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যায় অবদান রাখায় ২০০৫ সালে যৌথভাবে বেরি মার্শাল নোবেল পুরস্কার পান।

পায়ে মক্ষিকা উপদ্রব
জার্মান পিএইচডি গবেষক মার্লেন থিলেক যখন দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কারে ছিলেন, তখন তিনি দেখলেন যে একটি মক্ষিকা তার পায়ের তলায় গর্ত করছে। তিনি সেটিকে দেখেও না দেখার ভান করলেন। অর্থাৎ না তাড়িয়ে পায়ের তলায় গর্ত করতে  দিলেন।

এরপর এই নারী গবেষক ভাবতে লাগলেন, কীভাবে এই পরজীবী প্রাণীর পুনরুৎপাদন ঘটে।

আসলে মানুষের ত্বকে গর্ত খোঁড়ার পর স্ত্রী মক্ষীকা তাতে ডিম ছাড়ে। পরে তিনি খেয়াল করলেন, তার শরীরের এই মক্ষিকা জুতার আড়ালে থাকতে পছন্দ করে। স্থানীয় যেসব লোক খালি পায়ে থাকে, এই রক্তজীবী প্রাণী তাদের পায়ে কখনো ডিম পাড়ে না।

থিলেকের উৎসুক মনোভাবে একটি ধাঁধার সমাধান হলো। সেটি এমন, পায়ে সবসময় জুতা পরলে পুরুষ মক্ষিকার সঙ্গে স্ত্রীটির মিলন প্রক্রিয়া ভেঙে যায়। তারা ডিম ছাড়তে পারে না, পুনরুৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে।

ত্বকে কিলবিল করে কীট
২০০৪ সাল। প্রতিষেধকবিদ ডেভিড প্রিটচার্ডের অ্যাজমা চিকিৎসার পরিকল্পনার কথা শুনে ব্রিটেনের চিকিৎসা ও জীববিদ্যা গবেষণায় সংশ্লিষ্টরা খুবই বিস্মিত হয়ে পড়েন।

কারণ তিনি বক্রকীটের লার্ভাসহ একটি পট্টি নিজের হাতে বাঁধেন। এরপর এই ক্ষুদ্র কীটগুলো তার হাতে ছিদ্র করে রক্তস্রোতে মিশে যায়। এতে তার শরীরে অবর্ণনীয় চুলকানি ও ব্যথা শুরু হয়।

প্রিটচার্ডের ধারণা ছিল, এই কীটগুলো তার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অকার্যকর করে দেবে। যে লক্ষণগুলো দেখে রোগ শনাক্ত করা হয়, তাও নষ্ট করে দেবে।
তার গবেষণা এ বিষয়ে আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর দরজা খুলে দিয়েছে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ক্ষুদ্র কীটের ব্যবহারের কার্যকারিতা নিয়ে বর্তমানে ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।  

এছাড়াও কাঠিন্য, কচ্ছুরোগ ও অটিজমসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় পরজীবী কীটের কার্যকারিতা নিয়ে পৃথিবীজুড়ে চলছে গবেষণা।  

শরীর থেকে উপাত্ত সংগ্রহ
প্রজননশাস্ত্রবিদ মাইকেল স্নাইডারের একটি বড় স্বপ্ন ছিল- রোগীর জিনগত বৈশিষ্ট্য দেখে ওষুধ প্রয়োগের কার্যকারিতার বিষয়টি তিনি প্রমাণ করে ছাড়বেন। যদিও নৈতিক কিংবা প্রযুক্তিগতভাবে বিষয়টি ছিল বিতর্কিত।

তবে তিনি ছিলেন বেপরোয়া। প্রায় চার বছর ধরে স্নাইডার নিজের শরীর থেকে লাখ লাখ উপাত্ত নিয়েছেন। তার রক্ত, লালা, শ্লেষ্মা ও প্রস্রাব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি নিজে ও তার স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দলটি।

