ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

৪ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় লক্ষ্মীপুর

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০২৩
৪ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় লক্ষ্মীপুর

লক্ষ্মীপুর: ৪ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরে হানাদারমুক্ত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর ভোরে লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়িস্থ মিলেশিয়াদের প্রধান ঘাঁটি আক্রমণ করে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করেন।

এ সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল গুলি বর্ষণের মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ওই ঘাঁটির দুই শতাধিক রাজাকার ও হানাদার সদস্য। এটাই ছিল লক্ষ্মীপুরে হানাদারবিরোধী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ প্রতিরোধ।

লক্ষ্মীপুরের প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কমান্ডার রফিকুল ইসলাম মাস্টার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১ ডিসেম্বর মিলেশিয়াদের বাগবাড়ি ক্যাম্প অনেক দূর থেকে ঘেরাও শুরু করে। প্রবল গুলি বর্ষণ করতে করতে ওই ঘাঁটির রাজাকার ও হানাদারদের অবরুদ্ধ রেখে ৩ ডিসেম্বর ঘাঁটির খুব কাছাকাছি ঘিরে ফেলে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাড়াঁশি আক্রমণের মুখে অসহায় হয়ে যায় তারা। পরে ৪ ডিসেম্বর ভোরে হানাদাররা আত্মসমর্পণ শেষে লক্ষ্মীপুর ছেড়ে চলে যায়।

এদিকে নয় মাসে লক্ষ্মীপুরের রণাঙ্গনের ৩৭টি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। এতে ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

বীর শহীদরা হলেন- মনসুর আহমেদ, রবীন্দ্র কুমার সাহা, আলী আজম, লোকমান মিয়া, জয়নাল আবেদিন, মোহাম্মদ হোসেন, আবদুল বাকির, জহিরুল ইসলাম, আহাম্মদ উল্লাহ, আবদুল মতিন, মাজহারুল মনির সবুজ, চাঁদ মিয়া, নায়েক আবুল হাশেম, মো. মোস্তফা মিয়া, নুর মোহাম্মদ, রুহুল আমিন, আবুল খায়ের, আবদুল হাই, মমিন উল্যা, আবু ছায়েদ, আব্দুল হালিম বাসু, এসএম কামাল, মিরাজ উল্ল্যা, মো. আতিক উলাহ, মো. মোস্তফা, ইসমাইল মিয়া, আবদুল্লাহ, আবুল খায়ের ভুতা, সাহাদুলা মেম্বার, আবুল কালাম, মোস্তাফিজুর রহমান, বেনু মজুমদার, আলী মোহাম্মদ, শহীদ নজরুল ইসলাম ও আবদুল রশিদ।  

এ জেলায় মোট শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১১৪।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরো সময়জুড়ে লক্ষ্মীপুর জেলায় বর্বর পাকিস্তানি হানাদার ও এদেশীয় রাজাকার বাহিনীর হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষত-বিক্ষত ছিল। অপরদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রতিরোধ্য গেরিলা যুদ্ধ তাদের জন্য আতঙ্কের কারণ ছিল। ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে লক্ষ্মীপুর হানাদার ও রাজাকারমুক্ত হয়।

লক্ষ্মীপুর শহরের মাদামব্রিজ, বাগবাড়ি গণকবর, দালাল বাজার গার্লস হাই স্কুল, মডেল হাইস্কুল, মদিন উল্যা চৌধুরী (বটু চৌধুরী) বাড়ি, পিয়ারাপুর বাজার, মান্দারী মসজিদ ও প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুল, রায়পুর আলিয়া মাদ্রাসা, এল এম  হাইস্কুল ও ডাকাতিয়া নদীর ঘাট, রামগতির চর কলাকোপা মাদ্রাসা, ওয়াপদা বিল্ডিং, আলেকজান্ডার সিড গোডাউন, কমলনগরের হাজিরহাট মসজিদ, করইতলা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন গোডাউন, রামগঞ্জ গোডাউন এলাকা, রামগঞ্জ সরকারি হাইস্কুল, জিন্নাহ হল (জিয়া মার্কেট) ও ডাকবাংলো ছিল হানাদার ও রাজাকার ক্যাম্প এবং গণহত্যার স্থান।

এদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে লক্ষ্মীপুর-বেগমগঞ্জ সড়কে প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুল, মান্দারী মসজিদ, মাদাম ঘাট ও বাগবাড়ি, লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কে দালাল বাজার, কাজীর দীঘিরপাড়, কাফিলাতলী, পানপাড়া, মিরগঞ্জ, পদ্মা বাজার, মঠের পুল এবং রামগঞ্জের হাইস্কুল সড়ক ও আঙ্গারপাড়া, লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের চর কলাকোপার দক্ষিণে জমিদার হাট সংলগ্ন উত্তরে, করুণানগর, হাজির হাট আলেকজান্ডার এবং রামগতি থানা ও ওয়াপদা বিল্ডিং এলাকা, রায়পুর আলিয়া মাদ্রাসা ও এলএল হাইস্কুল এলাকায় অধিকাংশ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এ সময় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ এবং ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়া মুক্তিবাহিনীর হাতে শত শত হানাদার ও রাজাকার নিহত হয়।

বিভিন্ন ইতিহাস এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া তথ্যমতে, যুদ্ধের নয় মাস লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়ি এলাকায় বিশাল সারের গুদামটি ছিল মিলেশিয়াদের প্রধান ঘাঁটি। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী স্থানীয় বাঙালিদের ধারে এনে এখানে অমানসিক নির্যাতন করা হতো। পরে তাদের সন্নিকটস্থ রহমতখালী খালের ওপর মাদামব্রিজে ফায়ার করে হত্যা করে খালে ভাসিয়ে দেওয়া হতো মরদেহ। বাগবাড়ির এই জায়গাটিকে বলা হয় ‘টর্চারসেল’। যুদ্ধশেষে এই ‘টর্চারসেল’ লাগোয়া গণকবর স্থাপিত হলেও সংরক্ষণ করা হয়নি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত মাদামব্রিজ এলাকা।  

ভগ্নদশা নিয়ে পরিত্যক্ত মাদামব্রিজটি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের ক্ষত চিহ্ন ও স্মৃতি নিয়ে আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়নি।

সূত্র আরও জানায়, নভেম্বরের শেষের দিকে রায়পুর আলিয়া মাদ্রাসায় হানাদারদের ক্যাম্প আক্রমণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। কমান্ডার হাবিলদার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা এখানে হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম বাসু শহীদ হন।

শহীদ আব্দুল হালিম বাসুর নিজ এলাকা সদর উপজেলার বাঙ্গাখাঁ ইউনিয়নের প্রধান সড়কটি তার নামে নামকরণ করা হয়। বিজয়র নগর এলাকায় তার নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বাসু বাজার’।

১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এ কে এম আলী হায়দারের নেতৃত্বে তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালীর বাঁধের হাট এলাকার রাজগঞ্জে বীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন মাজহারুল মনির সবুজ। তার নামানুসারে নিজ এলাকা ভবানীগঞ্জের পিয়ারাপুরে ‘শহীদ মাযহারুল মনির সুবজ উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০২৩
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।