ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

সন্তানদের ছবি দেখে দেখেই ঢাকার রাস্তায় ২০ বছর পার

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৩
সন্তানদের ছবি দেখে দেখেই ঢাকার রাস্তায় ২০ বছর পার রমজান আলী -বাংলানিউজ

ঢাকা: গলায় ঝুলিয়ে রাখা সন্তানদের ছবি দেখে আর চোখের পানি ফেলে ঢাকার রাস্তায় ২০ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন রমজান আলী (৬০)। এক সময় নিজের করা কিছু ভুলের কারণে এখনো পরিবার থেকে দূরে তিনি।

কিন্তু সন্তানদের মায়া কখনোই ভুলতে পারেনি রমজান আলী। এক মেয়ে ও দুই ছেলের ছবি লেমিনেটিং করে একটি নীল রঙের ফিতার মাধ্যমে গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সেই ছবি দেখেন আর নিরবে চোখের পানি ফেলেন পঙ্গু এই বৃদ্ধ বাবা।

সোমবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকে পুরাতন ভবনের সামনের গ্রিল ঘেরা একটি খালি স্থানে বসে গলায় ঝুলিয়ে রাখা সন্তানদের ছবিগুলো বারবার দেখছিলেন রমজান আলী।

কাছে গিয়ে জানতে চাওয়া হয় ছবিগুলো কার? চোখের পানি মুছতে মুছতে জানান, প্রথম ছবিটি  আদরের মেয়ে টুম্পার, তারপরের দুটি ছোট ছোট ছবি ছেলে রাসেল ও শাওনের। সন্তানদের সেই ছোট বেলার ছবি। সেই ছবিগুলো আজও গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন।

রমজান বলেন, তার সন্তানরা এখন বড় হয়েছে। এক ছেলে বিয়েও করেছে। তারা অসুস্থ মা রাশিদা বেগমের সঙ্গে কামরাঙ্গীরচর ব্যাটারি গলি এলাকায় একটি বাসায় থাকে। তবে, তাদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। ইচ্ছে করেই তিনি যোগাযোগ করেন না। এক দুর্ঘটনায় ডান পা হারিয়েছেন বহু বছর আগে। তারপর থেকেই রাস্তায় ভিক্ষা করে চলছেন। সেই দুর্ঘটনার আগে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এসব নানা ভুলের কারণে পরিবার থেকে এখনো বিচ্ছিন্ন। এরই মধ্যে রাস্তায় রাস্তায় ২০ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। এখনো রাস্তায়ই কাটছে তার জীবন।

রাস্তায় ভিক্ষা করে জীবন কাটলেও সন্তানদের প্রতি তার মায়া এখনো অটুট। তাই  মুহূর্তে মুহূর্তে গলায় ঝুলিয়ে রাখা সেই ছবিগুলো দেখেন আর নিরবে চোখের পানি ফেলেন।

রমজান বলেন, এখন নেশা করি না, অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। এক সময় মিনি ট্রাক চালাতাম। ওই ট্রাক চালানোর সময় কেরানীগঞ্জের কদমতলী এলাকায় দুর্ঘটনায় ডান পা থেঁতলে যায়। পরে হাসপাতাল গেলে ডাক্তাররা পায়ের সেই অংশ কেটে ফেলেন। ওই দুর্ঘটনার আগে থেকেই মাদকাসক্ত ছিলাম। নানারকম মাদক সেবন করতাম। বাসায় তখনও যাওয়া আসা করতাম। একপর্যায়ে বিভিন্ন বদনাম ও অত্যাচারের কারণে পরিবার তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

তিনি বলেন, তখন থেকেই রাস্তা আমার জীবন, রাস্তা আমারর সঙ্গী। একে একে রাস্তায় ২০টি বছর কাটিয়ে দিয়েছি। অতীত জীবনের ভুলগুলো এখন পদে পদে বুঝতে পারছি। বেপরোয়া চলাচল ও মাদক সেবনের কারণে সন্তানদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যেতে হয়েছে। সমাজের কথা বাদই দিলাম।

এক পর্যায়ে আবারও তার গলায় ঝুলে থাকা ছবির দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন, আমার পোলাপানরা হচ্ছে সোনার মানুষ। মাঝেমধ্যে লুকিয়ে কামরাঙ্গীরচরে গিয়ে মেয়ের সঙ্গে দেখা করি, কেউ যেন দেখতে না পায়। সন্তানরা খোঁজ-খবর নেয় কিনা জানতে চাইলে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, আমার পোলাপানরা সোনার মানুষ। সবসময় আমার খোঁজ নেয়। বলে আব্বা তুমি বাসায় থাকো, কিন্তু আমি থাকি না।

রমজান আলী আরও বলেন, এই শাহবাগ এলাকায় কাটিয়েছি ২০ বছর। কখনো হাইকোর্ট মাজার, কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, আবার কখনো বঙ্গবাজার এলাকায়। সারাদিন ভিক্ষা করার পরে বর্তমানে এই হাসপাতালের (ঢামেক) চত্বরে রাতে ঘুমাই। তবে এখানেও ঠিকমতো থাকতে পারি না, উঠায়ে দেয়।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৩
এজেডএস/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।