ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

সাদাসোনার খোঁজে চাষিরা, ধ্বংসের মুখে প্রকৃতি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৩
সাদাসোনার খোঁজে চাষিরা, ধ্বংসের মুখে প্রকৃতি

সোলাদানা, পাইকগাছা, খুলনা থেকে: পরিবেশ ধ্বংস করে সাদাসোনার সন্ধানে ছুটছে হাজারো মানুষ। জনবসতির প্রয়োজনে সবুজ প্রকৃতি থাকুক বা নাই থাকুক হাতে চাই প্রচুর অর্থ।

চেনাজানা ছায়াঘেরা গ্রাম, গাছপালা, তরুলতা, গবাদিপশু, কৃষি আবাদ কিছুই থাকছে না।

মাঠের পর মাঠ শুধু পানি আর পানি। যে জমিতে এক সময় নানা জাতের ধান হতো, সেখানে এখন চাষ হচ্ছে চিংড়ি। এ চিত্র খুলনার পাইকগাছার বিভিন্ন গ্রামের। সেখানকার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে পাওয়া যায় চিংড়ি চাষের প্রভাবে বহুমুখী ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র। এলাকাবাসী সরেজমিন বাংলানিউজকে জানান, চিংড়ি চাষ তাদের অবস্থা কিছুটা বদলাতে পেরেছে ঠিকই। কিন্তু সেই ছায়াঘেরা সবুজ পরিবেশ এখন আর এ এলাকায় নেই।

পাইকগাছার লস্কর, সোলাদানা, লতা ও দেলুটিয়া ইউনিয়নে চিংড়ি চাষের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া চাঁদখালী, বড়ইখালী, কপিলমুনি ও হরিঢালী ইউনিয়নেও বেশ কিছু এলাকায় চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে এ ইউনিয়নগুলো বাদে বাকি এলাকার চেহারা একেবারেই ভিন্ন। গদাইপুরসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সবুজ ধানক্ষেত যেন সেখানে নবান্নেরই আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

পাইকগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিভাস চন্দ্র সাহা বাংলানিউজকে বলেন, ১০ বছর আগে উপজেলায় ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে ধান আবাদ হতো। চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হওয়ায় আবাদি জমির পরিমাণ কমে ১৬ হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে।

অন্তত ১৩ হাজার কৃষক এ পেশা থেকে অন্য পেশায় ফিরেছে। চিংড়ি চাষের জমিতে অধিকাংশ সময় লবন থাকায় মাটির উর্বরা শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে ফিরতে চিংড়ি ও ধানের সমন্বিত চাষের উদ্যোগ নিতে হবে।

পাইকগাছার লস্কর ও সোলাদানা ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লবণাক্ততার কারণে খাবার পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। কয়েক কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে কিংবা ভ্যানে পানি সংগ্রহ করতে হয়।

গবাদিপশু, হাঁসমুরগি, ভেড়া, ছাগল নেই। বাড়ির আঙিনায় আগে সবজি হতো, সবজি বাজার থেকে কিনতে হতো না। এখন বাজার থেকে উচ্চমূল্যে সবজি কিনতে হচ্ছে।

সোলাদানা ইউনিয়নের খালিয়ার চর গ্রামের বাসিন্দা রমেন্দ্র নাথ মণ্ডল বললেন, তার বিশাল বাগানের বাড়ি ছিল। বাড়িতে সব ধরনের ফলদ গাছপালা ছিল। জন্মাতো প্রচুর সবজি। বাজার থেকে কিছুই কিনতে হতো না। এখন পানি থেকে শুরু করে সবই কিনতে হচ্ছে।

এলাকায় চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হওয়ায় রমেন্দ্র নাথ মন্ডল নিজেও কৃষি পেশা থেকে সরে এসেছেন। চার একর জমির মধ্যে তিন একর চিংড়ি চাষের জন্য বর্গা দিয়েছেন। বাকি এক একর জমিতে নিজেই চিংড়ি চাষ করেন।

এক সময় জমিতে ধান আবাদ করেই জীবিকা চলতো। কিন্তু এখন তো সে পরিবেশ নেই। চিংড়ি চাষ কাউকে সম্পদশালী করেছে। আবার কাউকে করেছে ভিখারী। এমন কথাই বললেন রমেন্দ্র নাথ।

সরেজমিনে এলাকা ঘুরে দেখা যায়, চিংড়ি চাষ এলাকার ভেতরে ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন বাড়িঘর। বাড়ির আঙিনা, স্কুলের বারান্দা অবধি সব সময় পানি থাকছে। বাড়ির উঠান নেই, স্কুলে নেই খেলার মাঠ। গাছপালার সংখ্যা খুবই কম। এ যেন ভিন্ন পরিবেশ।

এসব এলাকার মানুষ জানালেন, শুধু লবণ পানির কারণে নয়, সারা বছর জমি পানিতে ডুবে থাকায় মাটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শালিক, কাক, বক, ঘুঘু, সাপ, ব্যাঙ, শামুক এগুলো এখন আর এলাকায় দেখা যায় না। এলাকার ছেলেমেয়েরা এ সব প্রাণীদের চিনে না।

পাইকগাছা ধান-মাছ-পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি আজমল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ছোট ছোট জমির মালিকেরা ঘের মালিকদের কাছে জিম্মি। বর্গা দেওয়া জমি তারা ছাড়িয়ে আনতে পারছে না। ফলে একসময় নিজের জমিতে চাষাবাদ করে কোনোমতে বেঁচে থাকা পরিবারটি ভূমিহীন হয়ে পড়ছে।

ফরিদপুর, বরিশাল, গোপালগঞ্জ অঞ্চল থেকে একসময় এ সব এলাকায় কৃষি মজুরেরা ধান কাটতে আসতো। আর এখন এ এলাকা থেকে মানুষ ধান কাটতে যায় অন্যত্র।

সরেজমিনে সোলাদানা চৌরাস্তায় কথা হচ্ছিল চিত্তরঞ্জন মণ্ডল, উজ্জল পালা, কল্যাণ কুমার সানাসহ অনেকের সঙ্গে। তাদের কথামতে, জানি চিংড়ি চাষে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। তারপরও চিংড়ি চাষ না করে পারছি না।

এখন ধান আবাদে অনেক খরচ। অনেক সময় উৎপাদন খরচও ওঠে তোলা যায় না। চিংড়ি চাষ কখনো কখনো মার খেলেও তাতে ততটা লোকসান হয় না। ধানের চেয়ে বরং আমরা চিংড়ি চাষ করেই ভালো আছি।

বাংলাদেশ সময়: ০২২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/পিসি/জেসিকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।