ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

কপ-১৭: অধিক কার্বন শোষণে বিষাক্ত হচ্ছে সাগর-মহাসাগর

প্রতীক বর্ধন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১১
কপ-১৭: অধিক কার্বন শোষণে বিষাক্ত হচ্ছে সাগর-মহাসাগর

সামুদ্রিক অম্লত্ব বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি গুরুতর ক্ষেত্র। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে; ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে বহু দেশ তলিয়ে যেতে পারে; এমন আশঙ্কাও রয়েছে।

এটা এখন ছেলেবুড়ো প্রায় সবাই জানে। কিন্তু অধিক হারে কার্বন নিঃসরণের ফলে সমুদ্রের পানির অম্লত্ব বৃদ্ধি যে আমাদের জন্যে আরেক মহাবিপদ ডেকে নিয়ে আসছে, তা অনেকটাই অগোচরে রয়ে গেছে।  

 সমুদ্র গবেষকরা ইতোমধ্যে সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে, সমুদ্রের পানির ক্রমাগত অম্লত্ব বৃদ্ধি সামুদ্রিক প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের জন্য এক মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। অত্যাধিক হারে কার্বন শোষণের কারণে সমুদ্রের পানিতে প্রবালের বংশবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। প্রবাল না থাকলে রিফও হয় না। প্রায় এক চতুর্থাংশ সমুদ্রের প্রাণীর বাসস্থান হচ্ছে প্রবাল প্রাচীর। অন্যদিকে, পর্যটন স্পট হিসেবে খ্যাত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ থেকে বছরে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার আয় হয়ে থাকে, যা প্রায় ৬৩ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। আরও বিপুল সংখ্যক মানুষ খাদ্যের জন্যে প্রবালের ওপর নির্ভরশীল। প্রবাল বিলুপ্ত হলে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। এর ফলে সমুদ্রের বিভিন্ন স্তরের বাস্তুতন্ত্র, মাছ, অপরাপর প্রাণী হারিয়ে যেতে পারে; এমনকি সমুদ্রের পুরো খাদ্যশৃঙ্খলও ভেঙে পড়তে পারে।  

 অধিক হারে কার্বন শোষণের ফলে সমুদ্রের পানির ph কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে হাইড্রোজেন আয়নের (H+) ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্প বিপ্লবের পরবর্তীকালে সমুদ্রের পানির উপরের ph-এর মাত্রা লগারিদমের স্কেলে ০.১ ইউনিট কমেছে। অন্যদিকে, হাইড্রোজেন আয়নের (H+) ঘনত্ব বেড়েছে ২৯ শতাংশ। ধারণা করা হচ্ছে, ২১০০ সাল নাগাদ ph আরও ০.৩ থেকে ০.৫ ইউনিট কমবে। যদি এ হারে মনুষ্যসৃষ্ট কার্বন নিঃসরণ চলতে থাকে। ph এর মান ৭-এর নিচে গেলে পানির অম্লত্ব বৃদ্ধি পায়, ৭ এর ওপরে থাকলে ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ প্রাণের বিকাশের জন্য ph এর মান নির্দিষ্ট থাকা আবশ্যক।

পৃথিবীতে নিঃসরিত কার্বন ডাই অক্সাইডের ৩০ শতাংশ শোষণ করে আমাদের সাগর ও মহাসাগরগুলো। আবার গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরনের ফলে যে তাপ উৎপন্ন হয় তার ৮০ শতাংশ শোষণ করে এই সাগর ও মহাসাগর। তবে এর জন্য এদের বিরাট ক্ষতির সম্মুখিন হতে হচ্ছে। আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তার ৫০ শতাংশ সরবরাহ করে সামুদ্রিক প্লাংকটন। সমুদ্রের পানির অম্লতা  বেড়ে যাওয়ার কারণে এসব ছোট ছোট আণুবীক্ষণিক প্রাণী দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের অস্তিত্বের জন্যে সেটা কতটা মারাত্মক হবে তা বলাই বাহুল্য।