তারা স্নাইডারের জেনোমোর পরম্পরা তৈরি করেছেন। পাশাপাশি তার ডিএনএ তৎপরতা থেকে নিয়মিত উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।

শেষে দেখা গেল তার জিনগত প্রবণতায় উচ্চমাত্রায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি রয়েছে। এটা স্নাইডারের জন্য বিস্মিত হওয়ারও বড় কারণ ছিল। কারণ তার পরিবারের কারও এই রোগটি ছিল না।

ঠাণ্ডাজনিত ভাইরাসের সংস্পর্শে আসায় তার রক্তের শর্করা উচ্চমাত্রায় বেড়ে শরীরে পূর্ণমাত্রায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

স্নাইডার মনে করেন, তার জিন তার বৈশিষ্ট্যই প্রকাশ করেছে। কিন্তু ভাইরাস সংক্রমণ  নিয়ে আরও গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।

মশার খাবার
গবেষক স্টেফেন হফম্যানের ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক উদ্ভাবনের উদ্যোগটি ছিল সত্যিই সাহসী পদক্ষেপ। পৃথিবীজুড়ে বছরে অন্তত পাঁচ লাখ লোক ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। মূলত এ কারণেই তিনি উদ্যোগটি নিয়েছেন।

প্রতিষেধক উদ্ভাবন করতে গিয়ে  স্টিফেন ম্যালেরিয়ার জীবাণুবহনকারী তিন হাজার মশা নিজের হাতে বসিয়ে দিলেন। কিন্তু বিকিরণের (radiation) কারণে পরজীবী মশকগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। তার শরীরে জীবাণু ছড়াতে পারেনি। বিষয়টি একেবারে পোলিও ভ্যাকসিনের মতো, যা ভাইরাসকে দুর্বল করে দেয়।

শেষ পর্যন্ত স্টিফেনকে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত করতে পারলো না। কোন প্রকার অসুস্থ না হয়েই তার শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছিল।

গবেষণার প্রাথমিক পরীক্ষায় তিনি এক ধরনের টিকা আবিস্কার করেছেন। যেটি ব্যবহার করে স্বেচ্ছাসেবীরা ম্যালেরিয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন। এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও আফ্রিকায় এই টিকার চূড়ান্ত পরীক্ষা চলছে।

হাতের ভেতরে কম্পিউটার ভাইরাস
ধরুন, সন্ত্রাসীরা এমন একটি ভাইরাস আবিষ্কার করল, যেটি হৃদস্পন্দনের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার যন্ত্র পেসমেকার হ্যাক করে বন্ধ করে দিতে পারে। প্রযুক্তির এ যুগে এমনটা ঘটা অসম্ভব কিছু নয়।

সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ব্রিটিশ প্রকৌশলী মার্ক গ্যাসন তার হাতের ভেতরে রেডিও তরঙ্গ শনাক্তকরণ চিপ বসিয়েছিলেন। এটি দেখতে পোষা প্রাণীর অবস্থান জানতে অথবা নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের শরীরে বসানো ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মতোই। যদিও দুটির কার্যক্রম ভিন্ন।

শেষমেশ প্রকৌশলী গ্যাসনও কম্পিউটার ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। পাশাপাশি তার শরীরে বসানো চিপটি সেটির সাথে সংযোগ আছে এমন সব কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে।

কেবল তাই নয়, কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ করা অন্যান্য চিপগুলোতেও ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। তার মানে দাঁড়াল, আমাদের শরীরের ভেতরে বসানো যে কোনো যন্ত্র ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

যদিও গ্যাসন খুব একটা শারীরিক ঝুঁকির মধ্যে পড়েননি। কিন্তু বাস্তব জীবনের দৃশ্যপটে দেখা যায়, হৃদরোগীরা তাদের শরীরে বসানো যন্ত্রের কারণে সমস্যা অনুভব করেন।

তার এই পরীক্ষা প্রত্যেকের জন্যে চিকিৎসা ডিভাইস নিরাপদ রাখার পথ তৈরি করে দিয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।