অব্যাহতভাবে কার্বন নিঃসরণের কারণে সমুদ্রের নিজস্বতা লোপ পাচ্ছে। অন্যভাবে বললে, তার রসায়ন বিনষ্ট হয়ে পড়ছে। এর ফলে শক্ত খোলসঅলা সামুদ্রিক প্রাণী যেমন প্রবাল, কাঁকড়া, ক্ল্যাম প্রভৃতি প্রাণীর অস্তিত্ব বিপণ্ন হয়ে পড়ছে। সমুদ্রের পানিতে অধিক হারে শোষিত কার্বন ক্যালসিয়াম শোষণ করছে। এসব প্রাণীর খোলস ও কঙ্কাল তৈরির জন্য যা একান্ত অপরিহার্য। পরিণামে, এসব প্রাণীর বংশবিস্তার করা কঠিন হয়ে পড়বে। এমনকি এ হারে যদি কার্বন নিঃসরণ চলতে থাকে তাহলে বর্তমানে জীবিত এসব অনেক প্রাণীর খোলস ও কঙ্কাল গলে যেতে পারে।

অন্যদিকে, যেসব প্রাণীর এরূপ ক্যালসিয়াম প্রয়োজন নেই, তারা সরাসরি বিলুপ্ত না হলেও বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে তাদের সামগ্রিক ফিটনেস ও বেঁচে থাকার ক্ষমতা হ্রাস পাবে। ফলে এসব প্রাণীর বৃদ্ধির হার, বংশবৃদ্ধি ও নিশ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষমতা প্রভৃতি হ্রাস পাবে। শেষ পর্যন্ত তাদের খাদ্য শৃঙ্খল ও বাস্তুতন্ত্রকেও ভেঙে দিতে পারে।

বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, সমুদ্রের এই ক্রমর্ধমান অম্লতা এক দশকের মধ্যে প্রকৃতির তাপমাত্রা ও মেরুর জলজ বাস্তুতন্ত্রের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। কারণ, শীতল পানি উষ্ণ পানির চেয়ে অধিক হারে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। আমাদের মেরুর সমুদ্র ইতোমধ্যে যেভাবে এসিডিক হয়ে পড়েছে তাতে সেখানে অনেক খোলসঅলা প্রাণীর খোলস গলে পড়ছে।

কুইন্সল্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অভ হোয়েগ গুল্ডবার্গ বলেছেন, ‘বিগত ২০ বছর প্রবাল প্রাচীর নিয়ে গবেষণা করে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, কার্বন নিঃসরণ কমানো সম্ভব না হলে এই অপরূপ ও সমৃদ্ধ বাস্তুতন্ত্র আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে। আমার এ হাইপোথিসিস ভুল হলে আমি খুব খুশি হতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য; আমার এ ধারণার পেছনে প্রচুর বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। ’

একইসাথে ইউরোপীয়দের কাছে সামুদ্রিক খাবারের জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিশেষত মাছ, সামুদ্রিক টুনা মাছ অত্যন্ত প্রিয় করে তোলা হয়েছে বিভিন্ন প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে। আর ইউরোপীয়দের এই রসনা বিলাস মেটাতে সি ফিশ কোম্পানিগুলো আটলান্টিক থেকে নির্বিচারে টুনা মাছ শিকার করছে। টুনা মাছ শিকার বন্ধে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন ফর দ্য কনজারভেশন অব আটলান্টিক টুনাসের বিজ্ঞানীরা মাছের রাজা খ্যাত এ মাছ শিকারের বার্ষিক যে মাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন এ সংস্থাটি ফিশিং কোম্পানিগুলোকে তার চেয়ে অধিক হারে টুনা শিকারের সুযোগ দিচ্ছে। যদিও এটা সবাই জানে বর্তমান হারে টুনা শিকার হতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই টুনা নিশ্চহ্ন হয়ে যাবে। তা নিয়ে অনেক শোরগোলও হচ্ছে। এতসব কিছুর পরও টুনা শিকার কোনভাবেই থামছে না। কারণ তার পেছনে পুঁজির আরেকটি সূত্র ক্রিয়াশীল, টুনা মাছের সংখ্যা যত কমবে তার দাম ততই বাড়বে, লাভও তাই অধিক। সেকারণেই এ প্রজাতির দু-চারটে মাছ বাঁচিয়ে রেখে লাভ কী? সর্বোচ্চ পরিমাণ লাভ করে তারপর এ শিল্প থেকে পুঁজি সরিয়ে অন্য শিল্পে বিনিয়োগ করলেই তা লাভজনক। অবস্থাদৃষ্টে অন্তত তাই মনে হচ্ছে।

তিমির তেলের জন্য ব্যাপক হারে তিমি শিকার করছে মানুষ। হাঙ্গর শিকার করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে সমুদ্রের তলদেশে বসবাসরত বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদও বিলীন হতে বসেছে। অথচ পৃথিবীতে যে পরিমাণ সামুদ্রিক শৈবাল রয়েছে তা মানুষের আমিষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট বলে মনে করা হয়।

এদিকে, সুমেরুতে ক্রমাগত বরফের পরিমাণ কমছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গত দেড় সহস্রাব্দে যতরকম প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটেছে সুমেরুর এই বরফ হ্রাস তার মধ্যে এক নম্বর। তারা বলছেন, এর মধ্যে প্রাকৃতিক ব্যাপারের চেয়ে মনুষ্য হস্তক্ষেপের প্রভাবই অধিক। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সমুদ্রের বরফ এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্নো অ্যান্ড আইস ডাটা সেন্টার একটি স্যাটেলাইট ডাটা সেটের ওপর ভিত্তি করে গবেষণা পরিচালনা করে বলেছে, ২০১১ সালে সমুদ্রের বরফের পরিমাণ দ্বিতীয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে, ২০০৭ সালে যা সর্বাধিক ছিল।

জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস্টোফ কিনার্ড বলেন, সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হচ্ছে অতীতে সমুদ্রে বরফ হ্রাসের যেসকল কারণ দেখা গেছে তার সাথে বর্তমান এই বরফ হ্রাসের তেমন মিল নেই। তিনি বলেন, সবকিছুই যেন বাড়ছে পানির উপরিভাগের তাপমাত্রা, প্রকৃতির তাপমাত্রা। ফলে সমুদ্র উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, আর গরম পানি ও ও লবণাক্ত পানি আরও অধিক হারে সুমেরুতে প্রবেশ করছে। এতে বরফ ভেতর থেকে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে ও উপর থেকে গলে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, অতীতে সামুদ্রিক স্রোতের গতি পরিবর্তনের ফলে উত্তর আটলান্টিক সাগরের লোনা ও গরম পানি সুমেরুতে প্রবেশ করত। কিন্তু বর্তমানে বায়ুর তাপমাত্রা প্রধান কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ক্রিস্টোফ কিনার্ড তার পিএইচডি করতে গিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের সমাধান খোঁজেন, ‘বর্তমান পরিবর্তন কি একটু ভিন্নরকম, এটা কি কোনো বৃহত্তর চক্রের অংশ? তা সমাধান করতে গিয়ে তিনি ৬০টি ভিন্ন উৎস থেকে ডাটা সংগ্রহ করেন। তাতে তিনি বিগত ১৪৫০ বছরের সামুদ্রিক বরফের মাত্রা পরিবর্তনের একটি ইতিহাস লিপিবব্ধ করেন। তিনি দেখেন ইতিহাসে যে সময় বরফের পরিমাণ সবচেয়ে কম ছিল, তখন সুমেরুতে ৮.৫ মিলিয়ন বর্গ কিমি বরফ ছিল। বর্তমানে বরফের পরিমাণ এর চেয়েও কম।  

বরফ কমে যাওয়া যেমন তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি ফলাফল, তেমনি এ কারণে সমুদ্রের পনির তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ বরফ স্বচ্ছ হওয়ায় তা তাপ প্রতিফলন করে। কিন্তু সমুদ্রের পানি হচ্ছে গাঢ়, যার ভেতরে গেলে পাওয়া যায় অন্ধকার। এই কালো পানি অধিক হারে তাপ শোষণ করছে, সমুদ্র হয়ে উঠছে তপ্ত। এর ফলে সমুদ্রের ক্রমক্ষয়িষ্ণু বাস্তুতন্ত্র আরও বিপদের মুখে পড়বে। অর্থাৎ বিপদ ঘটছে চারদিক থেকেই।

Protik-Bardhanপ্রতীক বর্ধন
লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিবেশকর্মী;
ইমেইল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।